
সত্তর দশকের গল্প: উত্তরাধিকার ও পরিপ্রেক্ষিত
সুশান্ত মজুমদারপ্রকাশিত : মে ০৬, ২০১৯
বাংলা একাডেমির উদ্যোগে প্রকাশিত হলো ‘বাংলাদেশের গল্প : সত্তর দশক’ গ্রন্থটি। স্বাধীন বাংলাদেশের শুরু থেকে একদশকের মধ্যে যে সব উল্লেখযোগ্য গল্প লেখকের উত্থান, গ্রন্থটি তাঁদের গল্পের সংকলন। লেখকদের জন্ম স্বাধীনতা-পূর্বে হলেও সক্রিয় সাহিত্যচর্চা সত্তরের দশক থেকে। যুবক চোখ দিয়ে দেশ-সমাজ ও মানুষকে লেখকরা অবলোকন করেছেন এবং স্ব স্ব অভিজ্ঞতার নির্যাস দিয়ে গল্প রচনা করেছেন। সত্তরের গল্পকারদের দৃষ্টিভঙ্গি, মনোযোগ, গল্পের বিষয়, সামগ্রিকভাবে সত্তরের গল্পের শিল্পমূল্য যাচাই করার ব্যাপারে গ্রন্থটি সজ্ঞান পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে আশা করা যায়। গল্পগুলি অবশ্য উল্লিখিত দশকের লেখা নয়। সৃষ্টির শুরুতে পরিণত গল্প লিখে সিদ্ধি ও স্বীকৃতির স্তরে পৌঁছে যাওয়া লেখক সত্তরের দশকে শুধু নয়, স্বাধীনতার পূর্বাপর কোনো দশকেই নেই। পৃথিবীর সব ভাষার সব সাহিত্যে তা বিরল। লেখার শৈশবে সবাই ছিলেন কমবেশি অপরিণত। এটাই স্বাভাবিক—মানুষ ক্রমশ বেড়ে ওঠে এবং নিরলসচর্চার মধ্য দিয়ে পরিণতির দিকে যায়। অগ্রজের মতো সত্তরের অনুজ লেখকেরও প্রথমদিকের গল্প ছিল দুর্বল। আজ লেখক-জীবনের সূচনা পর্বের গল্প পড়ে অনেকেই বিব্রত হন। ওই গল্প-সংকলিত হওয়ার ব্যাপারে তাঁদের সম্মত হওয়ার কথা না। গ্রন্থে তাই লেখকের প্রতিনিধিত্বমূলক গল্পটি মুদ্রিত হয়েছে। বিবেচনা করে কোনো কোনো লেখকের সম্প্রতি লেখা গল্প গ্রন্থের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে। সত্তরের দশকে বয়োজ্যেষ্ঠ লেখকরাও সাহিত্য রচনায় সক্রিয় ছিলেন। অগ্রজদের কেউ কেউ তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্প এই দশকে এসে লিখেছেন। কিন্তু সাহিত্যে তাঁদের আগমন পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে হওয়ায় অগ্রজদের গল্প সংকলনভুক্ত হয় নি। ইতোমধ্যে সত্তর-দশকের কোনো কোনো লেখক লেখায় নিস্ক্রিয় হয়ে গেছেন। জীবিতাবস্থায় তাঁরা আর লিখবেন না—এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। লেখক-জীবনে লেখায় সাময়িক বা দীর্ঘ বিরতি আসতে পারে। নতুন সাহিত্যাদর্শ—বিষয় ও আঙ্গিক ভাবনায় ভাবিত হয়ে নিজের সঙ্গে লেখক বোঝাপড়া করে নিতে পারেন। বর্তমানে না লিখলেও একসময় তাঁরা তরুণ গল্পকার হিসেবে যথেষ্ট সম্ভাবনার পরিচয় রেখে পাঠক মনোযোগ দখল করতে পেরেছেন। অনিবার্যভাবে তাঁর গল্পও এই সংকলনে জায়গা করে নিয়েছে।
এখন, দশক-ওয়ারী বিভাজন স্বীকার করে নিয়ে সত্তরের দশকের গল্প আলোচনা করতে হলে আগের দশকসমূহ সেই বিভাগোত্তর কালের গল্পচর্চার দিকে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। অগ্রজদের সাহিত্যের ধারাবাহিকতা এবং অনুজ গল্পকারদের গ্রহণ-বর্জনের ভেতর দিয়ে যে গল্প নির্মাণের প্রয়াস তা সনাক্ত করা দরকার। সত্তরের গল্প সাহিত্যকে তাই নির্দিষ্ট করতে হলে পূর্বের গল্পসাহিত্যকে সামনে রাখা জরুরী। কি উত্তরাধিকার সত্তরের গল্পকাররা প্রাপ্ত হয়েছেন, আর কি বিষয়-সম্পদ গল্পসাহিত্যে তাঁরা বৃদ্ধি করেছেন?
আমাদের গল্পসাহিত্যের পুরনো পৃষ্ঠা উল্টালে দেখি, সামগ্রিকভাবে বিষয়ে, আঙ্গিকে, গদ্যে মূল্যবান ছোটগল্প তেমন লিখিত হয় নি। সরাসরি এ-কথা বললে বিভাগোত্তর লেখকদের প্রতি সুবিচার করা হয় না। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তখন খ-িত দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রাক্তন ধ্যান-ধারণার পোষকতা করা হয়েছে। সমাজের ক্রমাগ্রগতি ও মুক্তবিশ্বাস পালনের মতো অনুকূল পরিবেশ ও সুযোগ তখন ছিল না। কিন্তু শ্বাসরুদ্ধ কঠিন বিরুদ্ধ পরিবেশ ও পরিস্থিতির মধ্যেও লেখক সজাগ দায়িত্ব থেকে সরে আসেন না। আমাদের বিভাগোত্তর লেখকরা তৎকালীন তমুদ্দুনী কলরব ও জঙ্গীজোশ কড়া হাতে মোকাবেলা করতে পারেন নি। তবু সাধ্য অনুযায়ী ছোটগল্প লেখার চেষ্টা করেছেন আবুল ফজল, আবু রুশদ, সরদার জয়েনউদ্্দীন, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, শওকত ওসমান, আবু ইসহাক প্রমুখ। এঁরা মুক্তবুদ্ধি আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব নিয়ে ছোটগল্পচর্চায় উদ্যোগী ছিলেন। দেশের বিরাজমান পরিপ্রেক্ষিত তখন ছিল শোচনীয়। তৎকালীন কথাসাহিত্যেকরা তাঁদের সামনে পেয়েছেন বিশ্বযুদ্ধোত্তর সংকট, মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দেশভাগের মতো নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অন্যায্য ঘটনাসমূহ। এমন প্রতিকূল সামাজিক দুরবস্থার ভেতর একজন সৃজনশীল লেখককে মনোযোগ দিতে হয়েছে রাষ্ট্রীয় ঘটনাসমূহ, সামাজিক অব্যবস্থার প্রতি এবং একই সঙ্গে তাঁর শিল্পের উপর। এই টানাপোড়েনের মধ্যেও আবুল ফজল, শওকত ওসমান ছোটগল্পে অসাম্প্রদায়িক মানবিকতা, গ্রাম-জীবনের অসাম্য অসঙ্গতি মূর্ত করে তোলেন। আরেকদিকে কেউ কেউ বিভ্রান্ত হয়ে আধুনিক সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য নির্ণীত হওয়ার পরও বিভাগোত্তর কথাসাহিত্যকে আধুনিক করে গড়ে তুলতে ছিলেন নারাজ। তাঁদের সাহিত্যও দেশভাগের ভেদ বুদ্ধি ফেলে বিবেচনা করার কারণে ক্ষুণœ হয় বাংলা কথাসাহিত্যের ধারাবাহিকতা। তাঁরা খারিজ করে দেন কথাসাহিত্যের উত্তরাধিকার। (প্রকৃতপক্ষে, ইতিহাসের জ্বলন্ত প্রেক্ষাপট—দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভূমি-উৎখাত শরণার্থীদের বিদেশ-বিজন-বিভূঁইয়ে মানবেতর জীবন-যাপন মিলিয়ে সমাজ ও মানুষের অসহায় করুণ গাথা আমাদের সামনের সারির অগ্রজ গল্পকাররা ছোটগল্পে নিয়ে আসতে পারেন নি। গ্রামীণ পটভূমির দুর্নীতি, অসাম্য এবং ছিন্নমূল মানুষের যা কিছু দুঃখ ছোটগল্পে এসেছে তা এতোই কুয়াশাচ্ছন্ন যা সরিয়ে পাঠক সত্যের মুখোমুখি হতে পারেন না। ব্যতিক্রম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্—বিষয় উপস্থাপনায়, গল্পভাষায় তিনিই আমাদের গল্পসাহিত্যকে আধুনিকতার মর্যাদা দান করেন।) তিনি উপন্যাস এবং গল্প দুই-ই পাঠযোগ্য এবং আয়ুষ্মান করে তোলেন। আমাদের আধুনিক ছোটগল্প তাঁকে দিয়ে শুরু। আজো আমাদের কথাসাহিত্যে তিনি শক্তিমান লেখক হিসেবে মর্যাদাবান।
পঞ্চাশ দশকের গল্পেও চল্লিশ দশকের ধারা প্রবহমান ছিল। চল্লিশ দশকের গল্প বৈশিষ্ট্যের দ্বারা প্রধানত শাসিত হয়েছে পরবর্তী দশকের গল্প। এই সময়ে প্রচল প্রবাহ থেকে বেরিয়ে মুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক এবং প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনার আলোকে কথাসাহিত্য চর্চায় মনোযোগী ছিলেন তাঁদের মধ্যে আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, রশীদ করীম, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গাফফার চৌধুরী, রাজিয়া খান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, শওকত আলী, শহীদ সাবের, জহির রায়হান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ অন্যতম। এদের অনেকে প্রত্যক্ষ করেন ৫২-র ভাষা আন্দোলন। অনেকে সক্রিয়ভাবে ছিলেন ভাষা-আন্দোলনের এবং পরবর্তী সময়ে প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী। এই ভূখ-ের জনগোষ্ঠীর স্বরূপ সন্ধানের প্রথম এবং যাত্রারম্ভের মাইলফলক—ভাষা আন্দোলন। ৫২-র ভাষা-আন্দোলন তছনছ করে ফেলে সামাজিক জড়তা, চূর্ণ করে মানবিক স্থবিরতা ও দাসত্ব এবং ভেঙ্গে দেয় বাঙালির উৎসমুখের সমূহ জটিলতা। নতুন বোধ, উৎসাহ এবং চিন্তার আলো পতিত হয় লেখকের মনোভূমিতে এবং তাঁর শিল্পের হৃদপি-ে। আলাউদ্দিন আল আজাদের গল্পের বিষয় সমাজের শ্রেণীদ্বন্দ¦ এবং নিপীড়িত মানুষ। কিন্তু তাঁর লেখার শ্রেণীদ্বন্দ্ব ছিল রোমান্টিসিজম দ্বারা আচ্ছন্ন। পরে মনোবাস্তবতার রূপকার হতে গিয়ে তিনি, নিজের সাহিত্যকে আহত করে ফেলেন। হাসান হাফিজুর রহমানের প্রধান পরিচয় কবি হওয়া সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী গল্প রচনার কারণে তিনি আমাদের গল্প সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিসজ্ঞাত মানবিক মূল্যবোধ তাঁর গল্পে সংশ্লিষ্ট। সৈয়দ শামসুল হক ও শওকত আলী পঞ্চাশ দশকের লেখক হলেও তাঁরা বিকশিত হয়েছেন মূলত ষাটের দশকে। এদের গল্পের ভেতর দিয়ে ব্যক্তির প্রতিষ্ঠা হয়। ব্যক্তির আমোদ, উল্লাস, প্রাণ শুধু নয়, ব্যক্তির পতন ও মুমূর্ষু জীবনবেদও এদের গল্পে প্রতিফলিত হয়। জহির রায়হান ছোট ছোট বাক্যে কাব্যধর্মী গদ্যে কথাসাহিত্য চর্চা করেছেন। হালকাভাবে হলেও রাজনীতি প্রবেশ করেছে তাঁর গল্পে। সাইয়িদ আতীকুল্লাহ পরাবাস্তবতা গল্পধারায় অগ্রবর্তী লেখক। ষাটের দশকে গল্পের পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে মানুষের অন্তর্জগত, মনোরাজ্যের আলোড়ন, আত্মকথন মিলিয়ে গল্পচর্চায় পরাবাস্তবতা ব্যাপারটা অস্পষ্টভাবে প্রথমে দেখা দেয় জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, হুমায়ুন চৌধুরী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং পরে আবদুল মান্নান সৈয়দের লেখায়। আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রথমদিকের লেখা ছিল পুরোপুরি রোমান্টিক।
ষাটের দশকে বাংলাদেশের গল্প পৌঁছে যায় সম্মানজনক স্তরে। ভাষা-আন্দোলনের প্রভাবে সমাজের উপর কাঠামোতে আসে এক ব্যাপক আলোড়ন। রাজনীতিতে ক্রমশ সচেতন হয়ে ওঠে বাঙালি। অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে উত্থাপিত হতে থাকে বিভিন্ন দাবী। এই দাবীতে সংগঠিত এবং সোচ্চার হয়ে ওঠে মানুষ। একদিকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারা আরেক দিকে সমাজ পরিবর্তনে সশস্ত্র সংগ্রাম ভেঙ্গে দেয় মানুষের মানসিক জাড্য। নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে ষাটদশকের লেখকরা সমাজবাস্তবতা, তার শরিক মানুষ, তাঁদের জীবন-যাপন এবং রাষ্ট্রীয় আলোড়নসমূহ ছোটগল্পের বিষয় করে তোলেন। ক্ষুধার আগুনে দগ্ধ গ্রাম ও অস্বাভাবিক বিকাশশীল লুটেরা শহরের যাবতীয় পচন, মাটি ও ইট-কাঠের নিচে চাপা পড়া মানুষের আহাজারি ধারণ করে জীবন্ত হয়ে ওঠে ছোটগল্প। জমে যাওয়া নতুন কথার কারণে নতুন আঙ্গিক গ্রহণ করেন এ সময়ের লেখকরা। পঞ্চাশ দশকের লেখক সৈয়দ শামসুল হক, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, শওকত আলী এসে মেশেন ষাটের ধারায়। এই দশকের উল্লেখযোগ্য লেখক : হাসান আজিজুল হক, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, মাহমুদুল হক, রাহাত খান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আবদুল মান্নান সৈয়দ, রশীদ হায়দার, সেলিনা হোসেন, কায়েস আহমেদ, বিপ্রদাশ বড়–য়া প্রমুখ। এদের সম্মিলিত প্রয়াস, সমাজসজ্ঞানতা, শিল্পবোধ এবং আধুনিক সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে উপলব্ধি ছোটগল্পের ভাঁড়ারে জমা করে উজ্জল শস্য। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন সাহিত্যাদর্শের তরঙ্গ এসে পৌঁছায় আমাদের সাহিত্যে। এর প্রভাবে নতুন সময়ের নতুন সাহিত্য নতুন আঙ্গিক ও ভাষাভঙ্গি সহযোগে গল্প লেখেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আবদুল মান্নান সৈয়দ—এমনকি হায়াৎ মামুদও। কিন্তু টালমাটাল রাজনৈতিক প্রবাহ বুদ্ধি ও পুস্তকপাঠে আহৃত সাহিত্যাদর্শকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা নামের পরাবাস্তবতাধর্মী গল্পের ধারা পরবর্তীকালের লেখকদের আদৌ প্রভাবিত করতে পারে নি। নতুন গল্পধারা থেকে একমাত্র আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সরে এসে নিজেকে সচল এবং বিকশিত করতে পেরেছেন। অন্যদের গল্প নিরীক্ষা ফলপ্রসূ হতে পারে নি।
ষাটের গল্পবৈশিষ্ট্য, আঙ্গিক বা লিপিকৌশল, গদ্যভঙ্গী, লেখক-চিন্তা এমনকি পরিপ্রেক্ষিত অবলোকনের সঙ্গে সত্তরের গল্প লেখকদের সাযুজ্য অধিক। ষাটের লেখকদের মতো সত্তরের দশকের গল্পকাররাও মুক্তচিন্তার অধিকারী এবং সমাজসচেতন। এঁরা যে শ্রেণী ও অবস্থানের মানুষ তা তাঁরা তীব্র মনোযোগের সঙ্গে গল্পে তুলে এনেছেন। সমাজের ভাঙ্গন-নির্মাণ, ক্ষয় ও বিকাশ, ম্লানিমা ও বিক্ষোভ, ঘুম ও আলোড়নের বিষয়কে সত্তরের গল্পকাররা গল্পের বিষয় করেছেন। যে দ্বিধা, পিছুটান, অনাগ্রহ, ভয় বিভাগোত্তর লেখকদের ছিল দুই দশক পর ষাটের দশকের লেখকরা তা খারিজ করে দেন। ষাটের নির্মিত এই গল্পের জমিনের উপর দাঁড়িয়ে সত্তরের লেখকরা গল্পের ফসল আরো সজীব করে তোলেন। কুসংস্কার ও অন্ধধর্মানুভূতির প্রতি অকারণ আনুগত্য সত্তরের লেখকদের নেই। আগের দশকের লেখকদের থেকে এই দশকের লেখকরা আধিক সাহসী এবং সচেতন। শাসকদল ও তাদের গৃহীত ব্যবস্থা গল্পে সমালোচনা করতে সত্তরের লেখকরা কার্পণ্য করেন নি। সমাজ ও জীবনের বিষয় সত্তরের গল্পে বহুলাংশে প্রত্যক্ষ, সরাসরি, লক্ষ্যের প্রতি নিক্ষিপ্ত। প্রেরণা ও অভিজ্ঞতা হিসেবে সত্তরের লেখকরা পেয়েছেন এই দশকে সংঘটিত ঘটনাবলী। বাংলাদেশের জন্ম—স্বাধীন সার্বভৌম নিজ দেশের জন্য জল-স্থল-অন্তরীক্ষে সর্বাত্মক মরণপণ যুদ্ধ এবং মানুষের মৃত্যু লেখকদের অভিজ্ঞতায় এনে দিয়েছে গুণগত পরিবর্তন। আবার স্বাধীনতা-পরবর্তী মানুষের আশাভঙ্গ শাসকদলের ব্যর্থতা, দুর্ভিক্ষ, সামরিক অভ্যুত্থান, সামাজিক মেরুকরণ পাল্টে দেয় লেখকচৈতন্য। মানুষের বেহিসেবী চরিত্র ও স্খলনে জন্ম নেওয়া সুবিধাভোগী শ্রেণীর হাতে ক্রমাগত লুণ্ঠিত হয়েছে, আজো হচ্ছে জীবন রসদ। সমাজের একজন সংবেদনশীল সৃজনশীল মানুষ হয়ে লেখককে তাই শরিক হতে হয়েছে প্রতিটি ঘটনার। এর উৎসারণ লক্ষ্য করা যায় সত্তর দশকের গল্পে। আবার মেধা-মনন-রুচির দারুণ ক্ষয় হয়েছে সত্তরের দশকে। এরও প্রভাব পড়েছে সত্তরের গল্পে। রুদ্ধ হতে হতে ব্যক্তি হয়ে পড়ে ক্ষতাক্ত, ক্লেদপূর্ণ। এর কারণ এবং পরিণতি না বোঝার কারণে অনেক স্থ’ুল, জলো, অসার কাহিনী গল্পের মোড়ক পরিয়ে পরিবেশন করেছেন সত্তর দশকের লেখকরা। এর আগে কোনো দশকে এতো সস্তা, চটুল, মধ্যবিত্তের সাধারণ কেচ্ছা লিখিত হয়নি। জনপ্রিয়তার টানে লেখার উপযোগিতা, লেখকের দায়িত্ব কোনো কোনো লেখকের কারণে উপেক্ষিত হয়েছে। শাস্ত্রবদ্ধ বুদ্ধি দিয়ে লেখা সমাজ বাস্তবতার গল্প হয়েছে কেবল লেখকের ইচ্ছাপূরণের কাহিনী। পাঠক মনে তাপ ছড়িয়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে এসব গল্প—নির্দিষ্ট কোনো আলো পৌঁছে দিতে পারে নি। সমাজে শ্রেণী আছে, শ্রেণীদ্বন্দ্ব আছে কিন্তু তা উল্লম্ফনের মাধ্যমে সংঘাতে নিয়ে এবং কাহিনীতে শোষিতের জয় দেখিয়ে লেখকরা বাহবা পেয়েছেন বটে, কিন্তু গল্পের জন্য লেখক শিল্পশর্ত পূরণ করতে পারেন নি।
সত্তর দশকের প্রায় সব লেখক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প লিখেছেন। যুদ্ধদিনের অভিজ্ঞতার চাপ লেখকদের দিয়ে গল্প লিখিয়ে নিয়েছে। তবু সত্তর দশকের কোনো গল্পকারের হাতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শিল্পসফল গল্প লিখিত হয় নি। এই গ্রন্থের পাঠক মনোযোগ দিলে বুঝবেন, সত্তরের লেখকদের এই গল্প সংকলনে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ঘটনা নিয়ে একটিও গল্প নেই। অথচ মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে যে দশকে সেই দশকের লেখদের গল্প নিয়ে এই সংকলন। মুক্তিযুদ্ধের গল্প বাদ রেখে সত্তর দশকের গল্প সংকলন প্রকাশ নিয়ে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন। দুর্বল গল্প স্থান দেওয়ার চেয়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প রচনায় সত্তর দশকের লেখকদের দুর্বলতা প্রকাশ ও স্বীকার করা ন্যায়সঙ্গত। এই সংকলনে আহমদ বশীরের ‘প্রতিপক্ষের পক্ষে’ এবং মঈনুল আহসান সাবেরের ‘ভুল বিকাশ’ গল্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আছে। কিন্তু গল্পের মূল বিষয় যুদ্ধোত্তর নৈরাজ্য।
তবু সত্তর দশকের গল্প বিকাশের পেছনে ক্রিয়া করেছে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে এই ভূখ-ের মানুষের ক্রম-মুক্তি এবং অগ্রগতি ছিল অসম্ভব। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্যের প্রয়োজনে নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল অনিবার্য এবং তা অর্জন করেছে এই জাতি। স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন বিপর্যয়, শাসকগোষ্ঠীর ব্যর্থতা, সামাজিক অস্থিতিশীলতা, গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় অক্ষমতা, উপর্যুপরি সামরিক শাসন তছনছ করে দিয়েছে সমাজকাঠামো এবং মানুষের প্রত্যাশা। তাসত্ত্বেও ঘুরছে সমাজের চাকা। মৌলিক কাঠামোতে কোনো গুণগত পরিবর্তন না এলেও উপর কাঠামোতে এসেছে বিবিধ রদবদল ও সংঘটিত হয়েছে নির্মাণ। তারই সংবাদ, চিত্র নির্যাস পাওয়া যায় সত্তর দশকের গল্পে।
এখন প্রশ্ন, গ্রন্থভুক্ত বাইশ জনই কি সত্তরের দশকের উল্লেখযোগ্য গল্পকার! কোন মানদ-ে বাইশ জনকে নির্বাচিত করা হয়েছে? প্রথমে বলে নেওয়া ভালো—কোনো সংকলনই প্রশ্নমুক্ত নয়। সর্বসম্মত সংকলন প্রকাশ করতে হলে তা আর সুনির্বাচিত থাকে না। কলেবরের কথা তো রয়েছে। তা ছাড়া যে বা যাঁরা সংকলন সম্পাদনার দায়িত্বে থাকেন তাঁর বা তাঁদের চিন্তা ও মনোনয়ন লেখা নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রশ্রয় পেয়ে থাকে। সম্পাদকের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সব লেখক ও পাঠকের ঐক্য হওয়া সম্ভব নয়। সত্তর দশকের সমুদয় বৈশিষ্ট্য এবং গতিপ্রকৃতির পরিচয় পাঠক সমীপে দাখিল করা যেতে পারে—এমন লক্ষ্য থেকে বাছাই করে বাইশ জনের গল্পগ্রন্থে নেওয়া হয়েছে। লেখকদের যে গল্প অন্য কোনো সংকলনে মুদ্রিত হয়েছে সেটি এই সংকলনে স্থান পায় নি। সত্তর দশকের কেনো কোনো কবিও ছোটগল্প গ্রন্থে লিখেছেন। সাহিত্যচর্চায় তাঁদের প্রধান পরিচয় কবি। এই-কারণে কবিদের লেখা ছোটগল্প গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
সত্তর দশকের গল্পকার সবাই সমসাময়িক লেখক। আগে-পরের লেখক নির্ণয় করা দুঃসাধ্য কাজ। একের সঙ্গে অন্যেও বয়সে সামান্য পার্থক্য থাকলেও একজনের পাশ থেকে উঠে এসেছেন আরেকজন। বুলবুল চৌধুরী, হুমায়ুন আহমেদ, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, শাহরিয়ার কবির, তাপস মজুমদার, আফসান চৌধুরী, বারেক আব্দুল্লাহ একই সময়ের লেখক। জাফর তালুকদার, মুস্তাফা পান্না, আতা সরকার, মঞ্জু সরকার এক সময়ের লেখক। এদের কাছাকাছি সময়ে গল্প লিখতে শুরু করেন হরিপদ দত্ত, আবু সাঈদ জুবেরী, সৈয়দ ইকবাল, আহমদ বশীর, ইমদাদুল হক মিলন। এরপরই সুশান্ত মজুমদার, সৈয়দ কামরুল হাসান, মঈনুল আহসান সাবের, সারোয়ার কবীর, ইসহাক খান। নকিব ফিরোজ সত্তর দশকের অনুজ গল্পকার। বয়সের তারতম্য হলেও সক্রিয় সাহিত্যচর্চায় সত্তরের লেককদের আগ-পিছ আছে। সম্পূর্ণ সঠিকভাবে কে কখন, কে কার আগে গল্প লিখতে শুরু করেছেন— এটা নির্দিষ্ট করতে হলে আমাদের আরো দিন অপেক্ষা করতে হবে। দেখা যায়, কনিষ্ঠ লেখক শক্তিমান হলে জ্যেষ্ঠ লেখককে সরিয়ে সামনে চলে যান। তাই সহজ সুবিধা বিবেচনা করে গ্রন্থটির সূচীপত্র লেখকদের নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী ধার্য করা হয়েছে।
গ্রন্থের গল্পগুলি সম্পাদকের নির্বাচিত। গল্পকাররা তাঁদের গল্প সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে সহযোগিতা করেছেন। গ্রন্থের সম্পাদনার দায়িত্ব বাংলা একাডেমীর পক্ষে উপপরিচালক কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন আমার মতো একজন তরুণকে দেওয়ায় তাঁকে ধন্যবাদ। পাণ্ডলিপি প্রণয়নে পরামর্শ ও মতামত দিয়েছেন দুই অগ্রজ কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান ও শওকত আলী। প্রত্যাশিত একটি গল্প সংগ্রহ করে দিয়েছেন কথাসাহিত্যক কায়েস আহমেদ। গল্পগুলির ফটোকপি করে দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সম্পাদক ও কবি আনওয়ার আহমদ। সত্তরের যে সব লেখকের আজো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি তাঁদের মুদ্রিত গল্প ‘গণসাহিত্য’ ‘রূপম’ ‘বিনিময়’ ‘বিপক্ষে’ সাহিত্য পত্রিকা থেকে নেওয়া হয়েছে।
পুনর্মুদ্রিত: বাংলাদেশের গল্প: সত্তরের দশক (সুশান্ত মজুমদার সম্পা.), বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯২