হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর বারবার আক্রমণ: দায় কার?

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুলাই ২১, ২০২২

বাংলাদেশে বহুদিন ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির আক্রমণ, মন্দির ভাঙচুর; বাড়িঘর আক্রমণ ইত্যাদি চলছেই। ঘটনার একটার রেশ কাটতে না কাটতে আর একটা ঘটনা এসে হাজির হচ্ছে। বাংলাদেশের কিছু তথাকথিত ব্যক্তিত্ব সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টাকে সাম্প্রদায়িক বানানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু কখনো তারা এসব ঘটনায় সরকার বা প্রশাসনের কথা বলছেন না। ঘটনা যার দ্বারাই ঘটুক না কেন, রাষ্ট্র এবং সরকারের দায়িত্ব প্রতিটি জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে যখন এরকম ঘটনা মাঝে মধ্যেই ঘটছে, তখন তা প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি সরকারের মাথায় থাকার কথা। যখন প্রথমবার বাবরি মসজিদের ঘটনায় বিভিন্ন প্রদেশে দাঙ্গা দেখা দিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গে তেমন কিছু ঘটতে পারেনি। কারণ পশ্চিমবঙ্গের জ্যোতি বসুর সরকার আগেই দাঙ্গা না লাগার মতো ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছিলেন। এটাকেই বলে দূরদৃষ্টি। আর তা আসে সততা আর দায়িত্ববোধ থেকে। সাতচল্লিশের পর জওহললাল নেহরুর আন্তরিকতার কারণেই তার ক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত দাঙ্গার তেমন কোনো ঘটনা নেই। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর বছর থেকেই ভারতে আরম্ভ হয় ঘন ঘন দাঙ্গা। ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল নাগাদ বিশ বছরে দাঙ্গার সংখ্যা সরকারী হিসেবে পাঁচ হাজারের মতো। ফলে এসব ঘটনা ঘটা এবং না ঘটায় সরকারের বিরাট ভূমিকা আছে। ভোটের বাক্স দখলে রাখতে চাইলে জনবিচ্ছিন্ন সরকারগুলোকে বহু ব্যাপারে চোখকান বন্ধ করে থাকতে হয়। বহু সময় দাঙ্গাকে উস্কাতে হয়। জওহরলাল নেহরুর পরবর্তী কংগ্রসীরা দাঙ্গা নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে, বিশেষ করে রাজীব গান্ধী বাবরি মসজিদ নিয়ে রাজনীতির খেলা খেলতে গিয়ে অন্যদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে জ্যোতি বসু বলেছিলেন প্রশাসন না চাইলে দাঙ্গা বা এধরনের আক্রমণের ঘটনা ঘটতে পারে না। প্রশাসন সরকারের দ্বারাই পরিচালিত হয়। জ্যোতি বসু তাঁর বক্তব্যটি দিয়েছিলেন পূর্বের নানা অভিজ্ঞতা থেকে। ইতিহাসে দেখা গেছে, যারা এসব ঘটনা ঘটায় তারা সঙ্গে সঙ্গে এর দায় অন্যের ঘাড়ে চাপাতে চেষ্টা করে। সাধারণ মানুষও বহুকাল পর্যন্ত ভুল ধারণা নিয়ে বসে থাকে। নির্দোষ মানুষদের দোষী ভেবে তাদের শত্রু মনে করে বসে থাকে। তাতে লাভ হয় আসল দুষ্কৃতীদের। নির্দোষ দুটি পক্ষের মধ্যে বিরোধ লাগিয়ে দিয়ে কুচক্রীরা তখন নানা অপকর্ম করে বেড়ায় নিজেদের স্বার্থে।

ভারতের প্রথম দিকের প্রধান হিন্দু মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গাগুলোর জন্য দায়ী করা হয়েছিল যাদেরকে, পরে গবেষণায় দেখা গেছে তারা আসলে দায়ী ছিল না। দায়ী ছিল ভিন্ন পক্ষ। ছেচল্লিশের দাঙ্গা আর সাতচল্লিশের দাঙ্গা সম্পর্কে বহু নতুন কথা উঠে এসেছে অনেক ভারতীয়দের গবেষণায়। বাংলা ভাগের লেখক জয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, সহ বহু ভারতীয় গবেষক নানা দলিলপত্র সহ প্রমাণ করেছেন দাঙ্গার জন্য প্রধানত দায়ী ছিল হিন্দু মহাসভা আর সঙ্গে যুক্ত  অন্যান্যরা।। যশোবন্ত সিংহ, উৎপল দত্ত , মওলানা আজাদ সহ আরো কিছু ব্যক্তির লেখা বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট হয়,  সাতচল্লিশের দাঙ্গা ঘটাবার পেছনে সবচেয়ে বড় দায় ভাইসরয় মাউন্ট ব্যাটেনের। খুব ঠাণ্ডা মাথায় তিনি সেটা ঘটান। ভারত পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে যে বিতর্ক তার প্রধান ইন্ধনদাতা মাউন্ট ব্যাটেন। মাউন্ট ব্যাটেন ভারত এবং পাকিস্তানে যে দুজন জেনারেলকে নিয়োগ দিয়েছিলেন, এটা তাদের কারসাজি। ভারতীয়দের কিছু কিছু লেখায় দেখা যায়, কাশ্মীর আক্রমণের চক্রান্ত ছিল পাকিস্তান পক্ষের ব্রিটিশ জেনারেলের। খুব আনন্দের কথা হলো, ধীরে ধীরে হলেও ইতিহাসের জট খুলছে। আর এসব গবেষণার ক্ষেত্রে পুরো অবদানটাই ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানীদের। বাংলাদেশের গবেষকদের অবদান নেই বললেই চলে।

মওলানা আজাদ, যশোবন্ত সিংহ, উৎপল দত্ত প্রমুখ দেখিয়েছেন মাউন্ট ব্যাটেন চাইলেই দাঙ্গার ঘটনাকে প্রতিরোধ করা যেতো। কিন্তু মাউন্ট ব্যাটেন দাঙ্গাই চেয়েছেন। কারণ তিনি এর ভিতর দিয়ে বিশ্ববাসীকে বোঝাতে চেয়েছেন যে, দ্যাখো-ভারতীয়রা কতোটা নৃশংস আর বর্বর। ব্রিটিশ শাসন এখানে কেন দরকার ছিল। ব্রিটিশরা থাকার কারণেই দেশটাতে শান্তি শৃঙ্খলা ছিল। ব্রিটিশ চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয়দের বর্বরতার আসল চেহারা বের হয়ে এসেছে, এসব প্রচার করা ছিল তার উদ্দেশ্য। জ্যোতি বসু সম্ভবত এখান থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন, রাষ্ট্রের প্রশাসন না চাইলে দাঙ্গা হতে পারে না। কথাটা তিনি ঠিকই বলেছেন তা নিয়ে সন্দেহের কিছু নেই। কিন্তু তার আগে আর একটা কথা থাকে, প্রশাসন চালায়  যে সরকার তার ভূমিকাটা কী? সরকার কী চাইছে সেটাও বড় একটা প্রশ্ন।

বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ দাঙ্গাবাজ, সাম্প্রদায়িক এ রকম বক্তব্য আমি কখনো বিশ্বাস করি না। সাধারণ মানুষের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, দাঙ্গার রাজনীতি করার সময় কোথায় তাদের? শিক্ষিতদের এক বড় অংশই সাম্প্রদায়িক নন। বরং এসবের বিরুদ্ধে। বিশ্বের সব দেশের ক্ষেত্রেই এ কথা সমানভাবে সত্য।  বাংলাদেশে যখন পাকবাহিনীর আক্রমণ হয় পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ কি এসবের মধ্যে ছিল? প্রশ্নই ওঠে না। কারণ পাক জনগণই পাক সামরিক জান্তার নির্যাতন আর শোষণের শিকার ছিল। ভারতের মানুষ একটি হিন্দুত্ববাদী দলকে ভোট দিয়েছে বলে কি ধরে নেবো তারা সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছে? রবীন্দ্রনাথ অনেক হিসেব করেই বলেছিলেন, মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। সাধারণ মানুষের উপর বিশ্বাস হারালে আর রইলো কে? ভারতে গরুর মাংস খাওয়ার জন্য মুসলমানকে যে হত্যা করলো সে যদি হিন্দু হয়, সেই হত্যার বিরুদ্ধে যে বিরাট জনতা প্রতিবাদ করেছে তারাও হিন্দু। কী করে তাহলে ভারতের সকল মানুষকে আপনি সাম্প্রদায়িক বলবেন? জনগণ বা বিরাট একটা সম্প্রদায়ের উপর তকমা লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে কিছু স্বার্থান্বেষীদের একটা চক্রান্ত। ভারতে যখন গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগ তুলে হত্যাকাণ্ড ঘটে, তখন আমি মহারাষ্ট্রের শিক্ষার্থীদের দেখেছি তার বিরুদ্ধে মানববন্ধন করতে। তারা কী করে মুসলমানদের শত্রু হয়? কিন্তু একদল লোক সর্বদা এটা প্রচারে ব্যস্ত যে, ভারতের সকল হিন্দুরা মুসলমান বিরোধী; বাংলাদেশের সব মুসলমানরা হিন্দু বিরোধী। কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের ভয়াবহ চক্রান্ত এটা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দুই বাংলার মানুষের মধ্যে চমৎকার একটা সম্পর্ক হচ্ছিল। কবি সাহিত্যিক চলচ্চিত্রকার মধ্যে যোগাযোগ, মতের আদান প্রদান চলছিল। দুই বাংলার নাটকের দলগুলো নানারকম নাট্য উৎসবে যোগদান করতে আরম্ভ করে। দুই বাংলার মানুষের মধ্যেকার এই গভীর সম্পর্ক অনেকের পছন্দ হলো না। বাংলা সম্পর্কে অনেকের ভীতি ছিল অনেক আগে থেকে। কারণ প্রায় সব বড় বড় মনীষী, শিল্পী সাহিত্যিকদের জন্ম বাংলায়। বাংলাকে ভাঙ্গার চেষ্টা হয়েছিল তাই সেই উনিশশো পাঁচ সালে। পরে নানা ষড়যন্ত্রে ভেঙ্গেই গেল সাতচল্লিশে। বাংলা না ভাঙ্গলে বাংলাই হবার সম্ভাবনা ছিল ভারতের রাষ্ট্রভাষা। যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দুই বাংলার মধ্যে মাখামাখি আরম্ভ হলো, শুরু হলো নতুন  ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশের  রাষ্ট্রধর্ম করা হলো ইসলাম। যাতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বাংলাদেশের মানুষকে আর বাঙালী না ভেবে মুসলমান ভাবতে শুরু করে। সে ষড়যন্ত্র  সার্থকই হয়েছে বলা যায়। দুই বাংলার মানুষ ছিল ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে গিয়ে বাঙালী, নব্বইয়ের দশক হতে আরম্ভ হলো নতুন পরিচয় হিন্দু মুসলমান। এ ক্ষেত্রে দুই বাংলার বিদগ্ধ সমাজের আছে বিশাল ব্যর্থতা। সঙ্কটের মূল জায়গায় দৃষ্টি না ফেলে দুপক্ষই নানারকম সস্তা শ্লোগান দিয়েছিলেন। যার ফলে দিনে দিনে সঙ্কট বেড়েছে। যদি এ মুহূর্তে এসেও সচেতন না হওয়া যায়, ভবিষ্যতে ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়াবে।

হিন্দু মুসলমান, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, এগুলো সব সস্তা কথাবার্তা।  মানুষের দরকার বাক-স্বাধীনতা, জীবনযাপনের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক মুক্তি, স্বাস্থ্য  শিক্ষা কর্মসংস্থান বাসস্থানের নিরাপত্তা।   `সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি`-এটা একটা ধোঁয়াশে কথাবার্তা। কথার ফানুস, সেই  সেলিম আল দীনের নাটক "জন্ডিজ ও বিবিধ বেলুন"-এর মতো। গত দু হাজার বিশ সালে করোনার মধ্যে পাশ্চাত্যের মানুষের লেখা দু দুটো মহাযুদ্ধ, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, ইউরোপের নবজাগৃতি, ফরাসী বিপ্লব, চীন, ভিয়েতনামের বিপ্লব, ইত্যাদি নিয়ে অসংখ বই পাঠ করি, কিন্তু "সাম্প্রদায়িক" বা কম্যুনাল এরকম শব্দ একবারও পাইনি। ভাবলাম হিটলারের ইহুদি নিধন সম্পর্কে পাঠ করে দেখি। দেখলাম শব্দটা সেখানেও নেই।  হিটলারের ইহুদি নিধনকে বলা হয়েছে নৃশংসতা, মানবতাবাদের বিরুদ্ধে অপরাধ। কথাটা সঠিক বলা হয়েছে, যে সম্প্রদায়ের উপরেই নির্যাতন হোক সেটা মানবতাবাদের বিরুদ্ধেই  অপরাধ। সাম্প্রদায়িকতা নয়। হিটলারের অপরাধের দায় সকল খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে নিতে হবে কেন? যা কিছু মানুষ নিজ স্বার্থে করে, তার অপরাধ একটা পুরো সম্প্রদায়কে নিতে হবে কেন? যখন হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ হয় বাংলাদেশে মুসলমান সম্প্রদায় কি তার প্রতিবাদ করে না? বাংলাদেশের বাম রাজনৈতিক দলের কর্মী সহ বহু রাজনৈতিক দল কি তখন মাঠে নামছে না? সাংবাদিকরা কি তার বিরুদ্ধে লেখেলেখি করছে না। যদি কিছু সংখ্যক মুসলমান আক্রমণকারী হয়, তার চেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলমান কি ঘৃণা প্রকাশ করছে না?

কথাটা হলো আক্রমণকারী যেই হোক রাষ্ট্র এবং সরকারের ভূমিকাটা কী। সরকার বহুদিন ধরে বিভিন্ন দলের সভা সমিতি করা বন্ধ রাখতে পারে, তাদের আন্দোলন করা বন্ধ রাখতে পারে; কিন্তু এই সব হামলাকারীদের চিহ্নিত করতে পারে না সেটাই কি বিশ্বাস করতে হবে? বাংলাদেশে কখনো এসব ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীদের বিচার হতে দেখা যায়নি। কারো আমলেই না। বরং উধোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে দেখা গেছে। সেই ক্ষেত্রে মিথ্যা দোষারোপ বন্ধ করে প্রকৃত সত্য খুঁজে বের করতে হবে। কারণ এসব আক্রমণে, শেষ বিচারে প্রতিটি জনগণ ভুক্তভোগী হচ্ছে। নির্দোষ হয়েও বৃহত্তর একটা জনগোষ্ঠী এবং একটা রাষ্ট্রকে এর দায়ভার নিতে হচ্ছে। কিছু লোভী মানুষের, কিছু ক্ষমতাধর মানুষের দায়ভার কেন জনগণ নেবে? জনগণ উদয় আস্ত পরিশ্রম করে পুরো রাষ্ট্রের মানুষকে বাঁচিয়ে রাখছে, তাকেই কিনা চক্রান্ত করে এসব ঘটনার খলনায়ক বানাতে চাওয়া হচ্ছে ! অনেক গবেষক দেখিয়েছেন, এসব দাঙ্গা বা আক্রমণ ঘটে ভোটবাক্সকে ঘিরে। মানুষের সামনে এসব ঘটনার ভিতর দিয়েই ঠগবাজ রাজনীতিকরা এমন এক গল্প তৈরি করে আর সেখানে নিজে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় নিজবাক্সের ভোট বাড়াবার জন্য। জটিল এসব সমীকরণ না বুঝলে এ সঙ্কট থেকে উদ্ধারের পথ নেই। কিন্তু এটা তো ঠিক, জনগণের নিরাপত্তা দেয়ার দায় সরকারের। কিন্তু কোনদিনই কোনো সরকার এর দায় গ্রহণ করেনি। বরং অন্যদের উপর দোষ চাপাতে চেয়েছে। বাংলাদেশে এসব খেলার বলি হয়েছে সম্পূর্ণ নিরীহ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষরা।

বুঝতে পারি না, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ কেন অকারণে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলতে যাবে? কী তাদের স্বার্থ?  যদি দু চারজন বলেও থাকে, তার দায় পুরো জনগোষ্ঠী নেবে কেন? যদি ধরে নিলাম, ধর্মকে আক্রমণ করা হয়েছে, সেজন্য বিচার ব্যবস্থা আছে। বিচারের মুখোমুখি করা হোক তাদের। বাংলাদেশে এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই,  অনেক সামাজিক ক্ষেত্রেই  সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষিত হয় না। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রশ্ন তুলে যদি সবক্ষেত্রে অন্য ধর্মালম্বীদের অধিকার দলন করা হয়, সেক্ষেত্রে যেখানে অন্য ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগুরু, সেখানে যদি মুসলমানদের অধিকার হরণ করা হয়, মুসলমানদের ভালো লাগবে? মুসলমানরা অনেক সময় তাদের ধর্মের উপর আক্রমণের ব্যাপারে স্পর্শকাতর, কিন্তু বাংলাদেশে অনেক ইসলামী জমায়তে বা গ্রামের মাহফিলে বৈদিক ধর্মের দেবদেবীদের অশ্লীলভাবে আক্রমণ করা হয়। সেটা নিয়ে আমরা সোচ্চার হচ্ছি না কেন? সরকার বা প্রশাসন সেই সব অপরাধীদের  শাস্তি দিচ্ছে না কেন? সামগ্রিকভাবে সমাজবিজ্ঞানের  দৃষ্টিতে ধর্মের চুলচেরা বিশ্লষণ আর বিশেষ একটি ধর্মকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আক্রমণ; দুটো ভিন্ন ঘটনা। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশে সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্বার্থ রক্ষা করা মুসলমানদেরই দায়িত্ব। ইসলামের নবীর নির্দেশ এটা। খুশির খবর এই যে, বহু ইসলাম ধর্মের আলেম এ ব্যাপারে একমত। তাঁরা মনে করেন বাংলাদেশে অন্য ধর্মের হেফাজত করা মুসলমানদের দায়িত্ব।  

বাংলাদেশের কিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বলেছেন, যতোই আক্রমণ হোক, এ ভূখণ্ড ছেড়ে তাঁরা যাবেন না। আমি এ ধরনের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই আর তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করি। সবসময় এধরনের ইতিবাচক চিন্তার পাশেই থাকবো। সবকিছুর পর এটাই সত্যি, আমরা এ ভূখণ্ডের যারা নাগরিক, কেন আমরা আমাদের অধিকার ছেড়ে চলে যাবো? বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য  সকল সম্প্রদায়ের অবদান আছে, এর বিকাশ আর উন্নয়নে সবার দান আছে। তাই কারা আমাদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে চায় সে ব্যাপারেও সচেতন থাকতে হবে। নিজেদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি করে, নিজেদের মধ্যে বিভেদ পুষে আমরা সঙ্কটের সমাধান করতে পারবো না। সঙ্কট তাতে বাড়বে, কুচক্রীদের তখন এসব অপকর্ম চালাতে সুবিধা হবে। ফলে জনগণের নিরাপত্তা দানের দায়িত্ব যেহেতু সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের সরকারের, তাদেরকেই প্রথম প্রশ্ন রাখতে চাই, এসব আর কতদিন চলবে? সরকার তার প্রশাসন আর গোয়েন্দাদের কাজ লাগাক তা বন্ধ করার জন্য। যদি না পারে, দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। সে যে দলেরই সরকার হোক। মানুষের নিরাপত্তা দিতে না পারা সরকারের ব্যর্থতা।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ