আমার বন্ধু শবনম

উপন্যাস ৫

জাকির তালুকদার

প্রকাশিত : আগস্ট ২২, ২০২০

আমাকে রিকশা থেকে নামতে দেখেই এক দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে এলো শবনম। এতটাই জোরে দৌড়েছে যে, মনে হচ্ছিল উড়ে আসছে। রাস্তার দুইদিকে ছুটে চলা কোনো গাড়ির সাথে যে ধাক্কা খায়নি, তা বোধহয় কপালজোরে। আমি মৃদু ধমকের সুরে বলি, এভাবে কেউ রাস্তা পার হয়? যদি কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হতো?

আমার কথা যেন শুনতেই পায়নি শবনম। চেহারাভর্তি উদ্বেগ নিয়ে জিগ্যেস করে, কী হইছিল আপনের? তিনদিন কুনো খবর নাই। আসেন নাই। আবার আপনেরে ফোন দিলে কয় ফোন বন্ধ। কতবার যে ফোন দিছি!
আমি বসার জায়গা খুঁজতে খুঁজতে বলি, ও কিছু না। মাঝে মাঝে আমি এমনিতেই বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে রাখি।
শবনম এবার বোধহয় একটু রেগে যায়। বলে, এইডা কেমুন কথা! আমি চিন্তায় মরি!

অনুভব করি, মিথ্যা বলছে না শবনম। মধ্যবিত্ত নারী-পুরুষদের মতো মিথ্যা বলার তো কোনো দরকার নেই তার। আবার প্রশ্ন করে, সত্যি কইরা কন। কুনো অসুখ-বিসুখ হইছিল?
না।
তাইলে?
বলি, ঐ যে বললাম। আমি মাঝে মাঝে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। পুরনো অভ্যেস।
শবনম বলে, তা থাকেন। কিন্তু আমারে একবার খবর দিয়া তারপরে তিনদিন ক্যান তিনমাস থাকলেও তো অসুবিদা আছিল না। আমার তো ঘুম-খাওয়া বন্দো হয়া গেছিল।

বলি, স্যরি শবনম। আমি বুঝতে পারিনি তোমার এতটা কষ্ট হবে। মানে কারো জন্য কেউ যে সত্যিসত্যি কষ্ট পায় তা আমাদের বিশ্বাস থেকে উঠে গেছে তো। আমাদের সমাজে দরকার ছাড়া কেউ কাউকে খোঁজে না।
ঝাঁঝিয়ে ওঠে শবনম, আমি তো আপনাগো লাহান মানুষ না। ভদ্দরলোকের ঝি না।
ঠিক। সেইজন্যই তো তোমার সাথে গল্প করতে আসি। গল্প না করলেও চুপচাপ বসে থাকতে আসি।
তাইলে আমার সাথেও একই রকম ব্যবহার করলেন ক্যান?
কোনো অজুহাত দিই না। বলি, ভুল হয়ে গেছে শবনম। আর কখনো এমন হবে না।

শবনম কোনো কথা বলে না। তার দৃষ্টি আমাকে পাশ কাটিয়ে দূরে অনির্দিষ্টতার দিকে লেপ্টে থাকে। আমি বলি, বিশ্বাস করলে না?
করলাম।
হাঁটতে হাঁটতে ফুচকার স্টলটা পেরিয়ে যাওয়ার সময় আমি শবনমের হাত ধরে টানি। তিনটা বেঞ্চি সাজানো। একটাতে বসা যায় দুইজন বা তিনজন। একটা বেঞ্চি খালি। অন্য দুটোতে বসে আছি দুইজোড়া তরুণ-তরুণী। শবনম ইতস্তত করে। আমি পরোয়া করি না। খালি বেঞ্চিটাতে বসি তাকে নিয়ে। অদ্ভুত ব্যাপার। শবনমকে দেখে অন্য দুই যুগল ঝটপট খাওয়া সেরে উঠে যায়। ওরা কীভাবে চিনতে পারে শবনমদের? আর চিনলেও বা কেন এইভাবে উঠে যেতে হবে? একজোড়া ছেলেমেয়ে তো ফুচকার পাশাপাশি জ্বলন্ত সিগারেটও হাতে ধরে আছে। হয়তো খোঁজ নিলে দেখা যাবে ওরা সবাই ফেসবুকে খুব বিপ্লবী কথাবার্তা লেখে। ফুচকার দোকানদার আমাদের দেখে ইতস্তত করে। কিছু বলতে চায়। কিন্তু আমি কড়া চোখে তাকালে সে গিলে ফেলে বেরিয়ে আসতে চাওয়া কথাগুলো। শবনম ফুচকা খাবে। তার জন্য ফুচকা আর নিজের জন্য চটপটির অর্ডার দিয়ে বলি, ধীরে সুস্থে খাবে। উঠে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করবে না।

শবনমও বোধহয় একটু মজা পাচ্ছে। সে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। জিগ্যেস করে, তা কী করলেন এই তিনদিন?
নিজের বিচার করলাম।
হেইডা আবার কী?
অতীত ঘেঁটে দেখলাম কত কত অন্যায় করেছি আমি। সেগুলো নিয়ে ভাবলাম। সওয়াল-জবাব করলাম। নিজেই আসামি, নিজেই উকিল, নিজেই বিচারক।
তারপর?
দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে আসে আমার, এখনো অনেক প্রায়শ্চিত্তই বাকি আছে শবনম।      
দোকানদার খুব ঝটপট ফুচকা আর চটপটির প্লেট এগিয়ে দেয় আমাদের দিকে। সে-ও আপদ বিদায় করতে চাইছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। মনে মনে হাসি। প্লেটটা পাশে রেখে পকেট থেকে সিগারেট বের করে আয়েশি ভঙ্গিতে ধরাই।
 
শবনম জানতে চায়, আচ্ছা আপনে তো আমার লাহান কুনো মাগির লগে আকাম-কুকাম করেন নাই কুনোদিন। কিন্তু বউ ছাড়া অন্য কুনো ভদ্দরলোক মাইয়ার লগে পিরিত-টিরিত করছেন?
শবনম আর আমি পরস্পরকে যে কোনো প্রশ্ন করতে পারি। উত্তরটাও হয় সবসময় সত্যি। আমাদের বন্ধুত্বটাই বোধহয় দাঁড়িয়ে আছে কখনো মিথ্যা কথা না বলা বা মিথ্যা আচরণ না করার ওপরে। আমি এটাও জানি যদি বলি যে আমি অনেক মেয়ের সাথে পরকীয়া করেছি তা শুনেও আমাকে খারাপ ভাববে না শবনম। কিন্তু এই মুহূর্তে সংস্কার থেকে বের হওয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। রবীন্দ্রনাথের মতো বলতে পারি না ‘মন দেয়া-নেয়া অনেক করেছি মরেছি হাজার মরণে’। কিন্তু উত্তর তো দিতেই হবে। মরিয়া হয়ে নিজেকে দাঁড় করাই সত্যের সামনে। বলি, হ্যাঁ।
 
শবনম আবার প্রশ্ন করে, কয়জনার লগে?
একজন।
ফিক করে হাসে শবনম, আপনে কুনো কামেরই না। খালি একজন! ব্যাডাবেডিরা তো শুনি ডজন ডজন করে। তা সেই একজনার লগে পিরিত কি আছে এখনো?
না।
ছাড়াছাড়ি হইল ক্যান?
মিথ্যা বলা আর মিথ্যা আচরণের জন্য।
কে মিথ্যা কইছিল? আপনে?
বিষণ্ণ মাথা নাড়ি, দুইজনাই।
আপনের বউ জানে?
জেনেছে। পরে।
তারপরে কী হইল? বউ আপনেরে ধাতানি দেয় নাই?
 
আমার মনটা এবার যেন অবশ হয়ে আসে সেই দিনগুলোর কথা মনে করে। বলি, বউ পাথর হয়ে গিয়েছিল। সে কোনো প্রত্যক্ষ শাস্তি দেয়নি আমাকে। শাস্তি যা দেবার তা আমি দিয়েছি নিজেকে। এখনো দিয়েই যাচ্ছি।
শবনম বলে, বউ বোধহয় মাফ কইরা দিছে আপনেরে। সব বউরাই হেইডাই করে।
কিন্তু আমি তো জানি, কেউ এই ব্যাপারে মাফ করে না কাউকে কখনো। বউরাও করে না। স্বামীরাও না। চলবে