আশিকুজ্জামান টুলু

আশিকুজ্জামান টুলু

আশিকুজ্জামান টুলুর স্মৃতিগদ্য ‘বদলে যাওয়া সময়’

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৪, ২০২১

ক্লাস টেনে পড়ি। গিটার শেখার তিন বছর হয়ে গেছে। সারাদিন গিয়ে শ্রুতি স্টুডিওর জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিনেমার গান রেকর্ডিংয়ের আগে রিহারসেলটা দেখি। তখন অ্যাকস্টিক গিটার বাজাই। ওই সময় সিনেমার রেকর্ডিংয়ে অ্যাকস্টিক গিটার বাজাতেন ইশতিয়াক ভাই। ওনাকে আমি বেশি খেয়াল করতাম. কিভাবে বাজাচ্ছে উনি। এরকম দেখতে দেখতে খুব ইচ্ছা হলো, সিনেমার গানে অ্যাকস্টিক গিটার বাজাতে। বড় ভাইকে এসে বললাম। বড়ভাই একজন মিউজিক ডিরেক্টরের সাথে আমার অ্যাপোয়েন্টমেন্ট করে দিলেন। আমি আমার তিন হাজার টাকা দিয়ে সুর নিকেতন থেকে কেনা অ্যাকস্টিক গিটারটা নিয়ে পৌঁছে গেলাম শ্রুতিতে অডিশন দিতে। খুব নার্ভাস অবস্থায় অডিশন দিলাম, বাজানো তেমন ভালো হলো না। যা আমি নিজেই বুঝলাম। আমার অডিশন নেয়ার পর মিউজিক ডিরেক্টর বললেন, উনি ডাকবেন আমাকে সময়মতো। ফিরে এসে অপেক্ষা করলাম উনার ডাকের। কিন্তু ডাক এলো না। দেখতে দেখতে প্রায় বছর দুয়েক কেটে গেল।

এরই মধ্যে আমি বেজ গিটার ধরে ফেলেছি। কিছু প্রোগ্রামের এক্সপেরিয়েন্স ঝুলিতে জমা হয়েছে। একদিন মরহুম পিলু মমতাজ আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং উনার সাথে লাইভ শোতে বাজাতে বললেন। আমি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম। মনে মনে সবসময় পিলু আপাকে খুব পছন্দ করতাম দূরে থেকে। উনি যে আমাকে ডেকে পাঠাবেন, সেটা ছিল আমার স্বপ্নের অতীত। আমি তখনও স্টেজে প্রফেশনাল কারো সাথে বাজাইনি। একেবারে আনকোরা নতুন বেজ গিটারিস্ট। ওনার সুযোগটা পেয়ে অসম্ভব ভালো লাগলো। শোয়ের পরদিন উনি যখন পেমেন্টের খামটা আমার হাতে দিলেন ওনার বাসায়, আমি লজ্জায় খুলতে পারিনি উনার সামনে। পকেটে ঢুকিয়ে চলে এসেছিলাম। বাসায় এসে খামটা খুলে ভূত দেখার মতো চমকে গিয়েছিলাম। খামটার মধ্যে তিন হাজার টাকা ছিল। আমি তখন খুব বেশি হলে স্টেজ প্রোগ্রামে এক হাজার টাকা এক্সপেক্ট করেছিলাম। তিন হাজার টাকা আমার জন্য একটু বেশি ছিল। পিলু আপার প্রতি ভালোলাগাটা ওই মুহূর্তে আকাশ ছুঁয়েছিল। তবে সেটা মোটেও টাকার অংকের জন্য নয়, বরং উনি সিনিয়র মিউজিসিয়ান, যারা উনার সাথে ওই শোতে বাজিয়েছিল, খুব সম্ভবত তাদেরকে যা পেমেন্ট করেছিলেন, আমাকেও একই পেমেন্ট করছিলাম। সেই কারণেই খুব ভালো লেগছিল বিষয়টা।

পিলু আপার সাথে বাজানোর পর থেকে আরও কয়েকজন প্রফেশনাল সিংগারের কাছ থেকে বাজানোর অফার পেলাম এবং বাজাতে শুরু করে দিলাম। এই রকম একটা অবস্থায় একদিন ওই মিউজিক ডিরেক্টর আমাকে ডেকে পাঠালেন যার কাছে আমি প্রথম অডিশন দিয়ে নিজগুণে ফেল করেছিলাম। যাওয়ার পর সোজাসুজি উনার রেকর্ডিঙে বাজাতে বললেন। বাজালাম। ওনার খুব পছন্দ হলো আমার বাজনা এবং এরপর থেকে উনার গানে আমি পার্মানেন্ট মিউজিসিয়ান হয়ে গেলাম। একপর্যায়ে উনি গানের কর্ডও আমাকে দিয়ে অ্যারেঞ্জ করাতে শুরু করলেন। ওই সময়ে একটা শিক্ষা হলো আমার, ভালো কারও কাছে অডিশনে পাশ করতে হলে তার আগে অন্য আরেকজনের কাছে পাশ করে অথবা কাজ করে আসতে হবে। সাথে মনের কোনো একটা জায়গায় খুব সুন্দর একটা ফিলিং হলো। সেই ফিলিংটা একটা আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি করলো। যে আত্মবিশ্বাস আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করলো এবং অবশেষে আমি এগিয়ে গেলাম। একটা কথা ভেবে খুব ভালো লাগলো, যার কাছে ফেল করেছিলাম, অবশেষে তিনিই আমাকে জিপিএ ফাইভ দিয়েছেন। ইতিবাচকভাবে বললে একেই বলে, বদলে যাওয়া সময়।

প্রতিটা মানুষের জীবনেই একেক সময়ে একেক ভূত চাপে। আমার মাথাতেও নতুন ভূত চাপলো ২০১৭ তে। ভূতটা হলো, সিনেমা বানাবো নিজের গল্প দিয়ে। যেই ভাবা সেই কাজ। ২০১৯ এ ঢাকায় গিয়ে কাজ শুরু করতে চাইলাম। আমার প্রোডিউসার আমাকে সিনেমা বানানোর পুরো টাকাটাই হাতে তুলে দিলো। আমি একে ধরি, ওকে ধরি, কী করতে হয়, কিভাবে করতে হয়, কিছুই জানি না। একজনের সাহায্যে সিনেমার মূল পুরুষ চরিত্রের সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু উনি রাজি হলেন না। মেয়ে চরিত্রেও একজনকে ভেবেছিলাম, উনিও উনার ব্যস্ততার কারণে আমার স্ক্রিপ্টটা পড়ে দেখার সময় পেলেন না। চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝলাম, দিল্লি অনেক দূর। ওই সময়ে আমি মিউজিকের সাথে তুলনা করে সিনেমা বা নাট্য শিল্পে আমার অবস্থানটা চিন্তা করলাম এবং নিজেকে আবিষ্কার করলাম রোডি হিসাবে। মিউজিসিয়ানদের ইন্সট্রুমেন্ট যারা টানাটানি করে তাদের রোডি বলা হয়। যেহেতু আমি একেবারেই নতুন পথচারী এ লাইনে, সেহেতু রোডিটাই বেস্ট ডেজিগনেশন মনে হলো আমার জন্য।

কেউ আমার সিনেমাটা করতে চাইলো না। সম্মানি কোনো ব্যাপার ছিলো না। যেহেতু হাতে টাকা রেডি ছিল। মনে মনেও কাউকে দোষ দেইনি। কারণ এত সহজ না সিনেমা বিষয়টা। দেখতে দুই ঘণ্টা লাগলেও বানাতে বহু ঘণ্টা, বহু দিন, বহু সপ্তাহ, বহু মাস লাগে। একটা তিন মিনিটের গান বানাতে যদি তিন মাস লেগে যায়, তাহলে একটা দুই ঘণ্টার সিনেমা বানাতে কত সময় দরকার, তা আমি খুব ভালো করে উপলব্ধি করতে পারলাম। শুধু আবেগ থাকলে হবে না, সাথে সবকিছুর সঠিক সময়ে সঠিক সিঙ্কিং হতে হবে।

যাই হোক, ভগ্ন হৃদয় নিয়ে প্রোডিউসারকে টাকাটা ফেরত দিয়ে ফিরে এলাম প্রবাসে আবার। তবে মনের ভিতর থেকে আগুন নেভেনি বরং জ্বলেছে দ্বিগুণ। হয়তো এমন একটা দিন আসতে পারে যেদিন আমার সিনেমা বানানোর স্বপ্নটা সফল হবে। আবার নাও হতে পারে। কারণ সিনেমা বিষয়টা একটা গান বা একটা ক্যাসেটের মতো না যে, চাইলেই সুর করে ফেলবো। এই সময়ে সেই আগের মতো আরেকজন পিলু মমতাজ প্রয়োজন যিনি আমাকে ডেকে উনার সাথে বাজাতে বলবেন অর্থাৎ একটা সুযোগ দরকার। সেটা পেলে ভালো আর না পেলে নিজে সৃষ্টি করে নিতে হবে। তবে ঠিক আগের সেই শিক্ষাটা আবার আমার চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, ভালো কারও কাছে অডিশনে পাশ করতে হলে তার আগে অন্য আরেকজনের কাছে পাশ করে অথবা কাজ করে আসতে হবে। এমনও দিন আবার আসলে আসতেও পারে যখন ‘যার কাছে ফেল করেছিলাম, অবশেষে তিনিই আমাকে জিপিএ ফাইভ দিয়েছেন’ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে গেল। আসলে কারও ফিরে আসাটা বা আমাকে কেউ ডেকে নেয়াটা আমার চ্যালেঞ্জ বা স্বপ্ন নয়। বরং একটা সিনেমা বানানোই আমার স্বপ্ন। এবং সেটা বানাতে গিয়ে যেই হোক না কেন, আমি তার দ্বারস্থ হবো। কারণ এখন আমার শ্রুতির জানালায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিতরে হওয়া প্র্যাকটিস দেখার সময়।