
ইশরাত জাহানের গদ্য ‘সম্পর্কের মাপকাঠি’
প্রকাশিত : জুলাই ০৪, ২০২৫
সম্পর্কের আসল মাপকাঠি হওয়া উচিত আত্মিক সংযোগ আর মানবিক মূল্যবোধ। এই ভাবনার ওপর একটু গভীরভাবে আলোকপাত করা দরকার। কেন আমরা অনেক সময় ‘শখের পুরুষ’ বা ‘শখের নারী’ খোঁজার মায়ায় আটকে পড়ি? কেন বাহ্যিক জিনিসগুলো এত বেশি গুরুত্ব পায়? এর পেছনে আছে কিছু গভীর মানসিক ও সামাজিক কারণ, যেগুলো আমাদের নিজেদেরও অনেক সময় বুঝতে কঠিন হয়।
কিন্তু মানুষের হৃদয় কখনো এত সরল নয়। আমাদের মধ্যে থাকে এক শূন্যতা, এক অপরিপূর্ণতা, যা আমরা নিজেরাই পূরণ করতে পারি না। তাই খুঁজে ফিরি কারো কাছে, যার মুখে থাকে আমাদের ছায়ার গল্প, অথবা যার হাতে ধরা থাকে একাকিত্বের হাত ধরার আশা। এই শূন্যতা, এই ভয়, এই সামাজিক চাপ— তাদের স্রোতে জন্ম নেয় ‘শখের সঙ্গী’ খোঁজার বাসনা। আর এর পেছনে থাকে কিছু গভীর কারণ।
সমাজের গড়া আদর্শ ও মাপকাঠি
ছোটবেলা থেকেই আমরা শুনি, সফলতার মানে হলো আর্থিক সাফল্য, বাহ্যিক আকর্ষণ এবং সামাজিক মর্যাদা। আমাদের চারপাশের মিডিয়া, সিনেমা ও বিজ্ঞাপন সবই ‘পারফেক্ট’ জীবন ও ‘আদর্শ’ সঙ্গীর ছবি তুলে ধরে। ফলে, আমরা ভুলে যাই সম্পর্কের আসল অর্থ, আর খুঁজতে থাকি কেবল বহিরঙ্গন সৌন্দর্য ও সামাজিক স্বীকৃতি।
অপূর্ণতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব
অনেক সময় আমরা নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি অনুভব করি, আমাদের ভিতর একটি ফাঁকা জায়গা থেকে যায়। সেই ফাঁকটা আমরা অন্য কারো সঙ্গে পূরণ করতে চাই, বিশেষ করে যাকে দেখে মনে হয় সে আমাদের অসম্পূর্ণতা ঢেকে দিতে পারবে। এটি মূলত নিজের সঙ্গে সংযোগহীনতার প্রতিফলন।
ভয় ও একাকিত্বের চাপ
একাকিত্ব মানুষের জন্য এক কঠিন অনুভূতি, যা অনেক সময় তাকে এমন সম্পর্কের দিকে ঠেলে দেয় যা হয়তো গভীর নয়, কিন্তু তাকে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তি দেয়। একাকিত্বের ভয় আমাদের অনেক সময় শারীরিক বা মানসিক স্বাচ্ছন্দ্যের বাইরে সম্পর্ক খুঁজতে বাধ্য করে।
পরিপক্কতার অভাব ও বাস্তবতা অস্বীকার
সম্পর্কের প্রতি অনেকের প্রত্যাশা হয় নিখুঁত, যেখানে কোনো দ্বন্দ্ব, অসুবিধা বা ত্যাগ থাকে না। কিন্তু সত্যিকারের সম্পর্ক মানে হলো একে অপরকে বোঝা, ধৈর্য ধরা এবং যৌথভাবে বেড়ে ওঠা। যখন কেউ এ বাস্তবতাকে মানতে পারে না তখন সে সহজেই বাহ্যিক রূপে আকৃষ্ট হয়।
পরিবার ও সামাজিক চাপ
অনেক ক্ষেত্রে আমাদের পছন্দ ও ইচ্ছার বাইরে সামাজিক ও পারিবারিক প্রত্যাশা আমাদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। এতে ব্যক্তি নিজের অন্তর্গত চাহিদা ও সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, এবং ‘শখের’ সম্পর্কের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবের ফাঁক
জীবনের যে স্বপ্নগুলো আমরা দেখি সেগুলো অনেক সময় বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না। স্বপ্নে ‘পারফেক্ট’ সঙ্গীর চিত্র গড়ে উঠলেও বাস্তবে সেই মানুষটা অনেক বেশি জটিল, দুর্বল ও অসম্পূর্ণ। সেই ফাঁক মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং তাকে মায়ার কাছে আরো আকৃষ্ট করে।
তবু একদিন আমরা উপলব্ধি করি, ভালোবাসা শুধুমাত্র বাহ্যিক নয়, তা অন্তরের গভীর থেকে জন্মানো এক আত্মিক সংযোগ। যেখানে শ্রদ্ধা, মানবতা, মূল্যবোধ আর মায়া জড়িয়ে থাকে। যেখানে সম্পর্ক হয় বিকল্পহীন ও চিরস্থায়ী। সুতরাং খুঁজতে হবে এমন ভালোবাসা যা চোখের ঝলকানি নয়, হৃদয়ের গভীর স্পন্দন; যেখানে ‘শখ’ নয়, বরং সত্যিকার ‘সংযোগ’।
লেখক: লেফট্যানেন্ট কর্নেল ও কথাসাহিত্যিক