ইশরাত জাহানের গল্প ‘হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপির খোঁজে’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৫

কখনো কি ভেবেছো, পুরনো একটি বইয়ের ভেতর লুকিয়ে থাকতে পারে একটি জাতির হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস? কখনো কি মনে হয়েছে, কোনো এক অতীতের অপ্রকাশিত সত্য আজও আমাদের বর্তমানকে নাড়া দেয়? ‘হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপির খোঁজে’ শুধুমাত্র কিশোর আলভির অনুসন্ধানের গল্প নয়, লুকিয়ে রাখা ইতিহাসের দরজায় কড়া নাড়ার গল্প এটি। একটি প্রজন্মের কাছে হারিয়ে যাওয়া ন্যায়বোধ আর সাহসের উত্তরাধিকার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা এই গল্প। এই কাহিনিতে বাস্তবের ছায়া আছে, আছে রহস্যের গন্ধ, আছে ইতিহাসের শিকড় ছুঁয়ে যাওয়া এক বিপন্ন সত্য। কাহিনির ভাঁজে-ভাঁজে পাঠক খুঁজে পাবেন ছেঁড়া টিকিটের সংকেত, ভাঙা টাইপরাইটারের আওয়াজ, চোখের ভেতর লুকানো ঘড়ি— যা কেবল সময় নয়, স্মৃতিকেও মেপে ফেলে। যে কিশোর বা কিশোরী এই গল্পে ডুবে যাবে, আশা করি তারা বুঝতে পারবে, সত্য চাপা থাকলেও সে হারায় না। কেবল দরকার এক চূড়ান্ত সাহস, যা আলভির মতো অনুসন্ধানীর ভেতরই জন্ম নেয়। তোমার হাতেই আছে সেই চাবি, যা খুলে দিতে পারে সত্যের দরজা। সাহস নিয়ে এগিয়ে এসো। কারণ, রহস্য নিজেই অপেক্ষা করছে তোমার উত্তরের জন্য।

১৯৮২ সালের ঝড়ের একটি রাত। পুরো ঢাকা শহর নিস্তব্ধ। অদৃশ্য কোনো হাত যেন গোটা শহরটাকে মুঠোর ভেতর বন্দি করে রেখেছে। এই অবস্থায় যে-কারো শ্বাস আটকে যেতে পারে বুকের ভেতর। ধুলো-মলিন পুরনো দিনের রঙচটা একটি বাড়ি। একটি কক্ষে বসে বৃদ্ধ ইতিহাসবিদ রফিকুল ইসলাম দ্রুত কলম চালিয়ে কী যেন লিখে চলেছেন। তার চোখমুখে আতঙ্ক। তার হাতের শেষ পৃষ্ঠার লেখাটি প্রায় সম্পূর্ণ। কিন্তু সময় কম। তিনি ফোনের রিসিভার তুললেন, কাঁপা-কাঁপা হাতে নম্বর ডায়াল করলেন। হ্যালো, মাহমুদ?
ফোনের অপর পাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস। এরপর কণ্ঠস্বর, তারা কি জানে তুমি কী লিখছো?

রফিকুল কিছুক্ষণ নীরব রইলেন। এরপর ফিসফিস করে বললেন, আমি শেষ করেছি। কিন্তু পাণ্ডুলিপিটা নিরাপদ নয়। আমাকে চলে যেতে হবে।

অপর প্রান্তে নীরবতা। রফিকুলও নীরব। বাইরে কেবল ঝড়ের তাণ্ডবের শোঁ-শোঁ আওয়াজ। হঠাৎ ধপ করে দরজায় কিসের যেন শব্দ হলো। চমকে উঠলেন রফিকুল। হাতের রিসিভার কেঁপে উঠল। পেছন ফিরে তাকালেন তিনি। দেখলেন, দরজার নিচ দিয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলি ঢুকছে ঘরের ভেতরে। রফিকুল বুঝতে পারলেন, তাকে থামানোর জন্য কেউ একজন এসে গেছে। তিনি দ্রুত তার ডেস্ক থেকে এক-টুকরো কাগজ টেনে নিলেন। এরপর কলম হাতে নিয়ে দ্রুত লিখতে লাগলেন, যদি কখনো জানতে চাও সত্য কোথায় হারালো, তাহলে ১৯৮২ সালের পাণ্ডুলিপি খুঁজে বের করো।

কাগজটি ভাঁজ করে তিনি পুরনো একটি বইয়ের পাতার ভেতর লুকিয়ে ফেললেন। আর ঠিক তখন, জানালার কাচ ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল। ঘরে ঢুকে পড়ল একজন।

চার দশক পর।
তিনতলা বাড়িটার পেছনদিকে বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে জঙ্গল। আগাছায় ঢাকা। বাড়িটারও বেশ পুরোনো। দেয়ালের রঙ চটে গেছে। মেরামতের যেন কেউ নেই। বাড়িটা ঘিরে কী রকম যেন নির্জনতা! এই রকম বাড়ি এখন আর ঢাকা শহরে দেখতে পাওয়া যায় না। বাড়ির জানালায় এক কিশোরের মুখ। সে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। বিকেলের স্বচ্ছ নীলাভ আকাশ। চোখ ফিরিয়ে আলভি আলমারিতে রাখা বইগুলোর দিকে তাকালো। তিনতলার এই ঘরটা তাদের পারিবারিক লাইব্রেরি। সে-ই দাদুর আমল থেকে। তিনি সাংবাদিক ছিলেন। নানা ধরনের বই পড়ার বিশেষ ঝোঁক ছিল তার। এসব বইপত্র সবই তার হাতের। এই বাড়ির কেউ তেমন একটা বই পড়ে না। পাঠ্যবইয়ের চাপে আলভিরও বাইরের বইটই তেমন একটা পড়া হয়ে ওঠে না। তবে মাঝে-মধ্যে সে এই ঘরটায় এসে বসে থাকে। এখানে, এই এতসব পুরনো বইয়ের স্তূপের ভেতর বসে থাকতে তার বেশ লাগে। কী রকম পুরনো-পুরনো এক রকম গন্ধ আছে এই ঘরটায়।

দাদু মাহমুদ হোসেন মারা গেছেন ছয় মাস আগে। সেই রাতের পর এই ঘরটা হয়ে ওঠে আলভির অবসর কাটানোর আশ্রয়। দাদু নেই, রয়ে গেছে তার স্মৃতি। লাইব্রেরির চারদিকে যা-কিছুই চোখে পড়ে, সবকিছুতেই লেগে আছে দাদুর হাতের ছোঁয়া। এসব ভাবতে আলভির ভালো লাগে। দাদুর মুখখানা মনে পড়ে।

ধুলোপড়া একটি ডেস্কের ওপর তেলাপোকা হাঁটছে। তেলাপোকা তো বইয়ের পাতা কাটে! আলভি উঠল। ডেস্কের নিচ থেকে চওড়া-মতো একটা বই বের করে সেটা সজোরে ফেলল তেলাপোকাটার গায়ে। ব্যস, কেল্লা ফতে! আর ঠিক তক্ষুণি সেই বইয়ের ভেতর থেকে একটা কাগজ খসে পড়ল মেঝেয়। প্রায় হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজের শরীর। হলুদের ওপর কালো কালির কিছু অক্ষর ঝাপসা হয়ে লেপ্টে আছে। তবে পরিষ্কার পড়া যায়। আলভি কাগজটা তুলে নিয়ে চোখ বোলালো, যদি কখনো জানতে চাও সত্য কোথায় হারালো, তাহলে ১৯৮২ সালের পাণ্ডুলিপি খুঁজে বের করো।

আলভির কপালে ভাঁজ পড়লো। বিস্ময়ে তার মুখ হা হয়ে গেল। সে কী! ১৯৮২ সালের পাণ্ডুলিপি! আলভির বুকের ভেতর ধকধক করে উঠল। গুপ্তধন আবিষ্কারের মতো আনন্দ হলো তার। কাগজটি হাতে নিয়ে ফের জানালার কাছে এসে বসলো সে। হাতের লেখা দেখে মনে হচ্ছে, এটা দাদুর লেখা নয়। তবে কার? আরেকজনের লেখা নোট দাদুর লাইব্রেরিতে এলো কিভাবে? আর এলোই যখন তাহলে মানে কী এই লেখার? রহস্য! রহস্য! রহস্য! আলভি রহস্যের গোপন গন্ধ পেল। সে উঠল। ডেস্কের পুরনো বইগুলো ঘাঁটতে আরম্ভ করল। ভারি একটা বই সরাতেই কয়েকটি কাগজ নিচে খসে পড়ল। কাগজগুলোর ভেতর পুরনো একটা লাইব্রেরির বুকমার্ক। সেটার একপাশে লেখা, Truth lies between the lines. অন্য পাশে ছোট্ট একটি কিউআর কোড।

আলভির চোখ বড় হয়ে যায়। কপাল কুঁচকে সে কিছুক্ষণ কোডটির দিকে চেয়ে রইল। সে বুঝতে পারল, একটি গল্পের রহস্যের গভীরে সে ঢুকে পড়ছে। সেই গল্প এখন কেবল একটি বইয়ের মধ্যে নেই, রহস্যটি তাকে সময়ের বিরুদ্ধে এক যাত্রার দিকে নিয়ে যেতে চলেছে। বুকমার্কটা হাতে নিয়েই সে বইটা খুলে পড়া শুরু করল।

প্রতিটি পৃষ্ঠায় কিছু শব্দ ঝাপসা, আবার কিছু অস্বাভাবিক রকম স্পষ্ট। আলভি লক্ষ্য করল, বারবার তিনটি নাম উঠে আসছে M.A., U.N.B., A.A. আর একটি তারিখ 7.17.1982. এই নাম আর তারিখের পরপরই বইটি হঠাৎই শেষ। পরের পৃষ্ঠা ফাঁকা। যেন কেউ ইচ্ছা করেই মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছে। দাদুর ডেস্কে বসে কম্পিউটার চালু করল আলভি। এরপর কিউআর কোডটি স্ক্যান করল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল একটি পাসওয়ার্ড চাওয়া বক্স। কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে টাইপ করল, RafiqulIslam1982. এন্টার চাপতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল গোপন নোটবুক, যেখানে সব শেষ হয়েছিল সেখান থেকে শুরু করো। আরও নিচে লেখা, Access Level: Level 1 Unlocked.

আলভি শ্বাস বন্ধ করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। বইয়ের পাতার ভেতরের সত্য যেন ধীরে-ধীরে তাকে ঘিরে ফেলছে। রহস্য কেবল শুরু হয়েছে…

রাতের খাবার শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও আলভির চোখে ঘুম নেই। দাদুর ঘর যেন আজ তাকে ডাকছে। পা টিপে-টিপে সে উঠে এলো তিনতলায়। দাদুর প্রিয় সংগ্রহ ছিল ঘড়ি। দেয়ালের তাকজুড়ে সাজানো অন্তত বিশখানা প্রাচীন ঘড়ি। প্রতিটি ঘড়ির নিচে একটা করে কোড GH-1, GH-2... ঘড়িগুলো দেখে মনে হয়, সময় যেন এখানে থমকে আছে। তবে একটা ঘড়ি তার দৃষ্টি কেড়ে নিল। ছোট্ট গোল কাঠের তৈরি, কাচে হালকা চির, কাঁটার গতি ধীর। আশ্চর্যের বিষয়, এই ঘড়ির নিচে কোনো কোড নেই।

ঘড়িটা হাতে নিয়ে আলভি দেখল, পিছনে একটা স্ক্রু অদ্ভুতভাবে ঢিলা। স্ক্রু খোলার পর ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ছোট্ট একখানা পার্চমেন্ট কাগজ। সেখানে লেখা, দেখো, সময় নয়, চিহ্ন খোঁজো। ১২টা ১৭ মিনিটে যা দেখেছিলে সেটাই সত্য।

আলভি চমকে উঠল। তার মাথায় ভেসে উঠল কিউআর কোড স্ক্যান করার সময়। স্মৃতি ঘেঁটে সে ফোন ঘাঁটে। সেই সময় স্ক্রিনশট তুলে রেখেছিল। সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, বইয়ের পাশে আরেকটি কিছু, ধূসর কাগজের প্যাকেট।

বইয়ের তাক ঘেঁটে ওই খামটি আলভি খুঁজে পেল। ভেতরে পুরনো টাইপরাইটারে লেখা একটি চিঠি। চিঠিতে লেখা, এই চিঠি যদি তোমার হাতে পৌঁছায় তাহলে বুঝবে, তুমি সত্যের পথে। M.A. ছিল আমার প্রথম সূত্রদাতা। তাকে খোঁজো। হুঁশিয়ার থাকো, ছায়ারা সব জায়গায়।
চিঠির নিচে স্বাক্ষর R.I.

আলভির মনে প্রশ্ন জাগে, M.A. কে? দাদু কি জানতেন এইসব? ঘড়ির কাঁটা যেন প্রশ্নগুলোর উত্তর দিচ্ছে ধীরে-ধীরে। এবার সে খেয়াল করল, ঘড়ির কাঁটা বারবার একই জায়গায় থেমে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ঘড়ির ভিতরেই কোনো গোপন সংকেত লুকানো রয়েছে।

পরদিন সকাল। স্কুল লাইব্রেরির পুরনো আর্কাইভ সেকশনে আলভি বসে আছে। চোখে কৌতূহলের দীপ্তি। সে জানে, M.A. মানে সম্ভবত মোজাম্মেল আহসান। যিনি রফিকুল ইসলামের সহকর্মী ছিলেন। জানা যায়, তিনি কাজ করতেন সাপ্তাহিক ইত্তেহাদে।

আলভি পত্রিকাগুলোর স্তূপ ঘেঁটে খুঁজে পেল বাদামি রঙের একটি খাম। খামের ওপর লেখা, ইত্তেহাদ, সংখ্যা ৭/৮২।

খাম খুলতেই বেরিয়ে এলো একটি ছেঁড়া রেলওয়ে টিকিট। তার পেছনে টাইপরাইটারে লেখা, যদি খুঁজতে চাও তাহলে ফিরে যাও প্ল্যাটফর্মে। জায়গাটা বদলে গেলেও সংকেত বদলায় না।

টিকিটে লেখা ১৭ জুলাই ১৯৮২। আলভির খেয়াল হলো, এই তারিখটা তো বইয়ের মধ্যেও ছিল। সেই বিকেলেই আলভি চলে গেল কমলাপুর রেল স্টেশনে। নতুন প্ল্যাটফর্মের পাশে সে খুঁজে পেল পুরনো প্ল্যাটফর্ম ৩, যেখানে এখন মালবাহী ট্রেন থামে। ধীরে-ধীরে হেঁটে আলভি পৌঁছে যায় মরিচা ধরা একটি বেঞ্চের নিচে। বেঞ্চের নিচে খোদাই করা একটা বাক্য, যদি দেখার ইচ্ছে থাকে তাহলে চোখ নয়, মন ব্যবহার করো।

পাশেই প্রায় ঘষে যাওয়া একটি কিউআর স্টিকার। স্ক্যান করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল, Access Level 2 Unlocked— Archive fragment found.

সঙ্গে একটি পুরনো অডিও ক্লিপ, ...রাত ১২টায় গাড়ি এসে দাঁড়াবে। লেখককে নিয়ে যাওয়া হবে উত্তর দিকে... সব যেন নিখুঁতভাবে নিঃশব্দে ঘটে।

আলভির বুক কাঁপতে থাকে। সে জানে, তার দাদুর পুরনো বন্ধু শুধু সাংবাদিকই ছিলেন না, একজন সাক্ষীও ছিলেন। আলভি টের পেল, তার সামনে খুলতে চলেছে গোপন রাখা ইতিহাসের একটি দরজা।

স্টেশন থেকে বাড়িতে ফিরল আলভি। চুপচাপ বসে রইল দাদুর ঘরে। জানালার বাইরে সন্ধ্যার আলো নেমে আসছে ধীরে-ধীরে। কিন্তু তার চোখ আটকে আছে দাদুর টেবিলের ওপর ছড়িয়ে থাকা পুরনো কাগজপত্রে। সেই নামটা মাথায় ঘুরছে, মোজাম্মেল আহসান M.A. সে কি সত্যিই এখনও জীবিত? সে কি এখনো সেই সত্যের রক্ষক?

দাদুর পুরনো ফাইল ঘেঁটে আলভি খুঁজে পেল হলদে হয়ে যাওয়া একটি নোটবুক। তার মধ্যে হাতে লেখা একটি পৃষ্ঠা, M.A. নতুন সত্যের দ্বারপ্রান্তে আমার একমাত্র সহযাত্রী।
পৃষ্ঠার নিচে দাদুর অতি পরিচিত স্বাক্ষর। আলভি থমকে যায়।

পরদিন সকাল। পুরান ঢাকার প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আলভি। বহু পুরনো স্মৃতি ও ঐতিহ্যের নিঃশ্বাস মিশে আছে এই ভবনের দেয়ালে দেয়ালে। সে প্রেস ক্লাবের রেকর্ড কিপারকে অনুরোধ করল পুরনো সদস্য তালিকা দেখাতে। তালিকায় সে একটা নাম খুঁজে পেল, মো. আহসান, রিপোর্টার ইত্তেহাদ সাপ্তাহিক, সদস্য নম্বর ৭২৩। ঠিকানা লেখা, ১৮/বি, বর্ধনবাড়ি রোড, বংশাল।

বিকেলবেলায় আলভি গেল সেই বাড়িতে। একতলা লাল ইটের পুরনো বাড়ি, সামনে একটি জামগাছ। দরজার পাশে ধূলি-ধূসর মলিন ফলক, মো. আহসান, সাবেক সাংবাদিক। আলভি কড়া নাড়ল। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে যায়। একজন বৃদ্ধ বেরিয়ে আসেন। সাদা পাঞ্জাবি, চোখে ভারি চশমা। চোখ দুটি ধূসর, কিন্তু তীক্ষ্ণ।
তুমি কি মাহমুদের নাতনি? জিগেস করলেন তিনি।
আলভি বিস্ময়ে বলে উঠল, আপনি কিভাবে চিনলেন?
তোমার চোখে সেই দীপ্তি আছে, যা মাহমুদের ছিল। মৃদু হেসে বললেন তিনি।

ভেতরে নিয়ে গিয়ে আহসান সাহেব তাকে বসতে বললেন। ঘরটি যেন প্রাচীন জাদুঘর। দেয়ালে পুরনো পত্রিকার কাটিং, টাইপরাইটার, রেকর্ডার, আর ধূলি-জমা ফাইলের স্তূপ। জানালার পাশে ছোট চায়ের টেবিল, যেখানে এখনও চায়ের গন্ধ লেগে আছে।

১৯৮২ সালে, তিনি শুরু করলেন, আমরা এমন কিছু তথ্য পেয়েছিলাম, যা জাতীয় ইতিহাসের ভিত কাঁপিয়ে দিত। রফিকুল ভাই সেই সত্যকে লিপিবদ্ধ করছিলেন। কিন্তু আমরা জানতাম, কেউ একজন চাইছে এই লেখা প্রকাশ না হোক। তাই রফিকুল ভাইকে থামানোর জন্য নজরদারি শুরু হয়।

আলভি স্তব্ধ হয়ে শুনতে থাকে। বৃদ্ধ তার দিকে তাকিয়ে বললেন, সেই রাতে রফিকুল ভাই আমাকে একটি খাম দেন। বলেন, আমি যদি ফিরে না আসি, এটি একদিন কেউ এসে খুঁজবে। আমি সেই খাম আজও আগলে রেখেছি।

তিনি ধীরে-ধীরে আলমারির নিচ থেকে বের করে আনলেন ধূলো-জমা একটি খাম। তাতে টাইপরাইটারে লেখা, Phase Three Initiates— Unlock Only When Ready.

আলভির বুক দ্রুত ধুকপুক করতে থাকে। খাম খুলে সে পেল পুরনো একটি চাবি আর একটি ম্যাপ। ম্যাপে শহরের কিছু অংশ দাগানো। টাইপরাইটারে লেখা একটি চিরকুট, সত্যকে কবর দেওয়া গেলেও, তার ছায়া রয়ে যায়। খোঁজো যেখানে ছায়া পড়ে সবচেয়ে কম আলোয়।
আহসান সাহেব বললেন, এখন পথ তোমার, আলভি। আমি শুধু সূচনা করেছিলাম। বাকিটা তুমিই শেষ করবে।

আলভি জানে, এটি শুধু একটি রহস্যের জাল নয়, এটি একটি উত্তরাধিকার। এখন আর পেছনে ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

মোজাম্মেল আহসানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আলভি বাড়ি ফিরে এলো। তার চোখমুখে গভীর স্তব্ধতার ছায়া। ঘরে না গিয়ে সে চুপচাপ বারান্দায় বসে রইল। তার হাতে ধরা খাম, ম্যাপ আর চিরকুট। সবকিছু যেন বাস্তবের বাইরের কিছু মনে হচ্ছে। তার মনে হচ্ছিল, সে যেন ধীরে-ধীরে ঢুকে পড়ছে এমন এক জগতে, যেখানে প্রতিটি বস্তু কিছু না-কিছু লুকিয়ে রেখেছে।

ম্যাপের এক কোণে গোল করে দাগানো R.S.P. নামক একটি জায়গা। ম্যাপ হাতে নিয়ে আলভি লাইব্রেরিতে চলে এলো। বাতাসে সেই পুরনো টাইপরাইটারের ধাতব গন্ধ এখনও লেগে আছে। টাইপরাইটারটি ছিল দাদুর একমাত্র সঙ্গী। কালচে ধূসর রঙের, কিছুটা মরিচা ধরা, কিন্তু কী যেন এক রহস্যময় আকর্ষণ ছিল তাতে। টাইপরাইটারটা যেন এখন আর শুধুই একটা লেখার যন্ত্র নয়, এটা একটা নীরব সাক্ষী, যেটা কয়েক যুগ ধরে অপেক্ষা করছে সঠিক কারও জন্য।

আলভি টাইপরাইটারটি ভালো করে দেখলো। পেছনে ধুলোমাখা কাভার সরিয়ে খেয়াল করল, একটা ছোট্ট লেখা খোদাই করা, R.I. Model 82-S | Rewind System: Phase Entry.

তার মনে পড়ল, দাদুর ঘড়ির পেছনেও ছিল টাইম কোড 00:12:17. ঠিক সেই সময়টাই এখানে আবার এসেছে! কৌতূহল আর উত্তেজনায় আলভি টাইপরাইটারের কার্টিজ খুলে ফেলল। ভেতরে আটকে থাকা পৃষ্ঠাটি বের করে দেখল টাইপরাইটারে লেখা, Phase 3 সফল করতে হলে ফিরে যেতে হবে Phase 1 এ। টাইম কোড 00:12:17.

আলভি অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, পৃষ্ঠার কালি একেবারে তাজা, যেন কয়েক মুহূর্ত আগেই লেখা হয়েছে।

সে টাইপরোল ঘোরাতে থাকে। হঠাৎ এক ঝাঁকুনির মতো শব্দ করে টাইপরাইটারের নিচের অংশ থেকে বেরিয়ে এলো ছোট্ট একটি ধাতব চাবি আর সঙ্গে শক্ত প্লাস্টিকে মোড়া একটি মাইক্রোফিল্ম। টাইপরাইটারটি যেন একটি রহস্যবহুল বাকসো হয়ে দাঁড়ালো।

আলভি দাদুর পুরনো স্লাইড ভিউয়ার খুঁজে বের করল। দীর্ঘদিন ব্যবহৃত না হওয়ায় কিছুটা ধুলো জমেছে, কিন্তু কাজ চালাতে পারবে।

সে মাইক্রোফিল্মটি ভিউয়ারে ঢোকালো। আলো জ্বলে উঠল, আর পর্দায় একে-একে ভেসে উঠল কিছু গোপন চিত্র:
১. গোপন বৈঠকের ছবি: ১৫ জুলাই, ১৯৮২। কক্ষে পাঁচজন ব্যক্তি। তাদের একজন রফিকুল ইসলাম। বাকিদের মুখ ছায়ায় ঢাকা। কেবল রফিকুল ইসলামের মুখই স্পষ্ট।
২. অজ্ঞাত একজনের মুখাবয়ব: চোখ ঢাকা কালো কাপড়ে। নিচে লেখা, Project NST-412 Initiator.
৩. একটি গুদামের নকশা: পাশে লেখা, RSP Zone, Sector C. নকশায় দেখা যাচ্ছে, ভেতরে তিনটি লকার চেম্বার, একটি প্যাসকোড দরজা এবং একটি Vault R3 নামের সাঙ্কেতিক স্থান।

চিত্রগুলোর নিচে টাইপ করা, তোমার সময় শেষ নয়। তুমি যদি সত্য চাও তাহলে এখনই সময় কাজ শুরু করার। ছায়ারা জেগে উঠছে।

ভিউয়ার বন্ধ করতেই আলভির গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ঘরের বাতাস হঠাৎ যেন ভারি হয়ে যায়। আলভি জানে, এই বার্তা শুধু একটা হুমকি নয়, একটা চ্যালেঞ্জ।

চাবিটি তুলে নিয়ে আলভি লক্ষ্য করল, এতে খোদাই করা RSP-GC-3. তার মানে গুদামের তৃতীয় গোপন কক্ষ?

ম্যাপটি আরও খুঁটিয়ে দেখতে থাকে আলভি। Sector C এর মধ্যে ছোট্ট করে গোল করা একটি চিহ্ন। তার নিচে লেখা, Ghost Cellar.

আলভি বুঝতে পারল, এই টাইপরাইটার কেবলই এক বাহক, যা কয়েক যুগ ধরে সংরক্ষণ করে রেখেছে সেই গোপন চাবি ও প্রমাণ।

ধীরে-ধীরে আলভি টাইপরাইটারের গায়ে হাত রাখল। যেন সে গভীরভাবে যন্ত্রটার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। আলভি ফিসফিস করে বলল, তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। তোমার গল্প আমি শেষ করব।

রাত গভীর। জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া চাঁদের আলোয় আলভি বসে আছে লাইব্রেরি কক্ষে। তার সামনের টেবিলে ছড়িয়ে আছে সেই ম্যাপ, চাবি আর টাইপরাইটারের থেকে পাওয়া চিরকুট। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, Ghost Cellar নামটা, Sector C এর ভিতরে চিহ্নিত এক অজানা জায়গা।

মোজাম্মেল আহসান সাহেবের দেওয়া ম্যাপ আর ভিউয়ারে আলভি RSP Zone নকশা মিলিয়ে দেখল। স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, এটি কোনো সাধারণ গুদাম নয়। এটি পরিকল্পিতভাবে তৈরি একাধিক গোপন কক্ষের সমাহার, যার মধ্যে Vault R3 বিশেষভাবে দাগানো।

পরদিন ভোরেই আলভি রওনা দিল ম্যাপে নির্দেশিত জায়গার গন্তব্যে। পুরনো শহরের একদম শেষ প্রান্তে, যেখানে এখন পরিত্যক্ত ভবন, ধ্বংসপ্রায় ওয়্যারহাউজ আর লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা অঞ্চল।

ঘণ্টাখানেক খোঁজাখুঁজি শেষে আলভি দেখল মরচে ধরা লোহার গেট। গেটের ওপর লেখা, R.S.P. STORAGE. গেটটি তালাবদ্ধ। তবে ম্যাপে যে চাবির সংকেত ছিল RSP-GC-3 ঠিক সেটাই তার হাতে। চাবিটি গেটের পাশে একটি ছোট্ট দরজায় প্রবেশ করাতেই ক্লিক শব্দে সেটি খুলে গেল।

ভেতরে অন্ধকার। আলভি টর্চ জ্বালালো। ধুলোয় ঢাকা কাঠের বাকসো, পুরনো টেবিল, দেয়ালে ঝুলে থাকা নীলচে নকশার কাগজ। হঠাৎ সে দেখল, দেয়ালের এক কোণে লুকানো দরজার চিহ্ন, একটি কাচের প্যানেলের পাশে স্পর্শ করার মতো প্যাড।

আলভি টাইপরাইটারের পৃষ্ঠায় থাকা টাইম কোড স্মরণ করল, 00:12:17. নম্বরগুলো দ্রুত আঙুলে টাইপ করল। মুহূর্তেই প্যানেল সবুজ আলোতে জ্বলে উঠল, আর চিচিং ফাঁকের মতো দরজা খুলে গেল ধীরে-ধীরে। ভেতরে একটি ছোট কক্ষ। দেয়ালে ধাতব তাক, মাঝখানে একটি ডেস্ক, ডেস্কের ওপরে ধূলি-জমা ফাইল। ফাইলের ওপর লেখা, NST-412 : Phase Three Objectives– Classified Archive.

আলভি ফাইল খুলে দেখল, ভেতরে আছে, রফিকুল ইসলামের হাতে লেখা নোট, একটি পুরনো ক্যাসেট টেপ, একটি পাসওয়ার্ড প্রোটেক্টেড USB ড্রাইভ এবং একটি আলোকচিত্র। আলোকচিত্রে দেখা যাচ্ছে তিনজন লোক, তার মধ্যে একজন তার দাদু মাহমুদ হোসেন।

নোটে লেখা, যদি এটি তুমি পড়ো তাহলে বুঝবে, তুমি একা নও। সত্যের পথ কাঁটায় ভরা, কিন্তু শেষ গন্তব্য আলোর। NST-412 শুরু হয়েছিল সত্য রক্ষা করার জন্য, শেষ হবে তা প্রকাশ করে। মনে রেখো, কেউ তোমাকে থামাতে চাইবে, কিন্তু থেমো না।

আলভি অনুভব করল, তার রক্তে কাঁটা দিয়ে যাচ্ছে। সে জানে, এখন সে শুধু অনুসন্ধান করছে না, সে নিজেই একজন চাবি রক্ষক হয়ে উঠেছে। এই কক্ষ কেবল এক গোপন ঘর নয়, এটি সত্য রক্ষার কেন্দ্র।

আলভি আলতো করে চাবিটি ডেস্কের ওপর রাখল। আর ফিসফিস করে বলল,  যত দূরেই যাই, আমি থামব না।
আলভি বুঝতে পারল, এটি গোপন ঘর। কিন্তু তার সামনে এখনো রয়ে গেছে গোপন জগৎ।

গোপন ঘর থেকে বেরিয়ে চুপচাপ হাঁটতে থাকে আলভি। রাস্তায় লোকজন তেমন নেই। এদিকটা বেশ ফাঁকা। বাড়িঘরও তেমন নেই। মাথার ওপর রোদ বেশ চড়া। আলভির কপাল ঘেমে উঠেছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে সে কপাল মুছল। আর তখনই তার মনে হলো, তাকে ঘিরে যেন অদৃশ্য এক বাতাস ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই বাতাসের ভেতর অতীতের চাপা কণ্ঠস্বর আর হারিয়ে যাওয়া কাহিনির প্রচ্ছায়া।

বাড়ি ফিরে গোসল সেরে ঝটপট কিছু খেয়ে নিল সে। বেশ খিদে পেয়েছিল। তার তাড়া দেখে খাবার টেবিলে মা বললেন, কী হয়েছে আলভি? বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে?
খেতে খেতে আলভি জবাব দিল, কিছু হয়নি মা।
তুমি কিছু লুকচ্ছো আলভি।

তেমন কিছু নয়, মা। আসলে দাদুর লাইব্রেরিতে পুরনো বইয়ের ভেতর একটা চিরকুট খুঁজে পেয়েছি। সেখানে ধাঁধার মতো কিছু একটা লেখা। মাথার ভেতর সেটাই ঘুরছে। তুমি অত সিরিয়াস হয়ো না।

খাওয়া শেষ করে আলভি উঠল। উঠে এলো লাইব্রেরিতে। সে বুঝতে পারছে, কী রকম যেন ঘোরের ভেতর দিয়ে তার দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। চুম্বকের তীব্র আকর্ষণ সে টের পাচ্ছে তিনতলার এই ঘরটার প্রতি। জানালার পাশে বসে সে ম্যাপ ও ফাইল খুলে বসলো। দেখতে লাগলো খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে। সে বুঝতে পারল, পরের ধাপটি The Silent Eye নামক একটি কোডনেমের সঙ্গে যুক্ত।

এই নামটি আগেও সে দেখেছে। টাইপরাইটারের ফাঁকে পাওয়া একটি পুরনো পৃষ্ঠার নিচে ম্লান কালি দিয়ে লেখা ছিল, S.E. Protocol Initiated–Silent Eye Surveillance Unit. এতদিন আলভি এটিকে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, এটি ছিল একটি গোপন নজরদারি প্রকল্প, যা NST-412 এর অংশ হিসেবে রফিকুল ইসলাম শুরু করেছিলেন।

তথ্য ঘেঁটে আলভি জানতে পারল, এই Surveillance Unit এর প্রধান কার্যালয় ছিল শহরের পুরাতন কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি টেলিগ্রাফ ভবনে। ভবনটি এখন পরিত্যক্ত ও জনমানবহীন।

বিকেল হতেই আলভি সেখানে চলে গেল। দালানটির রংচটা দেয়াল, ভাঙা জানালা, ছাদের ওপর ধূলি আর শ্যাওলা। নিচতলার একটি জানালার কাচ ভেঙে সে ভেতরে ঢুকল। ঘরের ভেতরে তীব্র স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। ধুলোয় ভরা করিডোর পেরিয়ে সে পৌঁছালো একটি কন্ট্রোল রুমে। দেয়ালের মাঝ-বরাবর বিশাল একটি মনিটর, পুরনো সার্ভেইলেন্স বোর্ড, তারকাঁটা আর ক্যামেরার ফ্রেম— সব কিছুই এখন নীরব।

এককোণে আলভি খুঁজে পেল একটি পুরনো কাঠের বাকসো। যার ভেতর ডায়েরি ও ক্যাসেট রিল। ডায়েরিতে লেখা, Silent Eye Surveillance Log জুন ১৯৮২, অবজার্ভার: R.I.

রিলগুলো নজরদারি মিশনের রেকর্ড। পাশের ঘরে আলভি একটি ক্যাসেট প্লেয়ার পেল। সেটাতে রিল চালালে অডিও ভেসে এলো, তারা জানে রফিকুল ভাই কী লিখছেন। ১৫ জুলাইয়ের আগেই তাকে থামাতে হবে, না-হলে অনেক কিছু ফাঁস হয়ে যাবে।
আরেকটি ভয়েস বলল, Silent Eye যদি সক্রিয় থাকে তাহলে আমরা ধরা পড়ে যাব।

আলভি অবাক। এই ইউনিটই হয়তো ছিল রফিকুল ইসলামের শেষ সাক্ষ্যদাতা। ক্যামেরা, ফাইল, মনিটর— সবকিছু তাদের কাহিনির অংশ হয়ে গেছে।

হঠাৎ দেয়ালের গোপন এক লকার খুলে গেল। ভেতরে পাওয়া গেল একটি আইডি কার্ড, Rafiqul Islam, Level-4 Clearance. পিছনে লেখা, Last Login 13 July 1982.

নিখোঁজ হওয়ার ঠিক দুই দিন আগে! আলভি জানে, এখন সে শুধু একটি গল্পের খোঁজ করছে না, সে ক্রমশ রহস্যের অন্ধকারে ঢুকে যাচ্ছে। The Silent Eye শুধু তথ্য দেখাতো না, এটি শাসকদের চোখের চোখ ছিল। কিন্তু এখন প্রশ্ন, কে ছিল এই নজরদারির পিছনে? আর কেনই বা তাদের চোখ নীরব হয়ে গেল?

Silent Eye Surveillance Unit থেকে পাওয়া ফাইলপত্র ও রেকর্ডিং ঘেঁটে আলভি আরও বুঝতে পারলো, প্রকল্প NST-412 শুধুমাত্র গবেষণা বা ইতিহাসের সত্য উন্মোচনের জন্য তৈরি হয়নি, এটি ছিল একটি গুপ্ত সংগঠনের অংশ, যাকে বলা হতো ‘ছায়ামণ্ডলী’। এই ছায়ামণ্ডলী ছিল সেইসব প্রভাবশালী লোকদের একটি দল, যারা ক্ষমতার ছায়ায় দাঁড়িয়ে থেকে তথ্য, ইতিহাস ও ভবিষ্যৎকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইতো। তারা রফিকুল ইসলামকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল একটি যান্ত্রিক ইতিহাস তৈরি করতে, যেখানে সত্য হবে বিকৃত আর ইতিহাস হবে তাদের লেখা।

সন্ধের পরপরই বাসায় ফিরল আলভি। বেশ ক্লান্ত লাগছে। এই কয়েকদিন তেমনভাবে ঘুমোতে পারেনি। আজ ঘুমোতে হবে। একেবারে শ্রান্তির ঘুম! পরদিন একটু বেলা করে ঘুম ভাঙল তার। নাশতা করে উঠে এলো তিনতলায়। হাতে চায়ের কাপ। চায়ে চুমুক দিতে-দিতে সে তার কর্তব্য স্থির করে ফেলল। তার সামনে এখন দুটি লক্ষ্য স্পষ্ট। প্রথমত, সত্য প্রকাশ করা। দ্বিতীয়ত, ছায়ামণ্ডলীর অস্তিত্বের প্রমাণ তুলে ধরা।

কিছুক্ষণই পর সে বেরিয়ে পড়ল। গন্তব্য House-17/B, Eastern Officers` Colony. ভেতরে ঢুকে দেখতে পেল, একতলা পুরনো বাংলো। বাইরে থেকে নিরীহ মনে হলেও ভেতরে জটিল নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কার্ড স্ক্যানার, লেজার লক, ছদ্ম দরজা— সবকিছু যেন ছায়ামণ্ডলীর গোপন ঘাঁটি।

খুব কৌশলে, সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে আলভি ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভেতরে দেয়ালে বিশাল মানচিত্র, ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় গোপন চিহ্ন ও টাইম স্ট্যাম্প। একটি ফোল্ডারে লেখা, RSP Zone অতিক্রম করলে শুধু সত্য নয়, বিপদও নিশ্চিত।

আরেকটি নোট, পরবর্তী ধাপ: Phase Four Operation Eclipse। Overseer এরই মধ্যে সক্রিয়।
আলভি বুঝে গেল, রফিকুল ইসলাম তার পাণ্ডুলিপিতে যা লুকিয়ে রেখেছিলেন তা কেবল তথ্য নয়, এই মণ্ডলীর পতনের প্রারম্ভিক ঘোষণা ছিল।

আলভি চমকে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে ভেতরের একটি দরজা খুলে গেল। তিনজন মুখোশধারী লোক ঢুকল ঘরে। এরা কারা, কোত্থেকে এলো এসব বুঝে ওঠার আগেই একজন মুখোশধারী বলল, তুমি অনেক দূর এসে গেছ আলভি, এবার তোমাকে থামতে হবে।

আলভি চোখ তুলে নির্ভয়ে বলল, আমি থামার জন্য আসিনি। আমি এসেছি তোমাদের মুখোশ খুলে দিতে।

তখনই বন্ধ হয়ে গেল ঘরের লাইট। ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল। আলভি দরজা গলিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ল, হাতে থাকা USB আর রেকর্ডিং ডিভাইস নিয়ে। সে জানে, এখন তাকে খুঁজবে সবাই। কিন্তু সে যা পেয়েছে তা সত্যের চেয়েও শক্তিশালী। এটা শুধু এক অনুসন্ধানের গল্প নয়। এটা এক বিপ্লবের শুরু।

আলভির শ্বাস তখনো তীব্র, দৌড়ে পালিয়ে আসার ক্লান্তি তার শরীরজুড়ে। হাতে শক্ত করে ধরে আছে সেই USB ড্রাইভ, যা ছায়ামণ্ডলীর ভিতরকার সব তথ্যের চাবিকাঠি হতে পারে। সে জানে, এই মুহূর্তে যে-কোনো ভুল তাকে চিরতরে হারিয়ে দিতে পারে।

আলভি আশ্রয় নিল শহরের উপকণ্ঠে তার একমাত্র বন্ধু ফারহানের বাসায়, যে কম্পিউটার হ্যাকিংয়ে পারদর্শী। ফারহান সবকিছু শুনে বলল, এই ডেটা আমরা একবার দেখতে পারলে হয়তো পুরো ছায়ামণ্ডলীর কাঠামো বের করে ফেলতে পারি।

ড্রাইভটি ল্যাপটপে ঢুকাতেই স্ক্রিনে পাসওয়ার্ড প্রম্পট এলো। আলভির হঠাৎ মনে পড়ল, রফিকুল ইসলামের টাইপরাইটারের এক পৃষ্ঠায় লেখা ছিল, Eye Never Blinks, একবার চেষ্টা করে এবং সেটি কাজ করে!

ড্রাইভ খুলতেই একের পর এক নাম, কোডনেম, Surveillance Footage, Payment Logs এবং লুকানো কমিউনিকেশন উঠে আসতে থাকে স্ক্রিনে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর তথ্য দিল একটি ভিডিও বার্তা, Phase Four সফল হলে Ghost Rewrite প্রক্রিয়া চালু করা হবে। ইতিহাসের পুনর্লিখন শুরু হবে ১৫ আগস্ট, এক গোপন বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। Overseer এর শেষ আদেশ, Eliminate the boy if exposed.

আলভির বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। এই তথ্য শুধু এক ষড়যন্ত্র নয়, বরং একটি জাতির স্মৃতি মুছে ফেলার গোপন পরিকল্পনা। ঠিক তখনই ফারহান বলল, দোস্ত, কেউ আমাদের লোকেশন ট্র্যাক করছে। IP ফিড জাম্প করছে। আমরা বেশিক্ষণ নিরাপদ নই।

আলভি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল, এখনই সবকিছু ফাঁস করতে হবে। আরকিছু চিন্তা না-করে দ্রুত পায়ে আলভি রাস্তায় নেমে পড়ল। এরপর একটা সিএনজিতে উঠে পড়ল। The Daily Srot নামের একটি অনলাইন পোর্টালের অফিসের সামনে এসে আলভি নামল। এখানকার রিপোর্টার সামিরা তার পরিচিত। অফিসে গিয়ে সামিরার সঙ্গে দেখা করে আলভি পুরো বিষয়টি তাকে জানালো। আলভির কথা শুনতে শুনতে সামিরাও উত্তেজিত হয়ে উঠল। নির্ভীক সাংবাদিক হিসেবে সাংবাদিক মহলে তার যথেষ্ট সুনাম আছে। আলভির কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়ে তার ভেতরটা চাঙা হয়ে উঠল। সে বলল, ডকুমেন্টস সব এনেছো?

আলভি তার হাতের প্যাকেট সামিরার দিকে এগিয়ে ধরল। প্যাকেটটি হাতে নিয়ে সামিরা বলল, এটা শুধু রিপোর্ট হবে না, এটা হবে এক জাগরণের শুরু।
কিন্তু আলভি জানে, সবকিছু এখানেই শেষ নয়। Overseer এখনও সক্রিয়। ছায়ামণ্ডলী নিশ্চয়ই পাল্টা আঘাত হানবে।

গভীর রাত। শহর নিস্তব্ধ। একটি ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে মুখোশধারী একজন মোবাইলে কথা বলছে, ছেলেটা অনেক দূর চলে গেছে। Phase Five এখন চালু করতে হবে।

পরদিন ভোরে The Daily Srot পোর্টালের হোমপেজ জুড়ে বিশাল শিরোনাম, অপারেশন NST-412: জাতির স্মৃতি মুছে ফেলার নীলনকশা।

পুরো শহরে সাড়া পড়ে গেল। মিডিয়া, প্রশাসন, নাগরিক সমাজ— সবাই হতবাক। এমন ষড়যন্ত্র কেউ কল্পনাও করেনি। কিন্তু এই নির্ভীক সত্যপ্রকাশে আলভির জীবনে নেমে এলো মারাত্মক বিপদ।

ছায়ামণ্ডলীর অভ্যন্তরে জরুরি বৈঠক বসলো। Overseer সেখানে বলল, আমরা অনেক আগেই এই ছেলেটিকে থামাতে পারতাম। কিন্তু এখন সে হয়ে উঠেছে একটি চেতনাবোধের প্রতীক। Phase Five বন্ধ করতে হবে। এখন আমাদের চালাতে হবে Operation NST-412 এর শেষ অস্ত্র।

এই পরিকল্পনা ছিল একটি ভয়ঙ্কর সাইবার অস্ত্র, একটি কোডেড ভাইরাস, যা একবার সক্রিয় হলে দেশের সমস্ত ডিজিটাল আর্কাইভ, সরকারি রেকর্ড, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস সংরক্ষণ সিস্টেম পর্যন্ত বিকৃত করে দিতে পারে। এই সিস্টেমের নাম Ghost Rewrite Protocol.

আলভি জানতে পারল, এই ভাইরাস লুকানো আছে একটি নির্দিষ্ট সার্ভারে, যা সংযুক্ত একটি পরিত্যক্ত ভূগর্ভস্থ Data Center এ, শহরের পুরাতন রেডিও ভবনের নিচে।

আলভি সিদ্ধান্ত নিল, এই ডেটা সেন্টারে ঢুকে ভাইরাসটির Activation Key সরাতে হবে। কারণ এটি একবার চালু হলে অতীত বলে আর কিছুই থাকবে না। এই অভিযানে আলভি সঙ্গে নিল ফারহান ও সামিরাকে। বিষয়টি তাদেরকে বলতেই তারা মহা-উৎসাহে রাজি হয়ে গেল। রাতের অন্ধকারে তারা ডেটা সেন্টারে এলো। ভেতরে ঢোকার পর তারা দেখল, জলের ট্যাংক ঘেরা পুরনো কন্ট্রোল রুম। সেখানে একাধিক মেকানিক্যাল ফাঁদ— লেজার ট্র্যাপ, সাইলেন্ট অ্যালার্ম এবং অন্ধকার টানেল। তিনজনে সাহস আর স্মার্টনেস নিয়ে এগিয়ে গেল। একপর্যায়ে তারা পৌঁছে গেল কোর সার্ভার রুমে, যেখানে লেখা NST-412: Final Vault.

ভেতরে ঢুকতেই সামনে পড়ল পাসওয়ার্ড এনক্রিপ্টেড ভল্ট। হঠাৎ আলভির মনে পড়ল টাইপরাইটারে পাওয়া একটি চিহ্ন, ∆VZ412. আলভি সেটা দ্রুত আঙুলে টাইপ করল। ভল্ট খুলে গেল। সামনে রাখা একটি চিপ, যার নাম Memory Cleanser Alpha. এটিই Ghost Rewrite চালু করার শেষ ট্রিগার।

ঠিক তখনই ঘরে ঢুকল ছায়ামণ্ডলীর তিন সদস্য। তারা অস্ত্রধারী। ফারহান চিৎকার করে উঠল, আলভি, এখনই চিপটা ধ্বংস করো।

এক মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে আলভি চিপটা ছুঁড়ে দিল কন্ট্রোল বোর্ডে এবং ফারহান একটি Electromagnetic Pulse ডিভাইস চালু করল। বিস্তৃত আলো ছড়িয়ে পড়ল। মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে গেল সার্ভার। বিদ্যুৎ চলে গেল। গাঢ় অন্ধকার ঢেকে ফেলল চারদিক। আলভিরা পালালো। বাইরে এসে দেখল, ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। শহর ধীরে-ধীরে জাগছে। ইতিহাস বেঁচে গেল।

আলভি জানে, এই যুদ্ধ এখানেই শেষ নয়। কিন্তু ইতিহাস এখন আর একা নয়। তার পাশে আছে সাহস, তথ্য আর স্মৃতি।

পরদিন সন্ধ্যা। অজানা নম্বর থেকে একটি এনক্রিপ্টেড ভিডিও বার্তা এলো আলভির ইনবক্সে। ভিডিওতে এক ব্যক্তির মুখ অন্ধকারে ঢাকা, কণ্ঠ কৃত্রিমভাবে বিকৃত, তুমি আমাদের পরিকল্পনা ব্যাহত করেছো, আলভি। কিন্তু সবই শেষ হয়নি। সত্য এমন এক অস্ত্র যা সবসময় বিজয়ী নয়।

বার্তার শেষে হঠাৎ করেই একটা মুখের ওপর আলো এসে পড়ল। মুখটা দেখেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল আলভি। মুখটি ততক্ষণে বলতে শুরু করেছে, আমার নাম সামিরা তাবাসসুম। আমি শুধু সাংবাদিক নই, আমি একসময়ে ছায়ামণ্ডলীর অন্তর্বর্তী সদস্য ছিলাম।

আলভির পায়ের নিচের মাটি যেন সরে যায়! সামিরা শান্তস্বরে বলছে, আমি সেই সময়ে গিয়েছিলাম সত্য জানার আশায়। কিন্তু ওদের ভেতরের পরিকল্পনা বুঝতে পারার পর আমি সবকিছু থেকে বেরিয়ে আসি। তুমি যখন আমার কাছে ডেটা নিয়ে এলে, আমি জানতাম, এটাই আমার সুযোগ সব কিছু স্বীকার করার। রফিকুল ইসলাম আমার শিক্ষক ছিলেন। গোপনে আমি তাকে অনেক তথ্য দিতাম। তিনি বিশ্বাস করতেন, একদিন কেউ আসবে যে সত্য সামনে আনবে। সেই ‘কেউ’ যে তুমি,  তা আমি কখনোই ভাবিনি।

সাক্ষাৎকারের পুরো ভিডিও, আলভির সংগ্রহ করা সব প্রমাণ, এবং রফিকুল ইসলামের পাণ্ডুলিপির ডিজিটাল কপি সামিরা আন্তর্জাতিক একটি গণমাধ্যমে পাঠিয়ে দিল। সেগুলো একযোগে প্রকাশিত হলো। পরদিন সকালে দেশজুড়ে নতুন আলোড়ন শুরু হলো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ইতিহাসবিদ, ছাত্রছাত্রী, এমনকি রাজনৈতিক মহলেও শুরু হয় আলোচনা— কিভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করা হচ্ছিল, আর কিভাবে এক কিশোর সেই ষড়যন্ত্র থামিয়ে দিল।

আলভির বাড়িতে তখনো নজরদারি চলছে। কিন্তু এবার সে একা নয়, দেশের মানুষ এখন তার পাশে। কেউ বলে, সে আমাদের বিবেকের প্রতিনিধি। কেউ বলে, এই প্রজন্ম হারায়নি, তারা জেগে উঠেছে।

সামিরার স্বীকারোক্তি শুধু একটি ব্যক্তিগত অনুশোচনা নয়, বরং একটি জাতির প্রতি দায়বদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ। আর আলভি? সে জানে, এই লড়াইয়ের একেকটি অধ্যায় শেষ হলেও যুদ্ধে এখনো অনেক কিছু বাকি।

আকাশে তখন ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে ঢাকা শহরের। কিন্তু আজকের সকালটা অন্য রকম। পত্রিকার হেডলাইন, টেলিভিশনের নিউজ ব্রেকিং, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতিটি পোস্ট— সব জায়গায় ঘুরছে একটি নাম, আলভি হোসেন। আলভি এখন আর কেবল একজন কিশোর নয়, বরং একটি প্রজন্মের প্রতিনিধি। চোখে আঙুল দিয়ে যে দেখিয়েছে, সত্য কতটা শক্তিশালী হতে পারে, যদি কেউ তা সাহসের সঙ্গে তুলে ধরে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেন, আলভি একটি আন্দোলন শুরু করেছে। সে আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। সত্যকে খুঁজে পাওয়া শুধু গবেষণার কাজ নয়, এটা চেতনারও কাজ।

একটি স্কুলে শিক্ষকরা ক্লাসে রফিকুল ইসলামের লেখা পাণ্ডুলিপির অংশ পড়াচ্ছেন। ছাত্ররা প্রশ্ন করছে, তারা জানতে চাইছে, এই পৃথিবীকে কে লেখে, আর কে বদলাতে পারে?

আলভি তখনো নীরব। দাদুর লাইব্রেরিতে জানালার ধারে বসে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। পাশে চুপ করে বসে আছে মা। তিনি বললেন, তুই জানিস, তোর বাবাও সত্য লিখতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। আজ মনে হচ্ছে, তুই সেই অসমাপ্ত লড়াইটা শেষ করলি।

আলভি চুপ করে থাকে। কিন্তু তার চোখে তখন আগুন। এই আগুন প্রতিশোধের নয়, এই আগুন আলো ছড়ানোর। সে জানে, এখন তার কাজ অন্যদের জাগানো। সত্যকে তুলে ধরা একা তার দায়িত্ব নয়, এটা হতে হবে সবার আন্দোলন।

সারাদেশে শুরু হয় ‘পাণ্ডুলিপি সত্য অভিযান’। তরুণরা হাতে ব্যানার নিয়ে হাঁটে। ব্যানারে লেখা, তথ্য লুকিও না, সত্য জাগাও। ইতিহাসকে যে প্রশ্ন করে, সে-ই ইতিহাস গড়ে।

আলভির পাঠানো ভিডিও বার্তা ভাইরাল হয়ে গেল: আমি লেখক নই। আমি একজন যাত্রী। যাত্রা শুরু হয়েছে শুধু। সত্যকে রক্ষা করা কেবল আমার কাজ নয়, এখন এটা তোমাদেরও।

সেই রাতে শহরের কেন্দ্রীয় স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে হাজারও মানুষ মোমবাতি জ্বালায়। প্রত্যেকে হাতে ধরে থাকে পাণ্ডুলিপির কপি, রফিকুল ইসলামের লেখা ছেঁড়া পাতাগুলো, যেগুলো আবার জোড়া লাগানো হয়েছে।

এটা শুধু একটি বইয়ের পুনরুদ্ধার নয়, এটা ছিল একটি জাতির জাগরণ। আর এই জাগরণের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে আলভি। সবকিছুর পরেও আলভির মনে একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিল, রফিকুল ইসলামের পাণ্ডুলিপির আসল পূর্ণসংস্করণ কোথায়? সে যেসব পাতা সংগ্রহ করেছে, সেগুলো টুকরো টুকরো অংশ, কিন্তু সবকিছু নয়। পুরো সত্য এখনো ধোঁয়াশায়।

হঠাৎ এক রাতে দাদুর পুরনো ট্রাঙ্ক ঘাঁটতে গিয়ে আলভি খুঁজে পেল একটি কাঠের বাকসো। সেটা খুলতেই উঠে এলো সুদৃশ্য পিতলের একটি কেস, যার ওপর খোদাই করা RF-82 Complete. তার নিচে ছোট করে লেখা, যদি কখনো সত্য চাপা পড়ে, এই বাকসো খুলবে ভবিষ্যতের চোখ।
আলভি বুঝে গেল, সে এখন সেই ‘ভবিষ্যতের চোখ’।

কেসটি খুলতেই সে দেখতে পেল ১৯৮২ সালে লেখা সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপির আসল কপি। হাতে লেখা, প্রতিটি লাইনে রফিকুল ইসলামের হাতের কাঁপুনি, আবেগ এবং সততার ছাপ। পাণ্ডুলিপির শেষে একটি চিঠি, এই সত্য যদি একদিন জেগে ওঠে, তবে বিশ্বাস করো— তুমি একা নও। ইতিহাস তোমার পাশে থাকবে। সাহসই তোমার উত্তরাধিকার।

এই পাণ্ডুলিপির সঙ্গে একটি ম্যাপও রয়েছে, যেখানে কয়েকটি রহস্যময় স্থান চিহ্নিত। এর মধ্যে একটি স্থান জামালপুরের পুরনো স্কুল— যেখানে রফিকুল ইসলাম একসময় শিক্ষকতা করতেন।

আলভি সিদ্ধান্ত নিল সেখানে যেতে হবে। এবং পরদিনই সে রওনা দিল। পথে-পথে ছায়ামণ্ডলীর কিছু শেষ সেলোনো সদস্য তার ওপর নজর রাখে। কিন্তু আলভির পক্ষে এখন আছে ছাত্রসমাজ, শিক্ষক,  রিপোর্টার, এমনকি সচেতন জনগণ।

জামালপুর পৌঁছে সেই স্কুলের পিছনের ঘরে আলভি খুঁজে পেল একটি গোপন দেয়াল— যেখানে লেখা, সত্য কখনো গোপন থাকে না, সে শুধু সময়ের জন্য অপেক্ষা করে।

এই দেয়ালের ভিতর ছিল একটি লোহার আলমারি এবং ভিতরে সেই আসল Phase Zero রিপোর্ট— যেটা দিয়ে পুরো ছায়ামণ্ডলী তৈরি হয়েছিল। এটা ছিল সব ষড়যন্ত্রের সূচনা নথি।

এখন সবকিছু আলভির হাতে। পুরো গল্প, গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত। সে জানে, এই নথিগুলো বিশ্বের সামনে আনলে শুধু ইতিহাসই বদলাবে না, বরং এই জাতি নিজের আত্মপরিচয় পুনরুদ্ধার করতে পারবে।
চূড়ান্ত সত্য এখন তার সামনে। শুধু দরকার সাহস আর একটা শেষ পদক্ষেপ।

গভীর রাত। জানালার ওপাশে শহর ঘুমাচ্ছে। কিন্তু আলভির চোখে ঘুম নেই। বিছানায় বসে, সামনে ছড়িয়ে রাখা পাণ্ডুলিপির পাতাগুলোর দিকে সে তাকিয়ে আছে। পুরো যাত্রার প্রতিটি মুহূর্ত তার মনে ভেসে উঠছে— রহস্য, দ্বিধা, বিশ্বাসঘাতকতা আর সাহস।

তার হাতে এখন ইতিহাসের সেই অনুলিখন, যা যুগের পর যুগ ধোঁয়াশায় ছিল। রফিকুল ইসলামের পাণ্ডুলিপির শেষ পৃষ্ঠায় লেখা ছিল, যে ইতিহাস হারায়, সে জাতি নিঃস্ব হয়। আর যে সত্যকে ধরে রাখে, সে ভবিষ্যতের পথ তৈরি করে।

আলভি বুঝে গেছে, তার দায়িত্ব শুধু সত্য প্রকাশ নয়, সেই সত্যকে ধরে রাখাও তার কাজ। সে সিদ্ধান্ত নিল, পাণ্ডুলিপিটি একটি উন্মুক্ত আর্কাইভে জমা দেবে, যেখানে যে-কেউ পড়তে পারবে, শিখতে পারবে, প্রশ্ন করতে পারবে। ইতিহাস আর কোনো গোপন সম্পত্তি হবে না, এটা হবে সকলের জ্ঞানভাণ্ডার।

শেষ পৃষ্ঠার নিচে সে নিজে একটি লাইন লিখল, এই বই শুরু হয়েছিল একজন লেখকের হাতে, শেষ হচ্ছে একজন পাঠকের বিশ্বাসে।

মা এসে বসলেন তার পাশে। চুপ করে হাত রাখলেন আলভির কাঁধে। খুব শান্তস্বরে বললেন, তুই জয় করেছিস বাবা। এখন তোর সত্য আরও অনেকের আলো হবে।

আলভি জানে, গল্প শেষ নয়। সত্যের পথ কোনো গন্তব্য নয়, এটা একটানা চলতে থাকা যাত্রা।

পেছনের খোলা জানালা দিয়ে ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। সেই আলোতেই শেষ পৃষ্ঠার শব্দগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল, তুমি যদি সত্য খোঁজো তাহলে তোমাকেই হতে হবে তার রক্ষক।