সিরিয়ার আসাদ বাহিনীর হামলায় বিধ্বস্ত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের কবর
উমর বিন আব্দুল আজিজ: উমাইয়াদের ভালো মানুষটা
তুহিন খানপ্রকাশিত : জুন ০১, ২০২০
পারসিকদের শিল্পবোধ, ইতিহাসবোধ ও ঐতিহ্যবোধের প্রশংসায় প্রায় পঞ্চমুখ দেখা যায় কাউরে কাউরে। যেন অন্য মুসলমানরা সবাই-ই বোকা, ভোদাই। তো, এহেন `সংস্কৃতিপ্রিয়` ইরানি শিয়া টেরোরিস্টরা উমর বিন আব্দুল আজিজের মাজার ধ্বংস করল সিরিয়ায়। তার বউয়ের এবং খাদেমের মাজারও ধ্বংস করল। তাদের কবরে মৃতদেহের যে ধ্বংসাবশেষ ছিল, তাও তুইলা নিয়া যাওয়ার অভিযোগ উঠছে গণমাধ্যমে। উমাইয়াদের প্রতি শিয়াদের যুগ-যুগান্তরের ক্রোধ— এর হয়ত একটা মানে আছে। একথা সত্য যে, উমাইয়াদের সময়ে এই দলের লোকেরা অত্যাচারিত হইছে সবচাইতে বেশি। কিন্তু, তাই বইলা উমর ইবনে আব্দুল আজিজ?
আব্দুল মালেক না, মারওয়ান না, সুলায়মান না, হাজ্জাজ না, ওয়ালিদ না, আব্দুল আজিজ না। উমর বিন আব্দুল আজিজ, কেন? সেই উমর বিন আব্দুল আজিজ, যুবরাজ থাকা অবস্থায় যার আতরের গন্ধে দামেশকের বাজারে খবর হয়ে যাইত যে, উমর আসতেছেন। অথচ ক্ষমতা গ্রহণের পর যিনি সেই বিলাসী যুবরাজের জীবন ত্যাগ করছিলেন। এমনকি উমাইয়া-বিরোধীরাও যারে `দ্বিতীয় উমর` বলেন, `খলিফা` বলেন। যে উমর বিন আব্দুল আজিজ তার বংশের চালু করা যাবতীয় নতুন প্রথা বিলোপ কইরা রাসুলের আদর্শে দেশ চালানোর শপথ করছিলেন। খলিফা হওয়ার পরপরই যিনি বলছিলেন, ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিয়ুন। যিনি বুঝতেন, ক্ষমতা একটা বিস্ট, একটা আদি-অন্তহীন পাজল, এরে বশে রাখা লাগবে, এর অধীন হওয়া যাবে না। তাই ক্ষমতা পাওয়ার পরে মানুষের সব স্বাভাবিক বোধ, চিন্তা, বিশ্বাস বাদ দিতে হয়, ক্ষমতা পাওয়ার পর মানুষের বদলাইতে হয়। সেই উমররেই কেন টার্গেট করল এই শিয়া সন্ত্রাসীরা?
অথচ এই উমর, শিয়াদের সাথে তার ব্যবহার কেমন ছিল? উমাইয়া খেলাফত, যখন শিয়াদের কঠিন দুঃসময়, তখন হযরত উমর বিন আব্দুল আজিজ মসজিদের মেম্বারে বইসা হযরত আলিরে গালমন্দ করার উমাইয়া প্রথা বন্ধ করছিলেন (উমাইয়াদের অনেক প্রশাসক ও গভর্নর অতি উৎসাহে এই কাজ করতেন; কিন্তু হযরত মুয়াবিয়া এইটা চালু করছেন মর্মে যে বক্তব্য আছে, তা ঐতিহাসিক বিচারে শুদ্ধ লাগে না)। খাইবার যুদ্ধের পরে গনিমত হিশাবে পাওয়া `ফাদাক গ্রাম` ছিল রাসুলের সম্পত্তি। ওনার ওফাতের পরে এই সম্পত্তি হযরত ফাতেমারে দিতে অস্বীকৃতি জানাইছিলেন হযরত আবু বকর। তার যুক্তি ছিল, নবীরা কোন সম্পদ রাইখা যান না, তাদের যা কিছু ব্যক্তিগত, সবই আসলে পাবলিক। পরবর্তীকালে উমাইয়া ও আব্বাসি খলিফাদের প্রায় সবাইই হযরত আবু বকরের মতই `ফাদাক`রে সরকারি জমি হিশেবে ব্যবহার করছেন, খুব অল্প কয়েকজন ছাড়া। আর, তাদের প্রথমজন হইলেন হযরত উমর বিন আব্দুল আজিজ। তিনিই প্রথম `ফাদাক` ফিরায়ে দিছিলেন হযরত ফাতেমা ও আলির বংশধরদের কাছে। বাপ-দাদার সূত্রে পাওয়া এই জমিন নিজের কাছে রাখাটা ঠিক মনে হয় নাই ওনার।
শুধু কি তাই? উমাইয়াদের অত্যাচারে যত মানুশ ক্ষতিগ্রস্ত হইছিল, সবাইরে ক্ষতিপূরণ দিছেন এই উমর বিন আব্দুল আজিজ, ইনক্লুডিং শিয়া। হাদিস লেখার উপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তিনিই সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে দিছিলেন। ওয়ালিদের সময়ে তিনি যখন মদিনার গভর্নর, সেই সময় হাজ্জাজ ওয়ালিদের কাছে চিঠি লেখছিলেন যে: `ইরাকি মুরতাদগুলা মক্কা-মদিনায় আশ্রয় নিতেছে। এতে সরকারের সমস্যা হইতে পারে।` তার অনুরোধে উমর বিন আব্দুল আজিজরে মদিনার গভর্নরের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হইছিল। খারেজিদের সাথে সংলাপের মাধ্যমে তাদের সাথে সরকারের সন্ধি করাইছিলেন এই উমর বিন আব্দুল আজিজ।
শিয়া ইমামরাও ছিলেন এই খলিফার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। শিয়া ইমামদের মধ্যে হযরত উমর বিন আব্দুল আজিজের সমকালীন ছিলেন ইমাম আল বাকির। তিনি হযরত উমর বিন আব্দুল আজিজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তারে ন্যায়ের পথে থাকার উপদেশ দিতেন। তারে বলতেন: `এ হল উমাইয়াদের ভাল মানুশটা`। এমনকি শিয়াদের অনেকে বিশ্বাস করে যে, হযরত উমর বিন আব্দুল আজিজরে উমাইয়ারা বিষ দিয়া খুন করছিল। তারপরেও, কেন হযরত উমর বিন আব্দুল আজিজ? বোঝা যায়, এই শিয়া টেরোরিস্টদের ক্রোধটা, ক্ষোভটা আসলে উমাইয়াদের উপরে না, ক্ষোভটা হযরত উমর আর তার বংশধরের উপরে৷ বহু বছর আগে পারসিকরা হযরত উমররে খুন করছিল, আজ তারা উনার নাতির কবর ধ্বংস করল।
ঐতিহাসিক চরিত্র হিশেবে উমর বিন আব্দুল আজিজ আমার পছন্দের মানুশ। ভালোবাসার মানুশ। আমি দামেশকের বাজারের সেই উদ্ধত সুন্দর যুবরাজরে দেখতে পাই, যিনি খলিফা হওয়ার পরে প্রায় নিঃস্ব হয়ে যান, ধুলিমলিন হয়ে যান। আমি সেই ছোট্ট যুবরাজরে দেখি, যিনি একবার হযরত আলিরে গালমন্দ করেন; কিন্তু ওস্তাদ উবাইদুল্লাহ বিন আব্দিল্লাহর ধমকে জীবনের মত শুধরে যান। আমি সেই যুবরাজের প্রত্যেকটা দিন দেখতে পারি, যার বাপ চাচা ভাইয়েরা একটা জুলুমের রাজত্ব কায়েম করছিল, আর সেই যুবরাজ প্রাণপণে চেষ্টা করতেছিলেন এই জুলুম বন্ধ করার। আমি সেই যুবরাজরে দেখি, যিনি তার বাপ-দাদা ও সরকারের শত্রুদের সাথে সন্ধি করেন, তাদের ক্ষতিপূরণ দেন; সেই যুবরাজরে আমি দেখি, ক্ষমতা যারে বশ করতে পারে নাই এক মুহূর্তের জন্যেও; যার ইনসানিয়াত ও ন্যায়বোধের কাছে পরাজিত হইছিল উমাইয়াদের জুলুম ও ক্ষমতার দম্ভ।
উমর বিন আব্দুল আজিজ সেই যুবরাজ, যিনি সময়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াইছিলেন। যিনি নিজের বাপ-চাচার বিপক্ষে দাঁড়ায়ে চেষ্টা করছিলেন মানুশরে তার মর্যাদা ও অধিকার ফিরিয়ে দিতে। যিনি মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই করছেন শুধু ক্ষমতা নামের এই বিস্টের সাথে। এত বছর পর, শিয়া টেরোরিস্টরা এইভাবে তার প্রতিদান দিল! শিয়া স্কলারদের মত হইল, কোন রাষ্ট্র দখল করলে, সেখান থেকে শত্রুদের দেহগুলারে বের করে ফেলতে হবে। ইমাম খোরাসানি রিসেন্টলি বললেন যে, হযরর আবু বকর ও উমরের দেহও খুঁড়ে বের করতে হবে। সিরিয়া উমাইয়াদের শাসনে ছিল দীর্ঘদিন, উমাইয়াদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, তাদের হাতে গড়া মসজিদ ও স্থাপনা সিরিয়া যুদ্ধের শুরু থেকেই ইরানি টেরোরিস্টদের হামলার লক্ষ্যবস্তু হইছে। তারা কি সিরিয়া থেকে সব পুরানা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধ্বংস করতে চায়? এই চাওয়া কি সভ্যতার নীতি-নির্ধারকদের চোখে পড়ে না? আল্লাহই এর ফয়সালা করবেন, ইনশাল্লাহ। উমর বিন আব্দুল আজিজরে আল্লাহ মাফ করুন। উমর বিন আব্দুল আজিজরে আল্লাহ মাফ করুন। উমর বিন আব্দুল আজিজরে আল্লাহ মাফ করুন।
























