
এই গল্প কেবল আমার নয়, দেশের প্রতিটি মানুষের
আবু তাহের সরফরাজপ্রকাশিত : আগস্ট ২৫, ২০২২
আমি কোনো প্রতিষ্ঠানে যাই না। যত জরুরিই হোক, যাই না। কেননা, আমি নিশ্চিতভাবেই জানি যে, যে প্রতিষ্ঠানেই যাব সেখানে অযোগ্য অসৎ লোক বসে আছে। সেখানে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে গণতান্ত্রিকভাবে আমি আমার কাজ হাসিল করতে পারব না। ফলে আমি বিরক্ত হবো। চল্লিশোর্ধ্ব বয়সে পৌঁছে আমি এখন আর বিরক্ত হতে চাই না। চুপচাপ নিরিবিলি একটা জীবন কাটাতে চাই। অবশ্যি এই চাওয়ার জন্য জীবনে অনেক অনেক এবং অনেক ছাড় আমাকে দিতে হয়েছে। এখনো দিচ্ছি। তবে শেষপর্যন্ত বিরক্তিহীন একটা জীবনই আমি চাই।
কিন্তু শেষমেষ প্রতিষ্ঠানে আমাকে ছুটতেই হলো। কন্যা ছায়াবীথি শ্যামলিমা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। স্কুলের ছাত্রছাত্রী তথ্য ফর্ম পূরণের জন্য কিছু কাগজ দরকার। স্কুল থেকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে। ফর্ম পূরণ না করলে স্কুল থেকে ছায়াবীথিকে টিসি দিয়ে দেবে বলেও জানানো হলো। এমনিতে স্কুলের পাঠ্যবিষয়ে আমার আস্থা নেই। কন্যাকে যা পড়ানোর আমি বাড়িতেই পড়াই। ওর জন্যেই আমি লিখেছি ‘ছোটদের পদার্থবিজ্ঞান’, যেটা এ বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বিদ্যাপ্রকাশ থেকে বেরিয়েছে। যাই হোক, রাষ্ট্রে বসবাস করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতার কাগজ ভবিষ্যতে কন্যার দরকার হবে। কিছু একটা তো ওকে করে খেতে হবে। তো, প্রতিষ্ঠানে আমাকে ছুটতেই হলো।
ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা থেকে দরকারি কাগজপত্র সংগ্রহ করলাম। এসব কাগজ সংগ্রহ করতে গিয়ে কী পরিমাণ টাকা ও সময় খরচ হয় সে হিসেব দেশের প্রতিটি ভুক্তভোগী মানুষ জানেন। একইসঙ্গে কতটা বিরক্তি নিয়ে চড়া রোদে ঘরে ফিরতে হয়, সে কথাও কারো অজানা নয়। আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যেও আমি টাকা খরচ করলাম, দৌড়ঝাপ করলাম, সময় দিলাম। কন্যার মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র করতে হবে। ফাপড়ে পড়লাম। এর আগেও দু’বার জেলার নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে ঢুঁ মেরে কাজ না হওয়ায় আর যাইনি। জানতে পারলাম, এবার সরকারিভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির কাজ চলবে। স্থানীয় স্কুলের একজন শিক্ষকের কাছে দরকারি কাগজপত্র জমা দিতে হবে। এরপর নির্বাচন কার্যালয় থেকে লোক এসে ছবি তুলবে ও আঙুলের ছাপ নেবে।
তো, আমি কন্যার মায়ের কাগজপত্র তার কাছে জমা দিলাম। এটা মাস দুয়েক আগের কথা। গতকাল বুধবার স্থানীয় স্কুলে নির্বাচন কমিশনের কার্যালয় থেকে লোকজন এলো। দীর্ঘ লাইন এনআইডি প্রত্যাশীদের। এদের মধ্যে তরুণ-তরুণী যেমন আছে, তেমনই আছে ৩০-৪০ ঊর্ধ্ব বয়সী মানুষ। ভাবলাম, এত এত মানুষ তবে এখনো ভোটার নয়! খোঁজ নিয়ে জানলাম, ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ছবি তোলার আগে আগের শিক্ষককে দেয়া কাগজপত্র সঙ্গে আনতে হবে। পাশের কক্ষেই শিক্ষককে পাওয়া গেল। তাকে ঘিরে ভিড়। আমি গিয়ে আমার পেপারস চাইলাম। তিনি স্তূপকরা কাগজের মধ্যে আমার কাগজ খুঁজলেন। পেলেন না। বললেন, সরি ভাই, হারিয়ে ফেলেছি। সমস্যা নাই। এরা আবার আরেক দিন আসবে। আপনি আগামীকাল নতুনভাবে কাগজপত্র রেডি করে আমাকে দিয়ে যান। আমি পরশু পৌরসভায় যাব...
আমার পাশে আমার স্ত্রী। তার কোলে আমার আট মাসের শিশুসন্তান। বাইরে প্রচণ্ড রোদ। ভেতরে মানুষের ভিড়। আমি দরদর করে ঘামছি। ঘামছেন আমার স্ত্রীও। আর শিশুটির তো ত্রাহি অবস্থা। এমনিতে বাচ্চাটি শান্ত স্বভাবের। তবে গরমে সে কান্না জুড়ে দিয়েছে। শিক্ষক মহাশয়কে কিছু বলতে আমার ইচ্ছে হলো না। বেওকুবদের সঙ্গে কথা বলা যায় না। বাইরে এসে রিকশা নিয়ে আমরা ঘরে ফিরলাম। বিকেলের দিকে শুনলাম, শিক্ষকের কাছে জমা দেয়নি এমন অনেকেই নাকি কাগজপত্র নিয়ে কাজ হাসিল করে এসেছে। স্ত্রী আমাকে ধরলেন, তুমি সারা জীবন বোকাই থেকে যাবে। একটু গা নাড়াতে তোমার অনেক কষ্ট, না? কাজগপত্র তো ঘরে ছিলই। শুধু দুটো কাগজের ফটোকপি দরকার ছিল। শহর থেকে সে দুটো করে আনতে বড়জোড় ঘণ্টা দুয়েক লাগতো। আমি বললাম, সে কথা তো ওই লোকটা আমাকে বলেনি। সে তো বলল, কাল স্কুলে গিয়ে তার কাছে আবার কাগজপত্র জমা দিতে।
স্ত্রী বেশ রাগী গলায় বললেন, তুমি কাউন্সিলরের কাছে যাও। গিয়ে বিষয়টা বুঝিয়ে বলো। এরপর উনি কি বলেন, দ্যাখো। সন্ধের আগ দিয়ে আমি স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছে গেলাম। সব শুনে তিনি ওই শিক্ষককে ফোন দিয়ে বললেন, ভাই, আপনি যে তার কাগজপত্র হারিয়ে ফেলেছেন এটা ক্যামন কথা? মানুষটা তো ক্ষতির মধ্যে পড়ে গেছে। এটা তো ভাই ভালো করেননি। ওপাশ থেকে কী কী সব যেন বলল। ফোন রেখে কাউন্সিলর আমাকে বললেন, আগামীকাল গঙ্গাবর্দী স্কুলে ছবি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট নেবে। ওখানে সালাহউদ্দিন স্যার থাকবে। তুমি পেপারস নিয়ে ওখানে চলে যেও।
আমি ঘরে ফিরলাম। গঙ্গাবর্দী আমার এলাকা থেকে বেশ দূরের পথ। আর তাছাড়া, ওই শিক্ষক আগামীকাল ওখানে যাবেন তাহলে আমাকে পেপারস নিয়ে স্কুলে যেতে বললেন কেন? কী জানি! এসব ভাবতে ভালো লাগছিল না। কেবল ভাবনা যে, কন্যার মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র না করাতে পারলে কন্যার স্কুলের পড়াটা আর হবে না। কী যে বিপদ!
আজ সকালে গেলাম গঙ্গাবর্দী স্কুলে। একটি কক্ষে পাওয়া গেল ওই শিক্ষককে। তাকে ঘিরে ছোটখাটো ভিড়। পাশের টেবিলে দাড়িঅলা একজন বলে আছেন। তাকে ঘিরে একটু বেশি ভিড়। আমরা দাঁড়িয়ে আছি। একটা চেয়ারে এনআইডি প্রত্যাশী একজন বসে আছে। তাকে বললাম, ভাই, বাচ্চা কোলে এই যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে ওনাকে একটু বসতে দ্যান। লোকটি উঠে বসতে দিল। আধাঘণ্টা পর শিক্ষক মহাশয় আমার পেপারস ধরলেন। কী একটা তথ্য ফর্ম পূরণ করলেন। এই সময়ের মধ্যে আমি রুমের মধ্যে সিগারেটের কড়া গন্ধ পাচ্ছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল, কেউ সিগারেট খাচ্ছে। আবার মনকে বোঝাচ্ছিলাম, ধুর পাগলা, কেউ হয়তো বাইরে সিগারেট খাচ্ছে। সেই গন্ধ ভেতরে আসছে। এই ঘরে কত কত মহিলা, কয়েক জনের কোলে তো শিশুও রয়েছে।
দাড়িঅলা লোকটার টেবিলের সামনে ভিড় একটু পাতলা হলো। দেখলাম যে, তিনি বেশ আয়েশ করে সিগারেটে টান দিচ্ছেন। আমি থ বনে গেলাম। দেখে তো ভদ্রলোকই মনে হচ্ছে। আরও মনে হচ্ছে, স্কুলের শিক্ষক। আমি তাকে বললাম, ভাই, ঘরে তো মহিলা ও শিশু রয়েছে, আর আপনি এখানে বসে সিগারেট খাচ্ছেন?
তিনি বললেন, আমি এখন খাচ্ছি না। অনেক আগে থেকেই খাচ্ছি।
ও আচ্ছা। কিন্তু এখানে বসে সিগারেট খাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? এটা তো বেআইনি।
লোকটা পাক্কা খবিশের মতো জবাব দিল, কোনটা আইন আর কোনটা বেআইন সেটা আমি ভালো করেই জানি। আপনাকে শেখাতে হবে না।
একটু রাগ হলো। বললাম, তার মানে আপনি যেটা করছেন সেটা আইনিভাবে সমর্থিত? আমার সঙ্গে আমার শিশুবাচ্চা রয়েছে। সিগারেটের ধোঁয়ায় তো তার সমস্যা হচ্ছে, এটা আপনার কাছে কিছু নয়?
তার জবাব, আপনার সমস্যা হলে বাচ্চা নিয়ে আপনি বাইরে যান। আমি এখানে বসেই সিগারেট খাব।
শিক্ষক সালাহউদ্দিন সাহেব আমার একটা হাত ধরে নিচু স্বরে বললেন, ভাই, আপনি বসেন। উনি স্থানীয় কাউন্সিলর।
শিক্ষকের দিকে চেয়ে আমি বললাম, কাউন্সিলর বলেই কি উনি আইন অমান্য করার অধিকার পেয়ে গেছেন?
শিক্ষক বললেন, বাদ দেন। (একজনকে দেখিয়ে) ওই যে লোকটাকে দেখছেন উনি নির্বাচন অফিসের। ওনাকে গিয়ে বাচ্চার কথা বলেন, উনি আপনার স্ত্রীর ফিঙ্গারের ব্যাপারটা সহজে করে দিতে পারবে। আপনাদের আর লাইনে দাঁড়াতে হবে না।
আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। পেপারস হাতে নিয়ে আমি ওই লোকটার কাছে গেলাম। সালাম দিয়ে বাচ্চার কথা বলে তার মায়ের কাজটি করে দিতে অনুরোধ করলাম। এরপর নিচু স্বরে তাকে কাউন্সিলরের ধৃষ্টতার বিষয়টি জানালাম। বললাম, আপনিও তো এই ঘরেই রয়েছেন। এখানে যে কাজের জন্য সবাই এসেছে সেটা আপনাদের কাজ। এর মাঝখানে একজন জনপ্রতিনিধি বসে আরামসে জনগণকে বিরক্ত করছে, আপনি তাকে কিছু বললে তো পারেন।
উনি বললেন, থাক ভাই, বাদ দ্যান। এটা পাবলিক প্লেস। এখানে আসলে আমি কিছু বলতে পারি না। সরকার আমাদেরকে এখানে যে কাজের জন্য পাঠিয়েছে, আমরা সেটাই সুষ্ঠুভাবে করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। খামোখা ঝামেলার দরকার কি!
বললাম, আপনার কথা ঠিক আছে। আমিও ঝামেলা চাই না। কিন্তু একজন গণমাধ্যমকর্মী হিশেবে এ বিষয়ে কথা বলা আমি দায়িত্ব বলে মনে করছি।
লোকটি এবার আমার হাত ধরে বললেন, থাক ভাই, বাদ দ্যান। আপনি পাশের রুমে গিয়ে আমার নাম বলুন, ওরা কাজ করে দেবে। আপনাকে লাইনে দাঁড়াতে হবে না।
আমি কাজ শেষ করে স্ত্রী ও শিশুসন্তানকে নিয়ে বের হয়ে এলাম। হাঁফ ছাড়লাম, যাক, শেষপর্যন্ত কাজটা হলো। কিন্তু কাজটি করার জন্য যে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হলো, সেটা কি কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ছিল? যা ঘটেছে, সেসব কি স্বাভাবিক ছিল?
না, অবশ্যই ছিল না। বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার এই গল্প কেবল আমার নয়, দেশের প্রতিটি মানুষের।
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী