একটি ক্যামেরা এবং একজন বাবার গল্প
শিপন আহমেদপ্রকাশিত : ডিসেম্বর ০৪, ২০২০
আমি মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছেলে। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মচারী। সরকারি কর্মচারীদের পারিবারিক জীবন যেরকম হয়, আমরাও সেরকমই ছিলাম। মাসের প্রথমার্ধ ভালোই যায়, শেষের দিকে টানাটানি। তবে সুখে ছিলাম, এতটুকু নিশ্চিত করেই বলা যায়।
আমি ছিলাম সবার বড়। বড় ছেলে হওয়ার কিছু ঝামেলা আছে। যেমন: ছোট ভাই যদি আমারে মারতে আসে, আমি চাইয়া চাইয়া মাইর খাইতেও পারি না। মাইরা যদি নাকও ফাটায়া দেয়, তখন বাপ বলে, তোরে মারছে তুই কিছু করতে পারিস নাই? আবার যদি উল্টা মাইর দিয়া দেই, তাইলে বলে, তুইতো বড়, তুই মারতে গেলি ক্যান? আমরা ছিলাম না?
একবার নতুন একটা সাইকেল কিনলো। তিন ভাইয়ে লাগল মারামারি। আমি নাকি বড়, ছোটদের অধিকার সবচেয়ে বেশি, ছোট দুই ভাই ভাগ-বাটোয়ারা কইরা সাইকেল চালাইলো সারা জীবন, আমি ভাগে পাইলাম না!
প্রতি ঈদে তিনটা জামা নিয়ে আসতেন বাবা। ছোট দুজনের পছন্দ শেষে যেটা বাকি থাকতো, সেটা আমার। অবেলায় মেহমান আসছে, বাজার থেকে মাছ আনতে হবে, সেটা যত অবেলাই হোক, আমাকেই যেতে হবে, বড় ছেলে তো! মাছের বড় টুকরা, দুধের সর, সবই ওদের জন্মগত অধিকার! বড়দের নাকি ত্যাগেই সুখ। যাই হোক, অম্ল-মধুর স্মৃতি সব।
একবার এক মামাতো ভাই বিদেশ থেকে একটা ক্যামেরা নিয়ে আসলো। বিদেশ থেকে ফেরার পর আমাদের বাড়িতে আসলো সেই ক্যামেরা নিয়ে। ক্যামেরার নাম ইয়াশিকা, এমএফ টু। সারাদিন ক্যামেরাটা আমার কাছে রাখলাম। ভাই যখন ফিরে যাবে, তখন বললাম ক্যামেরাটা রেখে যান, একটা রিল (ফিল্ম) কিনে ছবি তুলবো। আমার ভাই বললেন, না-রেখে যাওয়া যাবে না। নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আমার বাবা ছিলেন পাশেই। ভাই চলে যাবার পর তিনি আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, একটা ক্যামেরার দাম কত? আমি খোঁজ নিয়ে রাতে জানালাম, এই ক্যামেরাটার দাম প্রায় তিন হাজার টাকা।
তিন হাজার টাকা তখন অনেক টাকা। পরের মাসের বেতন পেয়ে আব্বা তিন হাজার টাকা দিলেন আমার হাতে, ক্যামেরা কেনার জন্য। কোনো এক অদ্ভুত কারণে ক্যামেরা দোকানে গিয়ে আমার আর ক্যামেরা কেনার ইচ্ছে ছিল না। ক্যামেরা না কিনে ঢাকা থেকে বাড়ি চলে গিয়ে আব্বার হাতে টাকাটা দিয়ে দিলাম। আব্বা কারণ জিজ্ঞেস করাতে বললাম, ছবি তুলতে অনেক খরচ আব্বা। শুধু শুধু জিনিসটা কিনে লাভ নাই। আব্বা নির্বাক, শুধু বললেন, তোর মায়ের কাছে দে টাকাটা।
বড় ছেলে হিসেবে, কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবার হিসেবে, যেকোনো কারণেই হোক, শখ-আহ্লাদ পূরণের সুযোগ বেশি পাইনি। এটা নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, অন্য সব বাবা-মায়ের মতো আমার বাবা-মাও তাদের সাধ্যের সর্বোচ্চটাই করেছেন আমাদের জন্য।
এবার আসি অন্য একটা প্রসঙ্গে। এটাই আসলে মূল প্রসঙ্গ। বাড়িতে যাবার পর আমার চার বছর বয়সী মেয়ের ছবি তুলছিলাম মোবাইল দিয়ে। পাশের বাসার কার কাছে যেন মেয়ে ডিজিক্যাম দেখেছে, মেয়ে আমাকে বললো আবার এলে একটা ক্যামেরা যেন নিয়ে যাই। মা মোবাইল ধরতে দেয় না। এজন্য তার একটা ক্যামেরা দরকার। মেয়ের কথাটা মাথায় ছিল। অনেকদিন ধরে একটা ক্যামেরা কিনবো কিনবো ভাবছিলাম। কিন্তু শো-রুমে গিয়ে দাম দেখে আর হিসেব মিলে না। সব ক্যামেরাই ৫০ হাজার টাকার উপরে দাম। আমার বাজেট এত বেশি ছিল না। আরেকটু বাড়লে আরো ফিচার বেশি, আর সামান্য বাড়ালে আরো বেশি মেগা-পিক্সেল। বাড়তে বাড়তে সেই বাজেট লাখের উপরে গিয়ে ঠেকলো। এত টাকা ক্যামেরা কেনা উচিত হবে কিনা, কিংবা কিনেই সেটা কি কাজে লাগবে ভাবতে ভাবতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। শেষে কিনেই ফেললাম একটা নাইকন ডি ৭১০০ মডেলের ডিএসএলআর।
ক্যামেরা কেনার পর এখন পর্যন্ত কোনো ছবি তুলি নাই। রাতে ঘুমানোর সময় মাথার কাছে রেখে ঘুমিয়েছি। দোকানে ল্যাপটপের কাছে ক্যামেরাটা রাখা। একবার স্ক্রিনের দিকে তাকাই, আরেকবার ক্যামেরার দিকে তাকাই। এটা একটা ছবি তোলার যন্ত্র, এর দাম এক লাখ টাকা এবং এই জিনিসটা আমি আমার মেয়ের জন্য কিনেছি— এই বোধগুলো ছাপিয়ে বারবার যে কথাগুলো মনে পড়ছে তা হলো, আমার শৈশব-কৈশোর আর পারিবারিক জীবন! বারবার বাবার ক্লান্তু মুখচ্ছবি ভেসে উঠছে মনের পর্দায়।
সত্যি কথা বলতে, আমি এখনো জানি না ক্যামেরাটা কী কাজে লাগবে বা কতটুকু কাজে লাগবে, তবে মেয়ে যখন আরেকটু বড় হবে, সে তখন বুঝবে, ক্যামেরাটা ভালো। এটা তার বাবা তাকে দিয়েছে, এই বোধটা আমাকে যে আনন্দ দিচ্ছে, তার সঙ্গে পৃথিবীর কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। একই সাথে আমার বাবার অনুভূতিটাও নাঁড়া দিচ্ছে সমানভাবে। বাবা কিংবা পুরুষ মানুষদের কষ্টগুলো অন্য রকম, একটু আলাদা। পৃথিবীর সব বাবা আর তাদের সন্তানেরা ভালো থাকুক।
























