চাইমের নস্টালজিয়া ফিরিয়ে আনা জ্যামিং

জাহীদ রেজা নূর

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৯, ২০২০

কথাসাহিত্যিক শামীমা জামানের ফেসবুকে দেখি খালিদ ভাই আর বাবু ভাইকে। নিউইয়র্কেই যেন চাইমের পুনর্জন্ম হয়েছে! গানগুলো আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে গেল পুরনো দিনগুলোয়। আফসোস, সশরীরে উপস্থিত থাকতে পারলাম না। জানতামই না, এরকম একটা আয়োজন ছিল।

বাবু ভাই বা শামীমা, যাদের দুজনকে আমি চিনি, তারা একবারও আমাকে বলেননি। সম্ভবত তারা চাইছিলেন, আমি যেন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাই। তাদের সেই চাওয়া সফল হয়েছে। আল আমিন বাবু ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল নিউ ইয়র্কেই। সে সময় একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে বেশ কিছু গান গেয়েছিলেন তিনি। তার একটা ছিল, নাতিখাতি বেলা গেল শুতি পারলাম না।

হাফিজুর রহমানের কথা ও সুরে এই গান দিয়েই চাইম ও খালিদ ভাই পৌঁছে ছিলেন সারা বাংলার ঘরে ঘরে। যদিও আমি সারা জীবন ঢাকা শহরের মানুষ, কিন্তু আমার বাড়ি বৃহত্তর যশোরের মাগুরায়। সে কারণে বলাই যায়, এই গানই রয়েছে আমাদের এলাকার রাবার স্টাম্প লাগানো।

বাবু ভাই আরো এক কারণে আমার আত্মার আত্মীয়। ঘাতকবিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার একজন মানুষ তিনি। শামীমা জামানের সাথে লেখালেখির সূত্র ধরেই আলাপ। নানা প্রসঙ্গে ভারি ভারি অথবা কী হালকা কথাবার্তা হয় বৈকি। খালিদ ভাইয়ের সঙ্গে সরাসরি আমার পরিচয় নেই। আমি চাইমের গান প্রথম শুনি ৯০ দশকের শুরুতে। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে আমি পাঁচ বছর কাটিয়ে দিয়েছি।

আমাদের দুই জুনিয়র বন্ধু তুহিন আর সুকান্ত আমাদের শহরে পড়তে আসার পর তাদের কাছেই চাইমের ক্যাসেট প্রথম দেখি। সে সময় চাইম, ফিডব্যাক ও অবসকিওর নামগুলোর সাথে পরিচিত হই। দেশ ছাড়ার আগে আজম খান, ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজ, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফকির আলমগীরকেই দেখতাম আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের অনুষ্ঠান আলোকিত করছেন। সোলস এলো কিছুদিন পর। রেনেসাঁ।

‘মন শুধু মন ছুয়েছে’, ‘আচ্ছা কেন মানুষগুলো’সহ বেশকিছু গান সত্যিই আপ্লুত করলো শ্রোতাদের। তবে একথা বলতে একেবারেই সংশয় নেই, আমাদের আইডল ছিলেন, ছিলেন বলি কেন, সব সময়ই থাকবেন, আজম খান। আমাদের সিদ্ধেশরী স্কুলের ছাত্র ছিলেন তিনি। সেটাই শুধু তাকে এতটা ভালবাসার একমাত্র কারণ নয়।

মঞ্চে তার ক্যারিশম্যাটিক উপস্থিতি রোমাঞ্চিত করতো আমাদের। একবার মহড়ার জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না বলে তিনি আমাদের নিউ ইস্কাটনের বাড়ির গ্যারেজটা দেখতে এসেছিলেন। এখানেই রেওয়াজ করবেন। আমরা কিশোরকূল আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলাম। ‘হাইকোর্টের মাজারে’, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘আসি আসি বলে তুমি’...

আহা, জীবনটাকে এক রকমভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি! তারুণ্যের হৃৎস্পন্দন বলতে আজম খানকেই বুঝতাম তখন। সেই মুগ্ধ অস্থির সময়টি এখনো আমাকে স্পর্শ করে আছে। শামীমার ফেসবুকে যখন দেখলাম খালিদ ভাই বসে গান করছেন, তার সঙ্গে বাবু ভাই নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র একহাতে সামলে খালিদ ভাইয়ের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাচ্ছেন— তখন বুঝলাম, এই মুহূর্তে এই অনুষ্ঠানটা দেখাই আমার সবচেয়ে জরুরি কাজ।

লিও টলস্টয়ের একটি ছোটগল্পে সবচেয়ে জরুরি সময় বেছে নেয়ার কথা বলা হলে উত্তর এসেছিল, এই মুহূর্তটাই সবচেয়ে জরুরি। না অতীত, না ভবিষ্যৎ— বর্তমানই তৈরি করে অতীত, গড়ে তোলে ভবিষ্যৎ। আমি জানি না অতীতের এই গানগুলো বর্তমানে শুনছি বলেই সেটা আমার কাছে জরুরি মনে হলো কিনা!

বর্তমান একটা বড় ব্যাপার। বাবু ভাই আর খালিদ ভাইয়ের এক হওয়া একটা বড় ব্যাপার। ২৫ বছর পর ব্যান্ডের এই জ্যামিং একটি সুন্দর ভবিষ্যতের বার্তা দেয়। খবর পেয়ে যাই, খুব শিগগিরই এরা আবার আসবেন ময়দানে। ‘নাতিখাতি বেলা গেল’, ’কীত্তনখোলা নদীরে আমার’, ‘টোকাই’, ‘পড়ালেখা শেষ করে’, ‘আজকে রাতে যে গান তুমি মোরে শোনালে’, ‘মনে করো আমায় খুঁজে পেলে না কোথাও’ গানগুলো কি চেনা চেনা লাগছে?

খালিদ ভাইয়ের কণ্ঠে চাইমের এই গানগুলো তখনকার সময়ে সবার ঘরে ঘরে বাজতো। ‘ও আমার হাঁসের ছাওরে’, ‘জয়জগা নন্দন ঘটিবাটি’, ’তোমরা গোসসা না হন ভাইরে ভাই’, ‘সেদিনো আকাশে ছিল চাঁদ’... কত কত গান! এরপরে খালিদ ভাই তার সলো ক্যারিয়ারেও অসাধারণ সব গান গেয়েছেন, কোনো কারণে ফেরানো গেল না তাকে’, ‘সরলতার প্রতিমা’, ‘যতটা মেঘ হলে বৃষ্টি নামে‘, ‘যদি হিমালয় হয়ে’, ‘আমায় যদি পড়ে মনে’, ‘এক মহাকাল ব্যথা’, ‘ঘুমাও তুমি’ এগুলো এক একটা মাস্টারপিস।

যা আবার এই প্রজন্মের শনকা শউনকদেরও প্রিয়। নতুন গানগুলো যে হচ্ছে, কার ক’টা গান মানুষের মন জয় করতে পারছে? অথচ একটা সময় ছিল, ছড়িয়ে থাকা ব্যান্ডগুলো যে গান করতো সেই গানগুলো থাকতো মানুষের মুখে মুখে। এখন সে রকম রোমাঞ্চ আসে না কেন? নাকি আমাদের বয়স হয়েছে বলে আমরা নস্টালজিয়ায় ভুগতে থাকি? সেটা সত্য হলে এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরাও কেন এই গানগুলো শোনে বেশি?

যাই হোক, খালিদ ভাই আর বাবু ভাই যেন আমাদের সেই সময়টাকে ফিরিয়ে দিলেন যে সময়টা আমাদের জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। আমাদের জীবন বলতে, আমাদের সাংস্কৃতিক জীবন হিসিবেও তাকে গ্রহণ করতে পারেন।

লেখক: কথাসাহিত্যিক