জুয়েল মাজহারের চিলতে গদ্য ‘ছাগাসুর’
প্রকাশিত : জুন ০৮, ২০২০
সে-রমণী, তাহাকে অল্পকাল চিনি। অশ্বেতর প্রাণিদিগের জন্য তাহার সে কী মায়া! প্রভাতে পুষ্পচয়নের পরিবর্তে শষ্য ও বিবিধ তৃণাহরণেই তাহার সকল মনোযোগ; তাহাও কেবল এইসব প্রাণিদিগের জন্য। হ্রেষার পরিবর্তে ইহাদের কেবল রহিয়াছে প্রহরের গাঁড়ফাটানো রাসভনিনাদ। কাকস্য পরিবেদনার সহিত এই রাসভস্বর মিশাইয়া বারান্দায় বসিয়া বিবিধ ককটেল বানাই। তাহা পান করি। গলদেশ দিয়া নহে, মন দিয়া, কর্ণকুহরে ঢালিয়া।
রমণীটিকে দেখিয়া কাম জাগে। এ-বিষয়ে তাহার প্রভূত প্রশ্রয় আঁচ করি। তবে কাহারো তরফে কোনোরূপ বাক্য বিনিময় নাই।
ঈগলচঞ্চুর ন্যায় তাহার বক্র নাসিকাখানি তিলনিন্দিত। হাকালুকি হাওরের হাঁসিনীর গ্রীবার ন্যায় তাহার গ্রীবা। তদুপরি তাহার পাউটি লিপস। তাহার নিচে একখানি ডাঁশা জড়ুল। আর তাহার বগলে ঘাম। বগল ক্ষৌরহীন দেখিয়া সঙ্গত পুলক জাগে।
আমার বারান্দার লাল জবাটিকে দেখিবার অছিলায় তিনি ডাগর চক্ষু তুলিয়া তাকান। সেই চক্ষে অথির বিজুলি। তিনি শ্যামাঙ্গিনী। তাহার কম্বুগ্রীবাটি আহ্লাদে ঈষৎ কাত। এক্ষণে জবাফুলটি আরো গরিমাময়, আরো লাল হইল। হইলে হউক! তাহাতে আমার কি!
তাহার হস্তধৃত তৃণাদি মাতৃহারা খচ্চরশিশুটি খাইবে, সদা-ভ্যাঁ-ভ্যাঁ-করা বকরিদল খাইবে; খাইতে খাইতে ইহারা গুটলিময় নাদা ত্যাগ করিয়া ক্রমশ উঠান ভরিয়া তুলিবে। তাহাতেও রমণীর স্নেহ ও প্রশ্রয়।
ইহাদিগের মধ্যে একটি প্রাণিই কেবল ব্যতিক্রম। খাবারে ইহার মনোযোগ নাই। আঁচ করিলাম, প্রাণিটির ইচ্ছা মদীয় ইচ্ছার নিকটতর। এই কথা কাহাকেও কদাপি বলা যাইবে না। আপনাদিগকেও নহে। কেননা লোকে আমাকে ভালো লোক বলিয়া মান্য করে। কেহ কেহ ‘কত্তা কত্তা’ বলিয়া ষাষ্টাঙ্গ প্রণামে উদ্যত। মান্য লোকদিগের অঙ্গ হষরিত হওয়া বোধ করি অনুচিত। অন্তত অস্থানে। লোকে এমত ভাবে।
সংসারে লোকের ভাবাভাবিকে মূল্য দিয়া চলিতে হয়। আমাকে এবং— যিনি বুঝিয়াও না বুঝিবার ভান করিয়া খোঁপা বাঁধিবার ছলে কুচযুগ আন্দোলিত করিয়া আড়চোখে আমাপানে চাহেন—তাহাকেও। ইহাই রীতি। এই অতি শিষ্ট অণ্ডহীন, যোনিহীন মনুষ্যজঙ্গলে এই বিধান। এমত বিধানে যদিও এক মুষ্ঠি ধান্য ফলিবে না।
পাঁঠাটির সেই বালাই নাই। ইহা স্বাধীন, কেননা ইহা ছাগাসুর, তদুপরি তরুণ। আর ইহার অঙ্গের সে কী গরিমা। কী তেজ! জিভ বাহির করিয়া, মুখে তপ্ত ফেনা তুলিয়া, সে তাহার চর্মঘেরা, লোমশ খাপ হইতে দেমোক্লিতাসের তরবারিসদৃশ অঙ্গটি বাহির করিল। আচমকা। আর তাহা পেন্ডুলামবৎ দুলিতে থাকিল। লাল। এবং জবারও অধিক। সূর্যেরও অধিক। ইহার রঙ কেবল আসামদেশের কামরূপে ফলিত নাগা মরিচের রঙের সহিত তুলনীয়।
আমরা উভয়েই, লজ্জাহেতু, অন্য দিকে মুখ ঘোরাই। চকিতে তাহার মুখের একপাশ দেখিলাম। মনে হইল তিনি ঈষৎ বিব্রত; তথাপি তাদৃশ আমোদিত। ফটকদরোজা দিয়া তিনি অতি দ্রুত ভেতরবাটীতে অন্তর্হিত। আর আমি ছাগাসুরের দিকে অসীম তিতিক্ষা লইয়া তাকাই।
পাঁঠাটির প্রতি আমার গোপন ঈর্ষা হইল। এমন সময় প্রতিবেশীর ট্রেসপাসার নচ্চার হুলোবিড়ালটি কোথা হইতে আসিয়া আমার দিকে ‘আইবল টু আইবল’ তাকাইয়া কহিল ‘ম্যাঁও’।
লেখক: কবি
























