টিএস এলিয়টের কবিতা

ভূমিকা ও অনুবাদ: জুয়েল মাজহার

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৮

Let us go then, you and I,
When the evening is spread out against the sky
Like a patient etherized upon a table....

এই তিনটি চরণ, বলা চলে, দাগ কেটে দিয়েছিল আধুনিক ইংরেজি কবিতার যাত্রাপথের। অন্যভাবে বলা যায়, ইংরেজি কবিতার আধুনিকতার যাত্রাবিন্দু এই ত্রিচরণ। অমূলকও নয় তা: The Love Song of J. Alfred Prufrock নামের এই কবিতা এমনসব উপাদান, এমনসব কুললক্ষণ, এমনসব দৃশ্য আর চিত্রকল্প, এমনসব অনাস্বাদিতপূর্ব বিষয় আর ভাব নিয়ে বিশ্বকবিতার পাঠকের সামনে হাজির হয়েছিল, যা বৈপ্লবিক। বিখ্যাত আর বহুল পঠিত- আলোচিত ‘পোড়ো জমি’ (The waste Land) কবিতাটি রচনার বহু আগে লেখা হয়েছিল এই কবিতা। ‘পোড়ো জমি’ কবিতারও মানসবীজ আর ভিত্তিমূল ছিল এই The Love Song of J. Alfred Prufrock. এলিয়ট প্রথমে এই কবিতাটির নাম দিয়েছিলেন Prufrock Among the Women. তবে ১৯১৫ সালে Poetry ম্যাগাজিনে ছাপা হওয়ার সময় নাম দেন The Love Song of J. Alfred Prufrock. এর দু’বছর পরে, ১৯১৭ সালে, এটি ছাপা হয় ‘প্রুফ্রক অ্যান্ড আদার অবজারভেশন্স’ নামের বইতে।

The Love Song of J. Alfred Prufrock বিশ শতকের ইউরোপীয় আধুনিকতার (Modernism) অনেক বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে: ভাবের খণ্ডায়ন, হতাশা, বিশ্বাসের সঙ্কট, অর্থহীনতা, উদ্বেগ, অস্তিত্বের অসারতার অনুভূতি, সবকিছুতে দ্বিধা, নৈরাজ্যবাদিতা, নিখিল নাস্তি আর নিখিল নেতি। এলিয়ট আধুনিক মানুষকে এসবেরই প্রতিভূ করে তুলেছেন তার কবিতাবলিতে। The Love Song of J. Alfred Prufrock দিয়ে যার শুরু। টি. এস. এলিয়ট’র সম্বন্ধে গৌরচন্দ্রিকা অনাবশ্যক। বিশ শতকের সবচেয়ে আলোচিত এই কবির খ্যাতি ও প্রভাব তাঁর মৃত্যুর এতো-এতো বছর পরেও চূড়াস্পর্শী। কেউ কেউ বিশ শতককে ‘এলিয়টীয় শতক’ বলতেও আগ্রহী।

‘জে. আলফ্রেড প্রুফ্রকের প্রেমগান’ তাঁর প্রথম দিককার কবিতাবলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এ কবিতায় এলিয়টের কবি-প্রতিভা যতোটা স্ফূর্তিলাভ করেছে, সে তুলনায় তাঁর অতি-বিখ্যাত, অতি-আলোচিত কবিতা ‘The waste Land’ বা ‘পোড়ো জমি’-তে ততোটা পায়নি। জে. আলফ্রেড প্রুফ্রকের প্রেমগান কাব্যগুণে ও সিদ্ধিতে ‘পোড়ো জমি’-র চেয়ে শ্রেয়তর। তাঁর প্রথম দিককার কবিতা-সংকলন ‘Prufrock and Other Observations’ আধুনিক ইংরেজি কবিতার ইতিহাসে সবচেয়ে উন্মোচক ও উন্মীলক ঘটনা। একইসঙ্গে এ-কবিতা নানা কারণে বিশ্বকবিতার ইতিহাসে বড় এক মাইলফলক; ইংরেজি কবিতার ইতিহাসে এই কবিতাই (ইউরোপীয়) সর্প্রবথম আধুনিকতার রক্তাপ্লুত ধ্বজাটি উড়িয়েছে। আধুনিকতাবাদ ছিল রোম্যান্টিকতাকে চুরমার-করে-দেওয়া এক নতুন মতবাদ— সব ভাবালুতার অবসানের সূচক; প্রকৃতিলগ্নতা, সারল্য আর সহজিয়ানার বিপরীতে জটিলতার উদ্বোধন। The Love Song of J. Alfred Prufrock এ এলিয়ট নিজেই নিজের অপর সত্তাকে বেড়াতে বের হবার আমন্ত্রণ
জানিয়েছেন। এ পর্যন্ত সবই ঠিকঠাক। কিন্তু এরপরই পাঠকের পূর্বধারণা বা অভ্যাসের পাটাতন গুঁড়িয়ে যায়, ভাবালুতা চুরমার হয়ে যায় যখন সন্ধ্যাকে তুলনা করা হয় ইথার- অবশ রোগীর সঙ্গে— Like a patient etherized upon a table;

সম্ভবত এই কবিতা— বরং বলা ভালো এই কবিতার প্রথম তিনটি চরণ— ইংরেজি
কবিতার গতিপথকে চিরকালের মতো ঘুরিয়ে দ্যায় অন্য পথে; ইংরেজি
কবিতাকে চালিত করে এক নিষ্করুণ, জটিল, লৌহ-ইষ্টকময় নগর-জঙ্গল বা ধাতব
মরুভূমির পথে— যাতে পুষ্পচয়নের অবকাশ নেই কোনো; বরং আদ্যন্ত ছড়ানো তাতে কাঁটা
ও ক্যাকটাস। ধোঁয়াও ধূলিতে একাকার এর নগর-নিসর্গ। যেখানে হলদে কুয়াশা এসে নাক
ঘষে জানালার কাচে— yellow smoke that rubs its muzzle on the window-panes. আর,
soot that falls from chimneys ঝুলকালিতে আবিল এমন শত-শত চিমনি ঢেকে রাখে যার আকাশরেখা।

এই কবিতা যেন এক বীজ। পরবর্তীকালের ইংরেজি কবিতার ভবিষ্যতের মন্ত্রবীজ; এলিয়ট নামের এক ভবিষ্য-নৃপতির উজ্জ্বল উষ্ণীষের চকিত ঝলক দেখায় এই কবিতা। এভাবে বললে বাড়িয়ে বলা হয় না। এই কবিতাটি আধুনিক নগরজীবনের অন্তঃসারশূন্যতা আর অর্থহীনতা, এর স্থূল ও কদর্য রূপ, অভিনয়পটুতা, কপটতা আর নিরাবেগ ঔদাসিন্যের নতুন নান্দীপাঠ যেন। কবিতাটিতে এলিয়টের অসাধারণ কবিত্বশক্তির, বিপুল কল্পনা-প্রতিভার চূড়ান্ত স্ফূর্তি ঘটেছে; প্রতিভা যেন শতবাহু, শতডানা বিস্তার করেছে এ- কবিতায়— শুরু থেকে শেষ অবধি। এ-কবিতায় এলিয়ট কোনো সময়-সঙ্গতি মেনে চলেন নি; যেনবা ইচ্ছে করেই স্বাভাবিক যুক্তিপরম্পরা ভেঙে দিয়েছেন। তাই একের পর এক আপাত-বিসদৃশ ইমেজে এগিয়ে যেতে থাকে এ-কবিতা। ক্যাওস আর হারমোনি একসঙ্গে ঘর করে এখানে; হাত ধরাধরি করে চলে। পরস্পরের প্রতিপক্ষ বা অ্যাডভারসারি হিসেবে নয়, বরং অল্টার ইগো হিসেবে জায়গা বদল করে চলে। এলিয়ট-বর্ণিত ‘কল্পনার লজিক’ (There is a logic of imagination as well as a logic of concepts) যেন প্রতিফলিত এ-কবিতার কাঠামো ও আত্মায়।

S’io credesse che mia risposta fosse
A persona che mai tornasse al mondo,
Questa fiamma staria senza piu scosse.
Ma percioche giammai di questo fondo
Non torno vivo alcun, s’i’odo il vero,
Senza tema d’infamia ti rispondo.

উপর্যুক্ত এই ৬টি লাইন The Love Song of J. Alfred Prufrock কবিতার এপিগ্রাম। এটি নেয়া হয়েছে দান্তের (Dante) ‘দিভিনা কোম্মেদিয়া’-র (Divina Commedia) ইনফার্নো অংশ থেকে। সেখানে আমরা গুইদো দ্য মন্তেফেল্‌ত্রোর (Guido da Montefeltro) মুখে ভয়াল এক নরকের বর্ণনা পাই, যে নরক থেকে নিষ্কৃতি লাভের কোনও আশা তার নেই।

কবিতার নায়ক জে. আলফ্রেড প্রুফ্রকও এমনই এক মনো-নরকের বাসিন্দা; যে-নরক থেকে বের হবার কোনো পথ খুঁজে আর পায় না সে। তাই ফ্যান্টাসি বা অতিকল্পনাই তার আপাত আশ্রয়। আসলে প্রুফ্রক কোনো চরিত্র নয়, বরং নিছকই একটি নাম; ক্রম ক্ষীয়মান, ক্ষীণতর এক স্বর কেবল। কবিতার শুরুতেই টেবিলে শায়িত ইথার-অবশ রোগীর সঙ্গে তুলনীয় যে সান্ধ্য- মুহূর্তের নাটকীয় বর্ণনা পাই, তা আসলে প্রুফ্রকেরই অর্ধচেতন মানসিক অবস্থাটির প্রতিরূপ। প্রুফ্রকের সিদ্ধান্তহীন, দ্বিধা-কম্পিত মনটাও অলস-বিবশ, নির্কলরব সন্ধ্যাটির মতোই অসাড়তালিপ্ত। প্রুফ্রক নিজেকে আধুনিক নগরনাট্যের এক ট্র্যাজি কমিক্যাল-হিস্ট্রিক্যাল অ-রোম্যান্টিক আর অরাজকীয় ‘হ্যামলেট’ বলেই মনে করে; নিজেকে তার মনে হয় হাস্যাস্পদ, নিকৃষ্ট এক ভাঁড়; অন্য সবার চোখে যে এক কাপুরুষ বা ঊন-পুরুষ। তার স্বগতোক্তির মধ্যে ‘আমি’ ও ‘তুমি’ আসলে তার নিজেরই দুই বিভক্ত সত্তা। তার প্রেমগান তার আপন মনের ইনফার্নোর বাইরে কখনোই ব্যক্ত- উচ্চারিত হবে না। প্রুফ্রক নিজে তা আলবৎ জানে। কেবলি একঘেঁয়ে পথ, কুয়াশা-বেড়ালের ছবি, বাইবেলের জন দ্য বাপ্‌তিস্ত, লাজারাস, মিকেলেঞ্জেলো, সাগরতলের জলধিমহল, পাটল-লাল শৈবালের মালা-শোভিত সন্তরণপটু সাগরকন্যাদের দল আর শেক্সপিয়রের নাটকের কুশীলবগণ— সবাই যুগপৎ ভিড় করে আসে তার মনে। ‘সব ঝুট হ্যায়’! বড়ো বেশি নিস্তরঙ্গ আর অকিঞ্চিৎকর তার জীবন। একঘেঁয়ে,পানসে,পাণ্ডুর আর নিরুৎসব। একাকিত্বে ধূসর এই জীবন আত্মনিগ্রহের আর অবদমনের নিয়তি-নিগড়ে বাঁধা। আদ্যন্ত তা নৈরাশ্যমলিন, নিরুদ্যম, নিস্তরঙ্গ,বিষণ্ন আর করুণ। প্রুফ্রক তাই একটিবারও সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারে না। তার অপৌরুষ-লাঞ্ছিত জীবন এতোই অর্থহীন যে, পিচফল খেতেও তার সাহসের দরকার পড়ে। তাই সে বলে: ‘কফির চামচে আমি পরিমাপ করেছি জীবন’। তার এ-জীবন মানসিক মৃত্যুরই অন্য নাম। আর, প্রুফ্রক জীবন্ত লাশ এক; নিজেরই লাশ প্রুফ্রক বয়ে বেড়াচ্ছে নিজেরই কাঁধে।

যদি জানিতাম, যারে আমি দিতেছি উত্তর
পুনরপি সে ফিরিবে এ–মরজগতে
তবে ফের এই শিখা জ্বলিত না মোর
অপিচ কদাপি কেহ এ-পাতাল হ’তে
জীবন্ত ফেরেনি; শুনি যাহা তাহা সত্য হ’লে
তব কাছে করিব বর্ণন নিন্দাভীতি বিনা।

তুমি আর আমি মিলে চলো তবে যাই,
যখন ছড়ানো সন্ধ্যা আকাশের গায়
ইথার-অবশ এক রোগী যেন টেবিলে-শোয়ানো;

চলো যাই, আধ-ফাঁকা পথগুলো দ’লে
এক-রজনীর-শস্তা-হোটেলে হোটেলে
অস্থির রাতের যতো ক্ষীয়মান প্রলাপ এড়িয়ে
আর ওই ঝিনুক-শোভিত আর কাঠের কুচিতে ছাওয়া রেস্তোরাঁর ভিড়ে
সেইসব পথের চলন
ফন্দি-আঁটা একঘেঁয়ে তর্ক যেমন
এরা সবে নিয়ে চলে তোমায় বিহ্বলকর জিজ্ঞাসার দিকে…
জানতে চেয়ো না তুমি, অহো, ‘এটা কি’?
যাই আর চলো গিয়ে দেখি।

ঘরটিতে মহিলারা আসে আর যায়
মিকেলেঞ্জেলোর কথা জিভের ডগায়।

হলদে কুয়াশা তার পিঠ ঘষে জানালার কাচে,
হলদে ধোঁয়াটি তার নাক ঘষে জানালার কাচে,
জিভে সে চাটলো ওই গোধূলির যতোগুলি কোণ,
থমকে দাঁড়াল এসে নর্দমার খুঁটিগুলো ঘেঁষে,
পড়ুক পিঠেতে তার চিমনির যতো কালি-ঝুল,
বারান্দা গলিয়ে সে একবার হঠাৎ লাফাল,
আর এই আশ্বিনের সুকোমল রাতখানি দেখে,
বাড়িটাকে একবার পাক দিয়ে ঘুমে গেল ডুবে।

এবং আলবত সে তো পাবেই সময়।
সে-হলদে কুয়াশা এসে শার্সিতে পিঠ ঘ‌‌’ষে ঘ’ষে
চুপিসারে পথ বেয়ে চলে;
গড়তে একটি মুখ, তুমি চেনো, দেখা পেতে সেসব মুখের;
মিলবে সময় ঢের, মিলবে সময়;
মিলবে সময় ঢের হননের আর সৃজনের।
পড়ে আছে কাজ যতো, সেসবেরও রয়েছে সময়
আর যে-হাতেরা এসে উঁচিয়ে প্রশ্ন এক ছুড়ে দ্যায় তোমার থালায়
সেসব হাতেরও আছে অঢেল সময়,
সময় তুমিও পাবে সময় আমিও পাবো বাগে
এবং অযুতবার দ্বিধাচালে দোলার সময়,
এবং অযুতবার দেখা আর যাচিয়ে দেখার,
টোস্ট আর চা-পানের আগে

ঘরটিতে মহিলারা আসে আর যায়
মিকেলেঞ্জেলোর কথা জিভের ডগায়।

এবং থাকবে হাতে অঢেল সময়
‘পারবো তো?’ আর, ‘আমি পারবো তো?’-এমত ভাবার।
থাকবে সময় ঢের পিছু হটে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামবার
গজিয়েছে টাক এক মাঝখানে চাঁদিতে আমার---
(বলবে সকলে: দ্যাখো, কেমন পাতলা হয়ে যাচ্ছে ওর চুল)
আমার প্রভাতী-কোট আমার কলার চিবুক ছুঁয়েছে নির্ভুল
নেকটাই শোভন-জাঁকালো, তবু একটি মামুলি পিনে আটকানো স্থূল
(বলবে সবাই: ওর হাত-পাগুলো কেমন মাজুল)
তেমন সাহস কই
লণ্ডভণ্ড করবো নিখিল?
একটি মিনিটে ঢের রয়েছে সময়
দেখা আর যাচিয়ে দেখার, সে-ও আরেক মিনিটে তছনছ

যেহেতু জেনেছি সব, আমার সকল কিছু জানা-
চেনা ওই ভোরগুলি, অপরাহ্ন, গোধূলির ক্ষণ
কফির চামচে আমি পরিমাপ করেছি জীবন;
ওপাশের ঘর থেকে ভেসে আসা সুরের আড়ালে
পতনের লয়ে ওই লীয়মান স্বর আমি চিনি
তাই কী করে সাহস আমি পাই?

আর ওই চোখগুলো চিনি আমি, চিনে গেছি সবই
যেসব চোখেরা এসে পরিপাটি তোমাকে সাজায়।
এবং যখন আমি, মেপে নেওয়া, পিনে-গাঁথা ছটফট করি
এবং যখন আমি, পিনে-গাঁথা, দেয়ালে কাতরাই
তাহলে কী করে শুরু করি
থুথুসহ ছুড়ে দিতে প্রত্যহের এঁটো-অবশেষ?
কী করে সাহস আমি পাই?
আর ওই বাহুগুলি চিনি আমি, চিনেছি সকলি-
বাজুবন্ধপরা ওই বাহুজোড়া নগ্ন আর শাদা
(তথাপি, বাতির আলোতে হাল্কা বাদামি পশমে তারা ঢাকা!)
এ-কি পোশাকবাহিত কোনো ঘ্রাণ
মন শুধু করে আনচান?
জোড়াবাহু টেবিলে এলানো কিংবা একখানি শালে আছে ঢাকা।
সাহস কী করে আমি পাই?
আর, কী করে করবো আমি শুরু?

বলবো কী, ওই সরু পথ ধরে গেছি আমি গোধূলিতে হেঁটে
দেখেছি কতো না জানলার বাইরে-মাথা, হাতাঅলা-জামা গায়ে
নিঃসঙ্গ লোকেদের পাইপের ধোঁয়া উড়ে যেতে?

ক্রুদ্ধ ভোঁতা একজোড়া থাবা আমি যদিবা হতাম
বেড়াতাম সুমসাম সাগরের তল চিরে চিরে।

আর ওই অপরাহ্ন, সন্ধ্যা, আহা, কী সুখে ঘুমায়!
দীর্ঘ সরু আঙুলের আলতো পরশে মসৃণ,
ঘুমন্ত… ক্লান্ত…কিংবা ভণিতায় পার করে দিন,
তোমার আমার পাশে, এখানে সে, মেঝেতে সটান
মনে আমি পাবো জোর, কুলফি-বরফ কেক চা-পানের শেষে
একটি নিমেষ, ওকে ঠেলে দিতে ওর নিজ সংকটের দিকে?
যদিও কেঁদেছি আর করেছি উপোস, কান্না আর করেছি প্রার্থনা,
যদিও দেখেছি আমি মুণ্ড আমার (ধরেছে কিছুটা তাতে টাক)
অর্ঘ্য সাজানো এক ঢাউস থালায়,
আমি নই প্রেরিত পুরুষ–- মহিমার কী-বা আছে তায়;
দেখেছি আমার সেই গরীয়ান ক্ষণ শুধু কেঁপে নিভে যায়
এবং দেখেছি আমি অনন্তের দ্বারী আমার পাতলুন ধরে
হাসিতে লুটায়,
অল্প কথায় বলি, মনে লাগল ডর।

পেয়ালা, মোরব্বা আর চা-পানের পর্ব শেষ করে
চিনেমাটি তৈজস, আর, তোমাকে-আমার-বলা গল্পের ফাঁকে
হতো কি তেমন কোনো লাভ
দ্বিধা ঝেড়ে হাসিমুখে যদি আমি দিতাম প্রস্তাব,
পৃথিবীকে দুমড়ে এক পিণ্ডবৎ আকার দিতাম
গড়িয়ে দিতাম একে বিহ্বল প্রশ্নের দিকে
আর বলতাম: “লাজারাস আমি, এসেছি মৃতের দেশ থেকে
তোমাকে জানাবো আমি, জানাবো সকল কথা, তাই ফিরলাম”
আর সে-রমণী যদি শিয়রে বালিশ পেতে বলে:
“ব্যাপারটা আদৌ আমি এভাবে ভাবিনি
এমত ভাবনা মনে স্থান দিইনি’’

আর তাতে মিলতো না কোনোই সুফল
মিলতো না ফায়দা কোনো তাতে
সূর্যাস্ত, দেউড়ি আর আর্দ্র যতো
পথের উপরে

উপন্যাস, চায়ের পেয়ালা আর মেঝেতে-গড়ানো যতো
স্কার্টের পরে-
এবং এই যে এটা, আরও বহু আছে তারও পর?
আসলে যা বলতে চাই, বলা সম্ভব?
জাদুর লণ্ঠন যেন স্নায়ুর বিন্যাস থরে-থরে উদ্ভাসিত
করেছে পর্দায়:
তাতে আর কী-বা ফল হবে
যদি সে-রমণী তার শিয়রে বালিশ পেতে, ছুড়ে ফেলে শাল
জানালার দিকে ঘুরে বলে:
“ব্যাপারটা আদৌ আমি এভাবে ভাবিনি
এমত ভাবনা মনে স্থান দিইনি ।’’

নই আমি হ্যামলেট, রাজার দুলাল, কপালে ছিলো না সেটা লেখা;
শুধু এক পার্শ্বচর লর্ড, দলভারী করাটাই কাজ
কুমারে মন্ত্রণাদান, একটি-দুটি দৃশ্য উন্মোচন
ধূর্ত, কূট, সতত সজাগ;
নগণ্য, অভাজন, এক ক্রীড়ণক, যদি কাজে লাগি ধন্য হই
মাথাটা কিঞ্চিৎ ভোঁতা, তবু মুখে বড় বড় বুলি পইপই
মাঝেমাঝে, হতে হয়, অন্যদের হাসির খোরাক
কখনোবা হদ্দ এক বোকার শামিল

বয়স হচ্ছে…আমি যাচ্ছি বুড়িয়ে
পরবো আমি পাতলুনের প্রান্ত মুড়িয়ে

টেরি কেটে ফেলবো পেছনে? আর, ভয় পাবো পিচফল খেতে?
ফ্ল্যানেলের শাদা পাতলুন পরে হাঁটবো সৈকতে ।
কতো জলপরীদের গান আমি শুনেছি নীরবে কান পেতে

ভাবি না, আমাকে শোনাবে তারা গান

দেখেছি, ঢেউশীর্ষে চড়ে তারা সাগরে মিলায়
চিরে চিরে চলে তারা তরঙ্গের সফেদ কুন্তল;
বায়ুর চাপড় লেগে ক্ষণে শাদা, ক্ষণে কালো জল।
আমরা কতো না কাল কাটিয়েছি জলধির মহলে-মহলে
সাগরকন্যারা পাশে, পরেছে পাটল-লাল শৈবালের মালা
গেলাম অতলে ডুবে, যখন ভাঙালো ঘুম মানুষের গলা।