
কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’
পর্ব ১৪
প্রকাশিত : জুলাই ০৬, ২০২৫
১৯৮৩ সালের ১০ ডিসেম্বর বিচারপতি আফম আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা পুরোপুরি নিজের দখলে নেন এরশাদ। এখন চলছে এরশাদ যুগ। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে বন্দুকের নলের মুখে ভয় দেখিয়ে সরিয়ে দেন তিনি। দেড় বছর রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসেননি, পুতুল বসিয়ে ক্ষমতার ছড়ি ঘুরিয়েছেন সেনাপ্রধান হিসেবে। এবার রাষ্ট্রপতির চেয়ারে পুরোপুরি বসে উর্দি খুলে সাফারি পরেছেন। সাফারি এখন বাংলাদেশের নতুন ফ্যাশন, মোসাহেবি স্যুট। সরকারি অফিসের কর্মকর্তাদের মধ্যে সাফারি পরার হিড়িক পড়ে গেল।
জিয়ার দুরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ খুব দ্রুত স্বনির্ভর হয়ে উঠছিল, একাশি সালের মে মাসে তাকে হত্যা করার পর উন্নয়নের সেই সড়ক থেকে দেশ অনেকটাই ছিটকে পড়েছে। এরশাদ কি দেশকে আবার সেই সড়কে এনে দাঁড় করাতে পারবেন? জিয়ার সঙ্গে সকলেই এরশাদকে তুলনা করছেন এজন্য দুজনই সামরিক পোশাক খুলে রাষ্ট্রনায়ক হয়েছেন, কাজেই দুজনের কাজের ধরন ও দেশপ্রেম একই রকমের হবে। সাত্তারকে সরিয়ে এরশাদ টেলিভিশনে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই ভাষণে দ্রুত নির্বাচন দেবার কথা বলেছিলেন কিন্তু নির্বাচন না দিয়ে দেড় বছর পর নিজেই রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসে পড়ায় তার লোভের জিহ্বা বেরিয়ে পড়েছে।
প্রথম ভাষণে তাকে যতটা বুড় ও ক্লান্ত লেগেছিল সেখান থেকে যেন সাপের পুরনো খোলস ছেড়ে তিনি চকচকে উজ্জ্বল নতুন চামড়ায় অতি দ্রুত বিকশিত হচ্ছেন। তার বয়সের ঘড়ি কি উল্টো দিকে ঘুরছে? তিনি তরুণী পরিবেষ্টিত থাকতে পছন্দ করেন, কবিতা ও কবিদের ভালোবাসেন এবং কবিতা ভালোবাসেন বলে তার একটি কোমল, প্রেমময় মন আছে, এইসব কথা চারদিকে বলাবলি হচ্ছে। তিনি তার রচিত কবিতা দেশের প্রধান দৈনিকগুলোর প্রথম পাতায় প্রকাশের নির্দেশ দিতেন এবং সকল সম্পাদক এরশাদের একই কবিতা সব কাগজের প্রথম পাতায় ছাপতেন।
১৯৮৩ সালের অক্টোবর মাসে এক মজার ঘটনা ঘটে। সাংবাদিক সম্মেলনে সবাই এরশাদকে নানান রাজনৈতিক প্রশ্ন করছিলেন। হঠাৎ সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সাংবাদিক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, `মে আই আস্ক ইউ অ্যা নন-পলিটিক্যাল কোয়েশ্চেন?` এরশাদ সম্মতিসূচক মাথা দোলালে তিনি বলেন, `আপনি ক্ষমতায় আসার আগে কেউ জানতো না আপনি একজন কবি। এখন সব পত্রিকার প্রথম পাতায় আপনার কবিতা ছাপা হয়। পত্রিকার প্রথম পাতা তো খবরের জন্য, কবিতার জন্য নয়। বাংলাদেশের প্রধানতম কবি শামসুর রাহমানেরও তো এই ভাগ্য হয়নি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আপনার কবিতা প্রথম পাতায় ছাপানোর জন্য কি কোন নির্দেশ জারি করা হয়েছে?`
এরশাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করলে কেউ তা গ্রাহ্য করেননি, এরশাদ ভাবলেন উত্তরটা তাকেই দিতে হবে। তিনি সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, আমি দেশের জন্য এত করি এইটুকু দেবেন না আমাকে? জাহাঙ্গীর হোসেন সাহসের সঙ্গে আবারও বলেন, প্রশ্ন করার অধিকার আমার, উত্তর দেবার অধিকার আপনার। আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি। একথা বলে তিনি প্রশ্নটা আবার করেন। এরশাদ এতে কিছুটা বিব্রত হন এবং এরপর থেকে কাগজের প্রথম পাতায় তার কবিতা ছাপা পুরোপুরি বন্ধ না হলেও অনেক কমে যায়। আমার যতদূর মনে পড়ে এর পরেও আল মুজাহিদী ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় এরশাদের কবিতা ছেপেছিলেন। জাহাঙ্গীর হোসেনের শাস্তি হয় এতে, ঢাকা থেকে তাকে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়। ব্যাস, এইটুকুই।
আরো একটি ঘটনা বলি, কবি আব্দুল হালিম আজাদ এরশাদকে ব্যাঙ্গ করে বাংলার বাণীর সাহিত্য পাতায় একটি ছড়া লেখেন। তিনি বাংলার বাণীতেই চাকরি করতেন। অফিসে সরকারি সংস্থার গাড়ি চলে আসে। হালিম সাহেবকে প্রেসিডেন্ট ডেকেছেন। তিনি উর্দি পরা নিরাপত্তা বিভাগের লোকজন দেখে ভয় পেয়ে যান। ছুটে যান শেখ সেলিমের কাছে। শেখ সেলিম বলেন, প্রেসিডেন্ট ডাকছে না গিয়া কি পারবি? যা, দেখ কী বলে। না যাওয়ার তো কোনো উপায়ও ছিল না। এরশাদ তাকে বলেন, ভালোই তো ছড়া লেখো, আমিও তো একজন কবি। কবির বিরুদ্ধে আরেকজন কবির কী এরকম লেখা ঠিক?
এরপর এরশাদ তাকে বলেন, বাংলার বাণীতে বেতন টেতন ঠিক মত পাও?
পাই স্যার, মাঝে মাঝে বাকি পড়ে।
অন্য কোথাও চাকরি করবে নাকি বলো?
না স্যার।
ঠিক আছে যাও।
ব্যাস এ-পর্যন্তই। তাকে বড়ো ধরনের কোনো শাস্তি পেতে হয়নি।
আমি এখন নিয়মিত কবি জসীম উদদীন পরিষদের সাহিত্য সভায় যাই। সাহিত্যসভা হয় দু`সপ্তাহে একবার, প্রতি অল্টারনেট শুক্রবারে। পরিষদের কিছু নিয়ম আছে, কেউ একটির বেশি লেখা পড়তে পারবেন না, কেউ নিজের লেখার ওপর আলোচনা করতে পারবেন না, সমালোচক তার লেখা নিয়ে যা খুশি তাই বলতে পারবেন, লেখক বা কবি সেই সমালোনার ওপর কোনো কথা বলতে পারবেন না।
আলোচনা-সমালোচনা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই, আমার সমস্যা একটাই। ১৫ দিনে একবার সভা, কবিতা পড়া যাবে মাত্র একটা, এটা মেনে নিতে পারছি না। কারণ ১৫ দিনে তো আমি লিখে ফেলি অনেক কবিতা, বাকিগুলোর কী হবে?
রোজ দুপুরে খেয়ে-দেয়ে আমিনুল হক আনওয়ারের বাসায় যাই, তিনি অফিস থেকে আসেন, আমিই তাকে রিসিভ করি। আমার সামনেই তিনি ভাত খান, গুল দিয়ে দাঁত মাজেন, পান মুখে দেন, প্রতিদিন সেই একই নীল পাঞ্জাবি পরেন। এরপর আমরা দুজন হাঁটতে হাঁটতে গুদারাঘাট, ডাক্তার জিয়ার বাসায় যাই। ওখানে অনেকক্ষণ আড্ডা দিই, দুই তিন দফা চা খাই। এরপর মাঝে মধ্যে অন্য কোথাও আড্ডা দিতে যাই। আমি এখন হক সাহেবের ছায়াসঙ্গী, আমার এই সঙ্গটা তিনি নিজেও খুব পছন্দ করেন। একদিন আমি না গেলে লোক পাঠিয়ে খোঁজ নেন, আমার কোনো সমস্যা হলো কিনা।
আমিনুল হক আনওয়ার আমাকে বাংলা কবিতার ইতিহাস বলেন, কবিতার বিভিন্ন আন্দোলনের কথা বলেন, বাংলা কবিতার প্রচলিত ছন্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প, রস, অলংকার এইসব শেখান। কিছু শিখি কিছু শিখি না। কিছু বুঝি কিছু বুঝি না। প্রসঙ্গত এরশাদের কথাও ওঠে। হক সাহেব এরশাদকে বলতেন কবিরাজ। প্রথম দিন আমি শব্দটির মর্মার্থ বুঝিনি। তিনি একটা প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বলেন, কবিদের রাজা না তিনি, তাই কবিরাজ বলি। পরক্ষণেই বলেন, আসলে এখন বাংলাদেশের কবিরাজ হচ্ছেন শামসুর রাহমান। তুমি শামসুর রাহমানের কবিতা বেশি বেশি পড়বে।
একদিন হক সাহেবের খুব মন খারাপ। আমি বলি, মন খারাপ কেন? তিনি বলেন, শোনো, একদিন রাজা তার দরবারে অনেক মানুষকে দাওয়াত দিলেন, একজন কবিকেও দাওয়াত দেন। খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে তিনি দেশের গণ্যমান্য অতিথিদের হীরে-জহরত, স্বর্ণমুদ্রা এইসব উপহার দেন। যখন কবির পালা এলো, রাজা কবিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, আপনি হলেন আমার রাজ্যের সবচেয়ে সম্মানিত মানুষ, আমি জানি অর্থ বিত্ত, স্বর্ণমুদ্রা, হীরে-জহরত কিছুই আপনাকে দেবার মতো উপযুক্ত উপহার নয়। দরিদ্র কবি তো দারুণ খুশি, রাজা বোধ হয় তাকে এর চেয়েও মূল্যবান কিছু উপহার দেবে। রাজা তখন কবির গলায় একটি ফুলের মালা পরিয়ে দেন। বলেন, এর চেয়ে মূল্যবান আর কী হতে পারে আমার কবির জন্য।
কবি মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে আসেন। বুঝলা, কবির কষ্ট কেউ বোঝে না। এরপর বলেন, দাও, বিশটা টাকা দাও। আমি পকেট থেকে বিশ টাকা বের করে দিলে তিনি চিৎকার করে ডাকেন, শাহজাদা, এই শাহজাদা।
কালো, লম্বা এক তরুণ এসে মাথা নিচু করে সামনে দাঁড়ায়। তিনি বলেন, এই হলো আমার শাহজাদা। সারাদিন শুধু ঘুমায়, কোনো কাজ করে না। যাও দোকান থেকে চা নিয়ে এসো। আজ আর রেস্টুরেন্টে যাব না। শরীরটা ভালো নেই।
সেই বিকেলটা আমরা তার জীর্ণ কুটিরেই কাটাই। রোজকার মতো সেদিন আর ডাক্তার জিয়ার বৈঠকখানায় যাওয়া হলো না। প্রথম দিকে যখন তিনি বলতেন, চলো যাই। আমি বলতাম, কোথাও যাব? তিনি হাসি দিয়ে বলতেন, কোথায় আবার, মোল্লার দৌড় তো মসজিদ পর্যন্তই, ডাক্তার সাহেবের বাসায়।
এর সপ্তাহখানেক পরের একদিন। তিনি অফিস থেকে আসেন, খাওয়া-দাওয়া করেন, গুল মাজেন, পান মুখে দেন কিন্তু পাঞ্জাবি পরেন না। আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলি, মসজিদে যাবেন না? তিনি বলেন, না, আজ মসজিদ এসেছিল।
পরে আমাকে বুঝিয়ে বলেন, কোনো এক কারণে আজ সকালেই ডাক্তার সাহেব তার কাছে এসেছিলেন। তিনি এখন বাসায় নেই, অন্য কোথাও গেছেন। চলবে