তারিক বিন মুতালিবের গদ্য ‘তর্কের কুপ্রভাব’
প্রকাশিত : জুন ০৩, ২০২০
এক.
এই এক সমস্যা। ইদানীং কারো সাথে পরিচয় হলে, অনলাইনে বা অফলাইনে অনেকে প্রশ্নটা করে, আপনি কোন দল করেন?
আমি সরল সিধা জবাব দিই, আমি কোন্দল করব কেন? কোন্দল করা ভালো নয়।
সেও নাছোড় বান্দ। না মানে, আপনি কোনো দলের সাথে জড়িত কিনা তাই-ই জানতে চাইছি।
জ্বি। আমি মুসলমান।
সেটা তো আমরা সবাই-ই। বলছিলাম, আপনি কোন সংগঠন বা আদর্শের অনুসারী?
ভাই, আমার সংগঠন ইসলাম। আমি মুসলিম ভ্রাতৃত্বের কন্সেপ্টে বিশ্বাসী।
বেশিরভাগ প্রশ্নকর্তা এই উত্তরে সন্তুষ্ট হন না। সম্ভবত কোনো একটা দলের নাম শুনলে তারা পছন্দ করতেন। তর্ক করা যেত। তাদের ভাবখানা এমন, উনি তো শুধু মুসলমান। উনার সাথে কী আর তর্ক করব!
দুই.
তর্ক বর্তমানে আমাদের জাতীয় সমস্যা। সবাই তর্ক করতে চায়। জিততে চায়। এটাকে ঈমানি দায়িত্ব মনে করে। কারো ভুল দেখলে সংশোধন করা উচিত। তবে এটার জন্য তর্ক কোনও ভালো উপায় নয়। দাওয়া আর তর্কের পার্থক্যই এরা বোঝে না।
যদি সত্যিই আপনার নিয়ত হয় অন্যের সংশোধন, তবে তর্ক নয়, আলোচনা করুন। তাদের জন্য দুআ করুন। মধ্যরাতের মোনাজাতে তাদের জন্য চোখের পানি ফেলেন। আর পারলে নিজেকে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরেন। আস্থা অর্জন করেন। দেখবেন, মানুষ আপনার কথা শুনবে।
ধর্ম নিয়ে আমিও আলোচনা করি। তবে সবার সাথে নয়। কাছের কিছু মানুষের সাথে। শেখার জন্য করি। শুধু শেখানোর জন্য নয়। ফিতনা সৃষ্টি করাকে আমি প্রচণ্ড ঘৃণা করি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি সে ব্যক্তির জন্য জান্নাতের মধ্যবর্তী ঘরের জিম্মাদার, যে হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও ঝগড়া পরিহার করে। (আবু দাউদ (ইফা) ৪৭২৫)
তর্কের চেয়ে জান্নাতের ঘরটা আমার কাছে বেশি প্রিয়।
তিন.
তর্কশাস্ত্রের সবচেয়ে বিপদজনক শাখা ইলমুল কালাম। অর্থাৎ আক্বিদার বিষয়ে যুক্তিভিত্তিক তর্ক। এটা এতটাই বিপদজনক যে, প্রথমদিকের আলিমরা এটা নিষিদ্ধ মনে করতেন। যারা ইলমুল কালাম চর্চা করেন, যেমন ইমাম আবু হানিফা, আবু ইউসুফ (র.) প্রমুখ তাদেরকে জিন্দিক বলেছেন। ইমাম শাফেয়ী (র.) খেজুরের ডাল ও জুতা দিয়ে তাদেরকে পেটাতে বলেছেন।
পরবর্তী আলিমরা বৃহত্তর কল্যাণে কিছু শর্তসাপেক্ষে কালামশাস্ত্র চর্চা করেছেন। কিন্তু এটা আলিমদের ভেতরই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে সবাই ফক্বিহ, সবাই মুজতাহিদ। আক্বিদাগত বিষয়ে তর্ক দেখলে নিজেকে সংবরণ করতে পারে না। অথচ কুতর্ক থেকে দূরে থাকাটাও দ্বীনের কাজ। আমরা বিভেদের আগুন নিভাতে না পারি, অন্তত যেন তাতে বাতাস না দেই।
চার.
একটা ফল ততক্ষণ পর্যন্ত বাড়তে থাকে, যতক্ষন সবুজ থাকে। পেকে গেলে পচন শুরু হয়। আমাদের অন্তরও ফলের মতো সবুজ থাকা দরকার। প্র্যাক্টিসিং মুসলিমদের অন্তরে শয়তান কখনো কখনো এই ওয়াসওয়াসা তৈরি করে। তারা পেকে যায়। তখন তারা ভাবতে শুরু করে, তারাই ঠিক। বাকিরা ভুল।
অথচ কে যে সিরাত্বাল মুস্তাক্বিমে আছে, তার ফয়সালা হবে হাশরে। তাই উমরসহ (রা.) অন্তত ৩০ সাহাবি নিজেদের ব্যাপারে মুনাফিকির ভয় করতেন। এই ভয় অন্তরে থাকা সাহাবাদের সুন্নাত। আমাদের অন্তরেও এই ভয় থাকা জরুরি। অথচ আমরা কত নিশ্চিন্ত!
আসুন, অন্তর সবুজ রাখার চেষ্টা করি। সকল সালাতে, মোনাজাতে প্রাণের আকুতি দিয়ে বলি, ইহদিনাস সিরাত্বাল মুস্তাক্বিম। হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে সরল পথ দেখান।
মৃত্যু পর্যন্ত এই দুআ করে যাই। এটাই হোক আমাদের মানহাজ।
পাঁচ.
অন্যের ভুল ধরায় মজা আছে। নিজের মাঝে ওই ভুল নেই, ভেবে একধরনের আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায়। হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা। যার ভুল ধরা হয়েছে, তার উচিত ছিল, আত্মতৃপ্তি পাওয়া। একটা ভুল তো অন্তত সংশোধন করা গেল।
আসুন, এবার অন্যকে বাদ দিয়ে একটু নিজেকে নিয়ে বসি। প্রতিদিন অন্তত একটা নিজস্ব ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে ভাবি। সেটা সংশোধন করি। প্রতিদিন না পারলে অন্তত প্রতি সপ্তাহে, মাসে...
মির্জা গালিবের একটা পঙক্তি অনুবাদ করেছিলাম, কবি নিজেকে সম্বোধন করে বলছেন:
উমর ভার গালিব ওহি গালতি করতা রাহা
ধুল চেহরে পর থি ওর আয়না সাফ করতা রাহা।
জীবনভর গালিব তুমি, এই ভুলটাই করে গেলে
ধুলো ছিল চেহারাতে, আয়না সাফ করে গেলে।
























