তুহিন খানের গদ্য ‘আযওয়াজ শব্দের তরজমা নিয়া বিতর্ক’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২১

সুরা ফোরকানে আল্লাহ তার অনুগত বান্দা-বান্দিদের কিছু নিশানি বয়ান করছেন। যেমন: তারা যমিনে ধীরস্থিরভাবে চলাফেরা করবে, জাহেলদের উদ্ভট কথাবার্তার জবাবে শান্তির পয়গাম দেবে ইত্যাদি। এরই ধারাবাহিকতায় আসছে এই সুরার ৭৪ নং আয়াত, (মুমিনরা দুয়া করে যে) হে আমাদের রব, আমাদের জীবনসঙ্গী ও সন্তানদের তুমি আমাদের চোখের শীতলতা বানিয়ে দাও, আমরা যেন মুত্তাকিদের জন্য অনুসরণীয় হইতে পারি, সেই তৌফিক দাও।

এই আয়াতে `আযওয়াজ` শব্দের তরজমা নিয়া বিতর্ক। এমন না যে, এই বিতর্ক আগে হয় নাই, বা এইটা কোরআনের ভাষারীতির পরিপন্থী কোন তর্ক। সাধারণত এই শব্দের অর্থ করা হয় `স্ত্রী`। মানে, `হে আল্লাহ, আমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের...`। `আযওয়াজ` শব্দটা আরবি `যাওজ` শব্দের বহুবচন, যার অর্থ `জোড়া`। এই শব্দটা জামাই বা বউ— দুজনরেই ইন্ডিকেট করে। কোরআনেও এই জোড়া অর্থেই শব্দটা ব্যবহার হইছে, একাধিকবার। একজন ফেসবুকে লিখছে, এই আয়াতে `আযওয়াজ` অর্থ `জীবনসঙ্গী` নিলেই বেটার, তাতে স্বামী ও স্ত্রী দুইজনই ইনক্লুডেড হয়। আলাদাভাবে নারীর উপর `চোখের শীতলতা` হওয়ার চাপ পড়ে না।

তার এই কথার জবাবে কেউ কেউ লিখছেন যে, এগুলা নাকি পশ্চিমা চিন্তা-ভাবনার প্রভাব। এগুলা ইসলামের প্রতি বিরোধ ও বিতৃষ্ণা তৈয়ার করে। এগুলা স্রেফ কারেক্টনেসের আলাপ, এতে কইরা আর কোন ফায়দা হয় না। এগুলা হইছে জেন্ডার স্টাডিজ পড়ার বদ আছর ইত্যাদি। তো আসেন, আমরা একটু দেখি যে, আসলেই এগুলা `পশ্চিমা চিন্তা-ভাবনা` বা `ইসলামবিরোধী` কথাবার্তা কিনা।

প্রথমত, এই আয়াতে `আযওয়াজ`র অর্থ `স্ত্রী` হওয়াই কি বাধ্যতামূলক? এইখানে `জীবনসঙ্গী` অর্থ নিলে কি খুব সমস্যা? তা কিন্তু না। বরং কনটেক্সট অনুসারে, জীবনসঙ্গী অনুবাদটাই বরং বেটার। কীভাবে? সুরা ফোরকানের এই আয়াতগুলাতে আল্লাহর অনুগত বান্দাদের কিছু নিশানির বয়ান আছে, আগেই বলছি। এই বান্দাদের মধ্যে, `ইবাদুর রহমান`দের মধ্যে, নারীরাও তো আছে, তাই না? তো, আল্লাহ যখন বলতেছেন যে, আল্লাহর বান্দা তারাই যারা এটা করে না, ওটা করে, ওটার ধারেকাছেও যায় না, এভাবে চলে ইত্যাদি, এর মধ্যে তো নারীরাও ইনক্লুডেড। এরই ধারাবাহিকতায় আসছে এই আয়াত, যে— আল্লাহর বান্দারা সবসময় এই দোয়া করে: `হে আমাদের রব! আমাদের জীবনসঙ্গী ও সন্তানদের তুমি আমাদের চোখের শীতলতা বানিয়ে দাও, আমরা যেন মুত্তাকিদের জন্য অনুসরণীয় হইতে পারি, সেই তৌফিক দাও।`

এখন আপনি বলেন, যদি এইখানে `আযওয়াজ`র অর্থ আপনি `জীবনসঙ্গী` করেন, তাইলে সমস্যাটা কী? প্রায় সব বড় বড় মুফাসসিরই বলছেন যে, এখানে `কুররাতু আইয়ুন` বা `চোখের শীতলতা` মানে হইল, ঘরের লোকজনরে আল্লাহর আনুগত্য করতে দেখা, ঈমানদার হিশাবে মরতে বা জীবন যাপন করতে দেখা। তাইলে, এই কামনা তো একজন নারীর থাকতেই পারে যে, সে তার জামাইরে আল্লাহর অনুগত দেখবে, দেখে চক্ষু শীতল করবে! নাকি জামাইরা সব গোড়া থিকাই আল্লাহর অনুগত থাকে, ফলে এইখানে `আযওয়াজ` মানে আবশ্যকীয়ভাবে `স্ত্রী`ই হইতে হবে? তা যদি না হয়, তাইলে `জীবনসঙ্গী` তরজমার সমস্যা কই?

আরবি বাকরীতি বা কোরআনের ব্যবহারবিধি মোতাবেকও এই অর্থ নেওয়ায় কোন সমস্যা নাই। কোরআনে বেশ কয়েকবারই `আযওয়াজ` শব্দটা জোড়া বা সঙ্গী অর্থে ব্যবহৃত হইছে। এবং মজার ঘটনা হইল, আরবিতে স্বামী-স্ত্রীকে বুঝাইতে একটামাত্র শব্দই ব্যবহৃত হয়— যাওজ। মানে জোড়া৷ অথচ বাঙলায় দেখেন যে, `স্বামী` বা `পতি পরমেশ্বর`র মত শব্দ তৈরি হইছে জামাইরে ইন্ডিকেট করার জন্য।

এই আয়াতটা একটা দুয়াও বটে। প্রায়ই নামাজের শেষে মুনাজাতে আমরা এই দুয়াটা করি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই করি। এখন আপনি একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবেন। এই আয়াতে `আযওয়াজ`র অর্থ যদি `স্ত্রী`ই ফিক্সড কইরা দ্যান, তাইলে একজন নারীর কাছে এই দুয়ার আবেদন কী দাঁড়ায়? একজন নারী কি তাইলে দুয়া করবে যে, হে আল্লাহ! আমার স্ত্রীকে আমার চোখের শীতলতা বানিয়ে দেন? সাধারণত কোরআনের যে আয়াতগুলা দুয়াবাক্য হিশেবে ব্যবহৃত হয়, সেগুলা আম বা ব্যাপক অর্থ ধারণ করে। এই আয়াতে `আযওয়াজ`র অর্থ `স্ত্রী`ই হবে, এমন কথা বললে, আয়াতটা কেবল পুরুষদের দুয়াবাক্য হইয়া থাকে। অথচ আয়াতের এসেন্স ও পটভূমি বিশ্লেষণ কইরা স্পষ্টতই আমরা বুঝি যে, এইখানে মূলত জীবনসঙ্গী আর সন্তানরা যেন আল্লাহওয়ালা হয়, সেই দোয়া করতে বলা হচ্ছে মুমিনদের। তো, নারীরা কি তাদের জামাইদের জন্য এই আয়াত দিয়ে দুয়া করতে পারবে না? `আযওয়াজ`র অর্থ `জীবনসঙ্গী` করলে খুব কি পাশ্চাত্য চিন্তার চর্চা হইতেছে? খুব `ইসলামবিরোধী` কাজ হইতেছে?

এই আয়াতে দুইটা শব্দ আছে— `আযওয়াজ` আর `যুররিয়্যাত`। সাধারণ বাঙলা হইল, জীবনসঙ্গী ও সন্তানসন্ততি। তাফসিরের কিতাবগুলায় এই আয়াতের সাথে রিলেটেড একটা অবস্থার কথা তুইলা ধরা হইছে। যেমন, তাফসিরে আলুসিতে আল্লামা আলুসি রহ. (মৃ. ১২৭০ হি.) বলতেছেন: ইসলামের শুরুর দিকে সমাজের অবস্থাটা এমন ছিল যে, বাপ মোসলমান, পোলা কাফের। জামাই মোসলমান, বউ কাফের। তো এই অবস্থাটা মোসলমানদের জন্য খুবই কঠিন ও বেদনাদায়ক ছিল। ওই সময়ই তারা এই দুয়াটা/আয়াতটা বেশি বেশি পড়তেন। আব্দুর রহমান ইবনে জুবায়ের ইবনে নাফিরের বরাতে একই কথা বলছেন আল্লামা তাবারিও, তার তাফসিরে তাবারিতে।

এখন আপনি ভাবেন। তার মানে, আয়াতটার অর্থ অনেক ব্যাপক। নিজের আহলের জন্য হেদায়েতের তামান্না, তাদের দ্বীনের পথে চলতে দেখার খায়েশ, এইটাই হইল এই আয়াতের মূল অর্থ। তো ইসলামের শুরু যুগে কি এমন ছিল না যে, বউ মোসলমান আর জামাই কাফের? বা পোলা মুসলমান আর বাপ কাফের? সেক্ষেত্রে বউ জামাইয়ের জন্য বা পোলা বাপের জন্যেও দোয়া করতে পারবে এই আয়াতের মাধ্যমে, মুফাসসিররা তাই লিখছেন। তাইলে, এই আয়াতে `আযওয়াজ`র অর্থ `স্ত্রী` কইরা রাখাই কি বিশাল জরুরি কাজ? ইসলামসম্মত আমল? `জীবনসঙ্গী` শব্দটা কি আরো সুন্দর ও বেটার অর্থ দ্যায় না? জামে` মানে` হয় না?

আসলে, আমাদের সমাজে একদল মানুশ আছেন, যারা  কোন ধরনের চিন্তাভাবনা ছাড়াই ইদানীং হরেদরে `ইসলামবিরোধী`, `পাশ্চাত্য চিন্তা` এইসব ট্যাগ লাগান। আরে মিয়া, পাশ্চাত্য চিন্তা কী জিনিশ? পশ্চিমের এসেন্স কী? সে তার রুহ কোত্থেকে হাসিল করছে? পাশ্চাত্য কি একদিনে আকাশ থেকে নাজিল হইছে? ইতিহাস এই সাক্ষ্যই দ্যায় যে, আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার গোড়াপত্তন হইতই না, যদি আরবরা না থাকত। এইটা সবাই খুব গদগদ গলায় বলেনও। কিন্তু একেকটা ঘটনায় এমনভাবে `পাশ্চাত্য সভ্যতা` উচ্চারণ করেন, যেন পশ্চিম মানুশের ইতিহাস, দুনিয়ার চিন্তা ও চর্চার ইতিহাস, মুসলিমদের শাসন ও সভ্যতার ধারাবাহিকতা ইত্যাদি থেকে পুরাপুরি বিচ্ছিন্ন, আসমান থেকে নাজিল হওয়া একটা জিনিশ।

এইখানে দুইটা ঘটনা বলতে চাই। বেশ কয়েক বছর আগে বন্ধুদের এক আড্ডায় আমি বললাম যে, আমার ধারণা, বাইবেলে যে আদমরে হাওয়ার ফল খাওয়ানোর কাহিনী, এইটা কোরআন সমর্থিত না। দাবির পক্ষে আমি দুইটা দলিল দিলাম। এক. কোরআনে সুরা বাকারায় এবং সুরা আরাফে এই সংক্রান্ত যেসব আয়াত, সেগুলা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, শয়তান দুইজনরে একত্রে কুমন্ত্রণা দিছিল, এবং একত্রেই তারা পাপ করছিল৷ কর্মফলও তারা একত্রেই ভোগ করছিল। শয়তানও তাদের দুইজনরে একসাথে ডাক দিছিল। এমন না যে, আগে হাওয়ারে ডাইকা নিয়া কুমন্ত্রণা দিছে, পরে সে আইসা আদমরে ফল খাওয়াইছে। দুই. এই মর্মে কোন সহিহ হাদিস নাই। এগুলা সব ইসরাইলি রেওয়ায়েত।

তো, সবাই ব্যাপারটা নিয়া ভাববে, জানাইল। একজন হুট কইরা বইলা বসল যে, এইগুলা ভাষিক ব্যাপারস্যাপার, এসব দিয়া কোরআনের মর্ম সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া মুশকিল। তো আমি বললাম, তাইলে আপনি কী দিয়া নেবেন? কোরআনের শব্দও তো গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বিধিবিধানের ক্ষেত্রে ফকিহদের মতভেদ তৈরি হইছে খালি শব্দগত তফাতের কারণে। গুরুত্বপূর্ণ তো। আমি উনারে আরো বললাম যে, তাইলে আপনি আমারে প্রমাণ দ্যান যে, হাওয়া আদমরে ফল খাওয়াইছে এই ঘটনা সহিহ। উনি বললেন প্রমাণ দেবেন, আজতক দ্যান নাই। আর পরে তো এই বিষয়ক আর্গুমেন্ট অনেক প্রমিনেন্ট স্কলারের লেখাপত্রেই পাইছি। তো, উনি হুদাই আমার বিরোধিতা করছিলেন ওইসময়; জাস্ট নিজের ইগোরে স্যাটিস্ফাইড করাই ছিল উনার উদ্দেশ্য। এই জিনিশের সাথে ইসলামের মৌলিক ঈমান-আকিদা বা আমলের তেমন জরুরি কোন সম্পর্ক আছে কিনা, তাও উনি ভাবেন নাই। জাস্ট নতুন কথা, একটু নারীদের ফেভারে, ফলে নারীবাদী আলাপ, পাশ্চাত্য চিন্তা। তাই নেগেট করা লাগবে।

আরেকটা ঘটনা বলি। আমার এক ছোট ভাই এক ইসলামি পত্রিকায় তার মাদ্রাসা লাইফের স্মৃতি লেখছে। তো, ওই লেখায় সে সমকাম নিয়া তার নিজের কিছু চিন্তা বর্ণনা করছে। যেমন, সে লেখছে: অনেক হুজুর এই কাজ করত, আমরাও বুঝতাম এইগুলা খারাপ, বাট এইগুলা নিয়া আমাদের কোন চিন্তা ছিল না। যেমন, লোরকার সমকামিতা নিয়াও আমাদের কোন মাথাব্যথা নাই।

তো, পত্রিকার সম্পাদক এই অংশ নাই কইরা দিলেন। জিগেশ করলে বললেন, এই অংশ ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। ইসলাম সমকামরে প্রতিহত করতে বলে। সামাজিক জায়গা থেকে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াইতে বলে। আমার ছোট ভাই বলল যে, আমি তো আমার ব্যক্তিগত জায়গা থেকে লেখছি। রুইখা দাঁড়ানো টারানো, এগুলা তো সমকাম প্রপার লিগাল ওয়েতে প্রমান হইলে পরের আলাপ। আমার তো, অ্যাজ আ স্টুডেন্ট, এইরকম রুইখা দাঁড়ানোর কোন অনুভূতিই ছিল না। আমি জাস্ট কীভাবে জিনিশটারে দেখছি তখন, তাই বলছি। তো, পরে উনি বলতেছেন যে, ওনার একটা পার্সোনাল ঝামেলার কারণেই মূলত উনি ওই জায়গাটা বাদ দিছেন। তখন আমার ছোটভাই বলল যে, আপনার পার্সোনাল সমস্যা থাকলে আমারে বলেন, আমি নিজেই বাদ দেব। কিন্তু আপনি আমারে `ইসলামবিরোধী` বা আমার লেখারে `ইসলামবিদ্বেষী` সাব্যস্ত করতে চান ক্যান?

তো, এইরকম অনেক লোকই আছেন এখন। এনাদের মাথায় পাশ্চাত্য চিন্তার ভূত সওয়ার হইছে। যাই দ্যাখে, নেগেট করার একটাই রাস্তা— পাশ্চাত্য চিন্তা। অনেকে নিজের পার্সোনাল অপিনিয়নরে জয়যুক্ত করার জন্য অপরের ভ্যালিড আর্গুমেন্টরে বইলা দ্যায়— ইসলামবিরোধী। জাস্ট তর্কে জেতা বা ইগো বাঁচানোর জন্যেও অনেকে এগুলা বলে। এরকম ঘটনা অনেক দেখছি আমি।

হযরত উম্মে সালামা একদিন দাসীরে দিয়া চুল আঁচড়াইতেছেন। হঠাৎ মসজিদ থেকে আওয়াজ আসলো, `আইয়ুহান নাস! এই লোকেরা শোন!` উনি তাড়াতাড়ি চুল বাইন্ধা উইঠা দাঁড়াইলেন। দাসী বলল, নবিজি তো `এই লোকেরা` (মানে, এই পুরুষেরা) বলছেন! আম্মাজান উম্মে সালামা সাথেসাথে চোখ পাকিয়ে দাসীরে বললেন, আমরা কি লোকেদের মধ্যে পড়ি না নাকি! উনার দাসী হয়ত তখন বইসা ভাবতেছিলেন, এইসব `হালকা কারেক্টনেস` দিয়া কী আর হবে!

আসলে, এই কারেক্টনেসটুকেরও যে গুরুত্ব আছে একটা, `চোখের শীতলতা` মানে বউ খালি জামাইরে আরাম দিয়া যাবে তা না, বরং বউ-জামাই উভয়ে উভয়রে আরাম দেবে এবং আল্লাহর এবাদত করবে— এইগুলার বুঝ হাসিল করাও আকলে সালিম ও ফাহমে আমিকের ব্যাপার। আল্লাহ আমাদের সবাইরে মুখস্থ কথাবার্তা শেখার পাশাপাশি কিছু চিন্তাশক্তিও দান করুক, আমিন।