নিঃশঙ্কচিত্ত

নাটক ১

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০১, ২০২০

(পাহাড়ি এলাকার কোনো এক থানায় পুলিশের দুজন সিপাহী পাহারা দিচ্ছে। শীতের রাত। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। পাহারার ফাঁফে ফাঁকে দুজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।)

প্রথম: ভেবেছিলাম রাতে একটু মজা করে ঘুমাব। তা না, এখন এই শীতের মধ্যে রাত জেগে পাহারা দিতে হচ্ছে। শালার পুলিশের চাকরির চেয়ে আর খারাপ চাকরি নেই, বুঝেছ!
দ্বিতীয়: ঠিকমতো পাহারা দাও, চোখ কান খোলা রেখে। আজ রাতে একটা অসম্ভব ঘটনা ঘটবে।
প্রথম: স্যার বলল, রাতে একজন বড় অফিসার আসবে। ঠিকমতো পাহারা না দিলে চাকরি চলে যেতে পারে। আর তুমি বলছ একটা অসম্ভব ঘটনা ঘটবে?
দ্বিতীয়: হ্যাঁ, সত্যি বলছি ভীষণ একটা ঘটনা ঘটবে আজ।
প্রথম: যা বলবার স্পষ্ট করে বলো। তোমার কথার সাথে স্যারের কথা কিছুই মিলছে না। রাতে কি কোনো আক্রমণের ভয়টয় আছে নাকি?
দ্বিতীয়: না-না, সেরকম কিছু না। ভাবছি কথাটা তোমার কাছে ফাঁস করা ঠিক হবে কিনা। যা পেট পাতলা তোমার।
প্রথম: পেট পাতলা মানে? ভাবছ আমি পেটের মধ্যে কথা লুকিয়ে রাখতে পারি না। মোটেই তা নয়। বুঝেছ আমি জাতে মাতাল কিন্তু তালে ঠিক।
দ্বিতীয়: ঠিক আছে তাহলে তোমাকে খুলেই বলি। সাবধান, কেউ যেন এসব জানতে না পারে। এই যে বড় অফিসার টফিসার এখানে আসবে, এসব একদম বাজে কথা।
প্রথম: বাজে কথা মানে? তাহলে রাতে আমাদের কড়া পাহারা দিতে বলল কেন? কেন বলল, ঠিকভাবে পাহারা না দিলে সবার চাকরি চলে যাবে?
দ্বিতীয়: রাতে কড়া পাহারা দিতে হবে কারণ আজ রাতে সেই লোকটা ধরা পড়বে।
প্রথম: সেই লোকটা, মানে কোন লোকটা? কার কথা বলছ?
দ্বিতীয়: যাকে ধরার জন্য সরকার পাগলের মতো ছুটাছুটি করছে। গ্রামের কতগুলো মাতব্বরকে খুন করেছে যে লোকটা।
প্রথম: বুঝতে পেরেছি দারা বাহাদুর, সেই যে পালিয়ে পালিয়ে রাজনীতি করে...
দ্বিতীয়: পালিয়ে পালিয়ে রাজনীতি করবে না তো কি করবে? যারা ধনী মহাজন ও বড়লোকদের গলা কাটে তারা কি সবার সামনে প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারে?
প্রথম: যেমন নাম তেমনি সাহস বেটার। দিনের বেলায় প্রকাশ্যে ব্যাংক ডাকাতি করে। চিন্তা করো! থানায় ঢুকে পুলিশের সামনে দিয়ে অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায়। সেই দিন আবার কি কাণ্ডটা করল, সবার সামনে হাটের মধ্যে বসে জাহাঙ্গীর চেয়ারম্যানকে সাবার করে দিল।
দ্বিতীয়: রাতের মধ্যেই লোকটা ধরা পড়বে।
প্রথম: দারা বাহাদুরের কথা বলছ? রাতের মধ্যে ধরা পড়বে? মানে আজকে রাতের মধ্যে?
দ্বিতীয়: হ্যাঁ, পুলিশ সবরকম ব্যবস্থা নিয়ে ফেলছে। যা কিছু ঘটার তা তোমার চোখের সামনেই ঘটবে।
প্রথম: রাখো পুলিশের গপ্পো। দারা বাহাদুর কি বোকা নাকি যে পুলিশ ইচ্ছা করল আর তাকে ধরে ফেলল।
দ্বিতীয়: আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার?
প্রথম: বিশ্বাস হবে কি করে? কতদিন ধরেই তো পুলিশ দারা বাহাদুরকে ধরতে চেষ্টা করছে। এখনো টিকিটা পর্যন্ত ছুঁতে পারল না। এ তোমার গ্রামের চোর-ডাকাত নয়, বুঝেছ।
দ্বিতীয়: যাহোক, আজ সে ধরা পড়বে।
প্রথম: না, কোনোদিন ধরা পড়বে না। কতদিনই তো সে পুলিশের চোখে ফাঁকি দিয়ে এখানে-ওখানে সভা করে চলে গেল।
দ্বিতীয়: আজ সে ধরা পড়বে তার একটা ভিন্ন কারণ আছে।
প্রথম: ভিন্ন কারণ? কি কারণ?
দ্বিতীয়: দারা বাহাদুরের দলের একজন লোক বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সে পুলিশের কাছে দারা বাহাদুরের সব খবর বলে দিয়েছে।
প্রথম: বলো কি! দারা বাহাদুরের দলের লোক বিশ্বাসঘাতক!
দ্বিতীয়: তাহলে এতক্ষণ ধরে বলছি কি। ঘরের ইঁদুরে যে বান কেটে দিয়েছে। নইলে কি আর দারা বাহাদুরকে ধরা এতই সহজ ছিল!
প্রথম: হায়, তার মানে লোকটা সত্যি ধরা পড়বে। দারা বাহাদুরের লোক যে বিশ্বাসঘাতকা করেছে, তুমি জানলে কি করে?
দ্বিতীয়: বিশ্বাসঘাতক লোকটাকে আমি সন্ধ্যায় ইন্সপেক্টর স্যারের সাথে কথা বলতে দেখেছি। লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের অনেক কথা আমি শুনে ফেলেছি।
প্রথম: কি বলাবলি করছিল তারা?
দ্বিতীয়: লোকটা বলছিল, দারা বাহাদুরের সব খবর সে জানে না। কারণ সে দলের লোক হলেও দলের সব খবরাখবর জানার অধিকার তার নেই।
প্রথম: ওইসব দলের এটাই নিয়ম। ওরা নাকি সবাই সবার নামও জানে না। বেশিরভাগ কর্মীর নামগুলোও দলের দেয়া নাম।
দ্বিতীয়: হ্যাঁ ওই লোকটাও তাই বলছিল। ছদ্মনামেই নাকি ওরা সবাই পরিচিত। সবার কাজও নাকি আলাদা-আলাদা ভাবে ভাগ করা আছে।
প্রথম: (আগ্রহ নিয়ে) লোকটা দারা বাহাদুর সম্পর্কে কী বলল?
দ্বিতীয়: বোঝাই গেল যে লোকটা দলের ছোট-খাটো একজন কর্মী। বেশি কিছু বলতে পারল না।
প্রথম: তাহলে তুমি যে বললে দারা বাহাদুর আজ রাতের মধ্যেই ধরা পড়বে। সেটা কী করে সম্ভব?
দ্বিতীয়: দাঁড়াও আগে একটা সিগারেট ধরিয়ে নি। (সিগারেট ধরায়) মশায় কামড়াচ্ছে গো। দেখেছ কী বিরাট বিরাট একটা মশা।
প্রথম: মশার কথা ভুলে যাও, কী বলছিলে বলো। দারা বাহাদুর ধরা পড়বে কী করে?
দ্বিতীয়: দারা বাহাদুর আজ রাতে এখানে আসবে, এই থানায়। আমাদের এই থানা থেকে সে তার দলের জন্য অস্ত্র লুট করে নিয়ে যেতে চায়।
প্রথম: অস্ত্র লুট করে নিয়ে যেতে চায়! আমাদের থানা থেকে?
দ্বিতীয়: ব্যাপারটা ঠিক লুটও বলা যাবে না। বলতে পার কৌশল। যেমন সে একজন সামরিকবাহিনীর ক্যাপ্টেনের ছদ্মবেশে আসবে।
প্রথম: তারপর!
দ্বিতীয়: তারপর খুব সহজ। আমাদের স্যারকে বলবে আমাদের রাইফেল ও কার্তুজগুলো তাকে দিয়ে দিতে। তার কাছে উপরঅলাদের নকল কাগজপত্রও থাকবে।
প্রথম: তারপর অস্ত্রগুলো নিয়ে পালাবে কীভাবে?
দ্বিতীয়: সঙ্গে তাদের গাড়ি থাকবে। যাতে আমাদের স্যার ওকে সন্দেহ করতে না পারে, সেই জন্য ওদের দলের কয়েকজন এসপি সাহেবকে গৃহে বন্দি করে রাখবে। আমাদের স্যার যদি এসপি সাহেবকে টেলিফোন করে, তাহলে এসপি সাহেবও ওদের পিস্তলের মুখে ইন্সপেক্টর স্যারকে রাইফেলগুলো দিয়ে দেবার জন্য বলবে।
প্রথম: এবার ভেবে দেখ, ওই রকম বুদ্ধিমান লোক আমাদের পুলিশের মধ্যে পাবে?
দ্বিতীয়: লাভ কী হল তাতে? সবকিছুই তো এখন ধরা পড়ে গেল। রাতে দারা বাহাদুর ক্যাপ্টেনের ছদ্মবেশে থানায় ঢোকার সাথে সাথে স্যার তাকে গ্রেফতার করবেন।
প্রথম: দারা বাহাদুর গ্রেফতার হবে এটা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। খবরটা তোমার কাছে ভালো লাগছে?
দ্বিতীয়: কেমন যেন একটু খারাপ লাগছে। দেখ আমরা পুলিশের লোক। সরকার যা হুকুম করবে আমরা তা মানতে বাধ্য।
প্রথম: দারা বাহাদুর দেশের মঙ্গল চায়। সেজন্যই সে ধনী মহাজনদের গলা কাটে। সে গরিবদের বন্ধু। জানো এইরকম বহু দস্যুর গল্প পড়েছি আমি। সেসব গল্প পড়লে আমাদের স্যারও বুঝতেন যে দারা বাহাদুর খারাপ লোক নয়।
দ্বিতীয়: ওই যে একটা গাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয় দারা বাহাদুর!
প্রথম: হ্যাঁ গাড়িটা এ দিকেই তো আসছে। যদি লোকটা সত্যি দারা বাহাদুর হয় তাহলে কী করব?
দ্বিতীয়: কিচ্ছু করতে হবে না। শুধু চুপচাপ পাহারা দিয়ে যাবে। লোকটা যেন কোনোভাবেই বুঝতে না পারে যে, আমরা তাকে চিনতে পেরেছি।
প্রথম: ওই যে দেখ, গাড়ি থামিয়ে দারা বাহাদুর নেমে পড়েছেন। সাথে আর একজন আছে।
দ্বিতীয়: কথা না বলে তুমি তোমার জায়গায় চলে যাও, তাকে কোনোরকম কিচ্ছু বুঝতে দেবে না।
প্রথম: সত্যি বলতে কী আমার কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। শেষে আমাদের থানার মধ্যে আবার যুদ্ধটুদ্ধ বেঁধে যাবে না তো?
দ্বিতীয়: চুপ করো, আর একটা কথাও না। নিজের জায়গায় যাও। তাড়াতাড়ি। (প্রহরী দুজন নিজ নিজ জায়গায় দাঁড়াবে। সঙ্গীসহ রাহুল বাহাদুর প্রবেশ করবে।)

দারা: আমি ক্যাপ্টেন মারুফ। আপনাদের অফিসার-ইন-চার্জের সাথে দেখা করতে চাই। উনি কি অফিসে আছেন? (দ্বিতীয় প্রহরী স্যালুট করে। প্রথম প্রহরী তার হাত বাড়িয়ে দেয় দারার দিকে)
প্রথম: হ্যাঁ স্যার, উনি এখন ভিতরেই আছেন। ডিউটিতে আছেন।
দ্বিতীয়: আপনি স্যার, সোজাসুজি ভিতরে চলে যান। (দারা বাহাদুর সঙ্গীকে নিয়ে চলে যায়।)
প্রথম: তার মানে তুমি বলতে চাও এই লোকটাই? মানে দারা বাহাদুর এইমাত্র আমাদের চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে গেল এবং আমরা তাকে নিজের চোখে দেখলাম?
দ্বিতীয়: হ্যাঁ, দেখলাম।
প্রথম: মানে এই হচ্ছে সেই দারা বাহাদুর, যে দিনে-দুপুরে মানুষের গলা কাটে, ব্যাংক ডাকাতি করে এবং থানা থেকে অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায়?
দ্বিতীয়: হ্যাঁ।
প্রথম: গত তিন বছর ধরে পুলিশ শত চেষ্টা করেও যাকে ধরতে পারেনি সে তাহলে আজ ধরা পড়তে যাচ্ছে?
দ্বিতীয়: হ্যাঁ। না মানে, সে যে থানার মধ্যে ঢুকে পড়েছে সে তো দেখতেই পেলে। এখন এমনও হতে পারে যে, পুলিশ হাতের মুঠোয় পেয়েও তাকে ধরতে পারল না।
প্রথম: তার মানে তুমি বলতে চাইছ পুলিশের সাজানো ফাঁদ থেকে সে পালিয়ে যেতে পারে?
দ্বিতীয়: দারা বাহাদুর যে ধরনের মানুষ, তাতে তার সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। (প্রসঙ্গে পাল্টে) তুমি ওর সাথে হাত মেলাবার জন্য তোমার হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিলে কেন?
প্রথম: বাহ্ এতবড় একটা লোকের সাক্ষাৎ পেলাম আর তার সাথে হাত মেলাবার সুযোগটা পর্যন্ত নেব না!
দ্বিতীয়: সে কিন্তু তোমার সাথে হাত মেলায়নি।
প্রথম: ঠিকই তো, আমার সাথে, একটা ফালতু লোকের সাথে সে হাত মেলাতে যাবে কেন? যে সে নয়, এই দেশের দারা বাহাদুর। পুলিশের বড় কর্তারাও যার নাম শুনলে পায়খানা করে দেয়।
দ্বিতীয়: দারা বাহাদুর তোমার সাথে হাত মেলায়নি তার কারণ, তুমি একজন পুলিশের সিপাহী। সে যদি তোমার সাথে হাত মেলাতো, তাহলে তো ধরাই পড়ে যেত যে সে অফিসারদের নিয়ম কানুন জানে না।
প্রথম: হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছ। লোকটা তো দেখছি ভীষণ চালাক।
দ্বিতীয়: আমার মাথায় একটা অন্য প্রশ্ন জেগেছে।
প্রথম: কি?
দ্বিতীয়: তুমি যখন তার সাথে হাত মেলাতে চেষ্টা করলে তখন সে এটা সন্দেহ করল না কেন যে আমরা তার পরিচয় জেনে গেছি।
প্রথম: তাই তো। না, লোকটা হয়তো ভেবেছে এটা আমার বদ-অভ্যাস। কারণ আমরা তো কথাবার্তায় তাকে কিছুই বুঝতে দেইনি। আমরাও কি কম চালাক।
দ্বিতীয়: বুদ্ধিমান লোকরাও ভুল করে। ছোট্ট একটা ভুল, সামান্য একটা বেখেয়াল মানুষের পতন ডেকে আনতে পারে।
প্রথম: হ্যাঁ, তা পারে।
দ্বিতীয়: লোকটাকে দেখে তোমার কি মনে হলো?
প্রথম: দেখতে তো একেবারে সাধারণ মানুষের মতো। বেশি লম্বাও না, খাটোও না। মোটাও না চিকনও না। লোকটা সত্যি দারা বাহাদুর তো?
দ্বিতীয়: সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
প্রথম: তার মানে এই সাধারণের মতো দেখতে লোকটার মধ্যেই অসাধারণ ক্ষমতা লুকিয়ে আছে?
দ্বিতীয়: দারা বাহাদুর শুধু অসাধারণ নয়, সে ভয়ঙ্কর। কোনোভাবে যদি সে এখান থেকে পালাতে পারে তাহলে বিশ্বাসঘাতকটার আর রক্ষা নাই।
প্রথম: লোকটার চোখ দেখে তাকে মোটেই নিষ্ঠুর মনে হলো না।
দ্বিতীয়: চেহারা দেখে সব সময় মানুষকে চেনা যায় না। মূল শক্তিটা লুকিয়ে থাকে মানুষের ভেতরে, বুঝেছ।
প্রথম: দারা বাহাদুর কি তাহলে এতক্ষণে গ্রেফতার হয়ে গেছে?
দ্বিতীয়: কী জানি। লোকটা যদি সত্যি গ্রেফতার হয়, তাহলে কাল দেখবে এখানে সাধারণ মানুষের ভিড় কেউ সামলাতে পারবে না। (হঠাৎ স্টেনগানের গুলির শব্দ ভেসে আসে। মঞ্চের সেই সঙ্গে নিভতে থাকে।)

দ্বিতীয় দৃশ্য
(পুলিশ ইন্সপেক্টরের কক্ষ। নিজের চেয়ারে বসে আছেন ইন্সপেক্টর। টেবিলের উল্টো দিকে দারা বাহাদুর। দারার সঙ্গী দূরে দাঁড়িয়ে।)
ইন্সপেক্টর: দুঃখিত ক্যাপ্টেন, আপনার পত্রের হুকুম আমরা মানতে পারছি না। কারণ আমাদের ক্যাম্পে পঞ্চাশটা রাইফেল নেই। অথচ এই পত্রে পঞ্চাশটা রাইফেল চাওয়া হয়েছে।
দারা:  যতদূর জানি, এটা বিশেষভাবে পরিকল্পিত একটি থানা। পঞ্চাশটার বেশি রাইফেল থাকার কথা।
ইন্সপেক্টর: খুব সঠিক তথ্য। এ থানায় এমন সব সুবিধা আছে যা আর কোথাও নেই। কঠিন নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে চারদিকে। সন্দেহ নেই বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে এ থানাটি খুব পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। কিন্তু পঞ্চাশটা রাইফেল নেই।
দারা:  ব্যস, যে কটা আছে সে কটা দেয়ার ব্যবস্থা করুন। পাহাড় থেকে শান্তিবাহিনীর লোকরা ক্রমশই এগিয়ে আসছে। রাইফেলগুলো আমাদের দ্রুত দরকার।
ইন্সপেক্টর: সে তো বুঝতে পারছি। বসুন। আপনি আমার অতিথি। বাইরে যা ঠাণ্ডা, খানিকটা চা কিম্বা কফি পান করুন। তারপর না হয় যা কিছু একটা করা যাবে।
দারা: একজন যোদ্ধার হাতে সব সময় চা খাবার সময় থাকে না ইন্সপেক্টর। রাইফেলগুলো নিয়ে খুব দ্রুত আমাদের রওনা দিতে হবে। বুঝতেই পারছেন ওদিকে যুদ্ধ চলছে।
ইন্সপেক্টর: ক্ষমা করবেন ক্যাপ্টেন, এতগুলো অস্ত্র আপনাকে দিয়ে দেব। অফিসার ইনচার্জ হিসাবে ব্যাপারটা আমার একটু ভাবা দরকার।
দারা:  সামান্য আগে কি এসপি সাহেব আপনাকে ফোন করে রাইফেলগুলি দিতে বলেননি?
ইন্সপেক্টর: না, বলেননি। আমি বুঝতে পারছি না, আপনাদের কেন আমাদের এই অস্ত্রগুলো দরকার হবে?
দারা: আপনি পুরো ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করুন। আমাদের একটা বাহিনী সমস্ত রকম অস্ত্র সমেত শান্তিবাহিনীর কাছে ধরা পড়েছে। অতর্কিতে ওরা আক্রমণ করেছিল।
ইন্সপেক্টর: শান্তিবাহিনীর উৎপাত দেখছি বেশ বেড়ে গেছে। এবং এটা খুবই দুঃখের যে আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর জোয়ানরাও এখন শান্তিবাহিনীর হাতে মার খাচ্ছে। ঠিক আছে ক্যাপ্টেন আমি দেখছি কি করা যায়।
দারা: রাইফেলগুলো আমাদের বিশেষ প্রয়োজন, আর আপনার হাতে তো কর্তৃপক্ষের কাগজ রয়েছে।
ইন্সপেক্টর: পুরো ব্যাপারটা আমার আর একটু নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া আপনার এই কাগজপত্রগুলো আমাদের কাছে জাল মনে হচ্ছে। হ্যাঁ জাল।
দারা: আপনি মেজর মোহাম্মদের স্বহস্তে দেয়া স্বাক্ষরকে জাল বলছেন। মেজর মোহাম্মদের ব্যাপারটা না হয় বাদই দিলাম। আপনি কি আপনার এসপির স্বাক্ষরও চিনতে পারছেন না?
ইন্সপেক্টর: মাঝে মাঝে আমার এমন হয় যে, নিজের স্বাক্ষরই ঠিকমতো চিনতে পারি না। হ্যাঁ ক্যাপ্টেন। ভেবে দেখুন, নিজের স্বাক্ষর পর্যন্ত নিজে চিনতে পারছি না। ব্যাপারটা বেশ মজার না? কি বলেন? সম্মানিত নকল ক্যাপ্টেন, এবার আপনার আসল পরিচয়টা দিয়ে ফেলুন। (ইন্সপেক্টর তার রিভলবার বের করে সোজা দারার মাথায় তাক করে) না, না, কোনোরকম চালাকি খাটাবেন না দারা বাহাদুর।
দারা: আপনি বোধহয় কিছু একটা ভুল করছেন। আমি দারা বাহাদুর নই। আপনাকে ভুল খবর দেয়া হয়েছে। এই যে আমার পরিচয়পত্র। (দারা পরিচয়পত্র বের করলেও ইন্সপেক্টর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না।)
ইন্সপেক্টর:  আপনি দেখছি এখনো আমায় বোকা বানাতে চাইছেন। এদেশে প্রচুর নকল পরিচয়পত্র পাওয়া যায় দারা বাহাদুর। অতীতে আপনি বহুবার বহুভাবে আমাদের ফাঁকি দিয়েছেন। আর তা সম্ভব হবে না। (দারার সঙ্গীটি ক্ষিপ্তগতিতে তার পকেটের রিভলবার বের করে ইন্সপেক্টরকে গুলি করতে যায়। সঙ্গে সঙ্গে একজন সিপাহীর স্টেনগানের একঝাঁকগুলি তার বক্ষ ভেদ করে চলে যায়। সে নির্মমভাবে মারা পড়ে।) দেখলেন তো চালাকির পরিণতি। বহুদিন পর তাহলে আপনি ধরা পড়লেন। আপনাদের কর্মীর দেয়া তথ্যের কারণে আপনাকে ধরা পড়তে হলো।
দারা: আপনাকে কেমন করে বোঝাই যে আমি ক্যাপ্টেন মারুফ। শান্তিবাহিনীর সাথে আমাদের যে যুদ্ধ চলছে তার জন্য রাইফেলগুলো খুবই দরকার। আমার কথা বিশ্বাস না হলে আপনি আপনার এসপি সাহেবকে টেলিফোন করুন।
ইন্সপেক্টর: এসপি সাহেব মানে যাকে আপনারা গৃহে বন্দি করে রাখতে চেয়েছিলেন। জনাব দারা বাহাদুর, ছোট্ট একটা ভুল হয়ে গেছে আপনাদের অংকে, সেটা আপনার জানা দরকার। এসপি সাহেবকে বন্দি করবার দায়িত্ব দিয়ে আপনারা যাকে সন্ধ্যায় পাঠিয়েছিলেন, সেই লোকটি এসপি সাহেবের ওখানে না গিয়ে সরাসরি আমার এখানে চলে আসে। এখানে এসে আমার সাথে চা পান করে। বুঝতেই পারছেন চা পান করতে করতে আমরা কি আলোচনা করেছি।
দারা:  বিশ্বাসঘাতক! তার মানে সে দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে?
ইন্সপেক্টর: সে আপনারা আপনাদের একজন কর্মীর যে নামকরণই করেন না কেন, কাজটা সে আমাদের পক্ষেই করেছে। যে দুজন তার সঙ্গে থাকার কথা ছিল তাদের একজন ইতিমধ্যেই মারা পড়েছে। আর একজন কোনোভাবে পালিয়েছে।
দারা: সেজন্য বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি তাকে পেতেই হবে।
ইন্সপেক্টর: আপনি কি তার সাথে দেখা করতে চান? তাহলে আপনাদের মধ্যে একটা সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
দারা: রসিকতা করছেন? না ইন্সপেক্টর, আমাদের নিয়ে রসিকতা করা যায় না। বন্দি অবস্থায়ও আমরা কারো রসিকতার পাত্র হই না।
ইন্সপেক্টর: যা হোক, একটু পরেই আপনার গ্রেফতারের খবর সব উপরঅলাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে। আশা করি সবার জন্যই এটা একটা বিরাট খবর হবে। সিগারেট-টিগারেট, চা-টা কিছু খাবেন?
দারা:  না, ধন্যবাদ। আমি কি আমার সঙ্গীর লাশের পাশে গিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়াতে পারি। তার প্রতি আমি শেষ সম্মানটুকু জানাতে চাই।
ইন্সপেক্টর: নিশ্চয়। তবে কোনোরকম চালাকি খাটাতে যাবেন না। (ইন্সপেক্টর দারাকে নিয়ে মৃত্যের সামনে এসে দাঁড়ায়। দারা হাঁটু গেড়ে বসে মৃত্যের খোলা চোখের পাতা টেনে দেয়।) মৃত মানুষকে সম্মান দেখানোর আসলে কোনো অর্থই হয় না। মৃতকে ফুল দেয়া, তার কবরে স্মৃতি সৌধ নির্মাণ এসব শুধু শুধু কি বলেন? বরং জীবিতদের নিয়েই আমাদের ভাবা উচিত।
দারা:  এই মৃত্যু একটি সম্মানজনক মৃত্যু ইন্সপেক্টর। সে প্রাণ দিয়েছে দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য। সে কোনো পদকপ্রাপ্ত বীর নয়, কিন্তু সে দেশের প্রকৃত বীর সন্তানদের একজন।
ইন্সপেক্টর: সন্ত্রাসবাদের ওপর আমার একটুও সহানুভূতি নেই। গোটা দেশটাকে আপনারা নৈরাজ্যবাদের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। সন্ত্রাসবাদ হলো পুরানো ব্যারামের টোটকা চিকিৎসা। (প্রবেশ করে সেকেন্ড অফিসার। সে ইন্সপেক্টরের কানে কানে খরব দেয়। ইন্সপেক্টর মন দিয়ে শোনে) দারা বাহাদুর আপনার সম্মান দেখানটা একটু বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। চলুন আবার গিয়ে চেয়ারে বসা যাক। (দারা ইন্সপেক্টরের সাথে সাথে আবার চেয়ারের কাছে এসে দাঁড়ায়।)
অফিসার: এই হচ্ছে তাহলে সেই আসল শয়তানটা। (দারার গায়ে হাত দিয়ে) এই যে ঘুঘু, খুব তো মাস্তানি করা হলো, এখন কেমন লাগছে? ভেবেছিলে আমরা কেউ তোমায় ধরতে পারব না! (ইন্সপেক্টরকে) স্যার, দেই শালার মাথাটা ফাটিয়ে?
ইন্সপেক্টর: আগে দেখুন তার পকেটে কোনো পিস্তল টিস্তল রাখা আছে কিনা। এর ব্যাপারে দয়া করে সব সময় সাবধান থাকবেন।

(সেকেন্ড অফিসার সঙ্গে সঙ্গে দারার দেহ তল্লাশি আরম্ভ করে দুটো রিভলবার পেয়ে যায়।)
অফিসার: তোর কোন বাবার কাছ থেকে পেয়েছিস এই রিভলবারগুলো? বল্ কোন বাবার কাছ থেকে? শুয়োরের বাচ্চাটা দেখছি কোনো কথা বলছে না। মুখ খোল শুয়োরের বাচ্চা। (দারার গালে চড় লাগায়।)
ইন্সপেক্টর: রিভলবার দুটোই দেখছি বেশ দামি। কোন থানা থেকে, নাকি কারো বাড়ি থেকে এগুলো লুট করেছেন? এটা তো দেখছি একবারে জার্মান মাল।
অফিসার: শালা এখনো চুপ মেরে আছে। দাঁড়ান স্যার, আমার রোলারটা আগে নিয়ে আসি। তারপর পেদানি দিয়ে শালার মুখ খোলাব। শালার চামড়া লাল করে দেব না!
ইন্সপেক্টর: বাইরে ডিউটিতে যারা আছে ওদের সবাইকে বলেছেন তো ব্যাপারটা যেন কোনোভাবে জানাজানি না হয়? বড় সাহেবের হুকুম।
অফিসার: হ্যাঁ স্যার, বলেছি। স্যার, জনগণ শালারা কিন্তু এই শালাদের ভীষণ ভক্ত। গোপনে গোপনে এদের সাহায্য দেয়। নইলে তো শালারা বহু আগেই ধরা পড়ত। (টেলিফোন বাজে। ইন্সপেক্টর রিসিভার তুলে নেয়।)
ইন্সপেক্টর: হ্যালো। হ্যাঁ। ধরা যায়নি? থার্ড অফিসারকে গুলি করে পালিয়েছে? কোথায় গুলি লেগেছে? হাতে? না না তেমন সিরিয়াস কিছু না। পালের গোদাটা যখন ধরা পড়েছে, বাকিগুলোকেও ধরা পড়তে হবে। (রিসিভার রেখে দেয়। তারপর এসপি সাহেবকে এগিয়ে আসতে দেখে) স্যার, আপনি এসে গেছেন তাহলে। (লাশ দেখে এসপি থমকে দাঁড়ায়) দারা বাহাদুরের সঙ্গী স্যার। স্যার, আমাদের কিছুই করার ছিল না। আমরা কোনো রকম ঝুঁকি নিতে চাইনি।
সুপার:  হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। আপনাদের ওপর আক্রমণ চালাতে চেষ্টা করেছিল। কতক্ষণ আগে ঘটল?
ইন্সপেক্টর: মাত্র দশ মিনিট হবে স্যার। ওদের পরিচয় যে আমরা জেনে গেছি সেটা বুঝতে পেরেই রিভলবার বের করে।
সুপার: শেষ চেষ্টা আর কি। (পুলিশ সুপার হেঁটে এসে দারার পাশের চেয়ারটায় বসে।) আপনিই হচ্ছেন তাহলে দারা বাহাদুর। আমি এখানকার বর্তমান এসপি। ঘণ্টা দুয়েক আগে খবর পেলাম যে, আপনি ধরা পড়তে যাচ্ছেন। শুধুমাত্র ধৈর্যের অভাবে আপনার বন্ধুটি মারা পড়ল। ইন্সপেক্টর সাহেব, মৃতের নাম ঠিকানা ওনার কাছ থেকে জেনে নিন। কালকের মধ্যেই লাশ বাবা-মার কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে।
ইন্সপেক্টর: দারা বাহাদুর সাহেব, মৃতের নাম ঠিকানা বলুন।
দারা: মৃতের নাম মোহাম্মদ রায়হান। মৃতের বাবা খুলনা শহরের একজন অ্যাডভোকেট। নাম মোহাম্মদ শরীফুল্লাহ। আর কিছু আমার জানা নেই।
সুপার: ঠিক আছে ওতেই চলবে। দারা বাহাদুর সাহেব, এক্ষণি আপনার সাথে কয়েকটা ব্যাপারে একটু আলোচনা সেরে নিতে চাই। বুঝতেই পারছেন পুলিশের এসপি হিসাবে আমার ওপর কিছু দায়িত্ব আছে। সরকার চাইছে আপনার দলের সদস্যদের নাম ঠিকানাসহ একটি তালিকা যেন আমরা আপনার কাছ থেকে সংগ্রহ করি। সেটা যত দ্রুত সম্ভব, ততই মঙ্গল।
দারা: যাতে আমার গ্রেফতারের খরব দলের সবার কানে পৌঁছাবার আগেই তাদের ওপর আক্রমণ চালাতে পারেন। দুঃখিত সুপার, দলের সদস্যদের কোনো তালিকা দেয়া তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
অফিসার: প্রথম প্রথম সবাই তাই বলে। পরে পিঠের ওপর দু চার ঘা পড়লে সব ব্যাটাই মুখটা খুলতে বাধ্য হয়। স্যার, রোলারটা নিয়ে আসি?
সুপার: থামুন আপনি। (দারাকে) দেখুন, সারাদেশ জুড়ে আপনারা যেভাবে সন্ত্রাস করে বেড়াচ্ছেন, সেভাবে তো একটা দেশ চলতে পারে না। চলবে