
নিঃশঙ্কচিত্ত
নাটক ২
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০২, ২০২০
তৃতীয় দৃশ্য
(পরদিন। থানা অফিসে আলোচনারত পুলিশ সুপার, পুলিশ ইন্সপেক্টর ও দারা বাহাদুর। দারা বাহাদুরের মুখমণ্ডলে অত্যাচারের চিহ্ন)
সুপার: আশ্চর্য, আপনারা এভাবে তার গায়ে হাত তুলেছেন! এটা সত্যি খুব অন্যায় ইন্সপেক্টর সাহেব। দেখুন তো, কিভাবে তার শরীরে দাগ ফেলে দিয়েছেন। আমি খুব দুঃখিত দারা বাহাদুর সাহেব।
ইন্সপেক্টর: স্যার, উনি কিছুতেই নাম ঠিকানাগুলো বলছিলেন না। যার জন্য আমরা বাধ্য হয়েছিলাম।
সুপার: নাম ঠিকানাগুলো বলাবার জন্য এভাবে শাস্তি দেয়ার পথ বেছে নিতে হবে? দেখুন, এনারা চোর গুণ্ডা বদমাস নন। এক ধরণের রাজনৈতিক বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছেন। হতে পারে সেটা ভুল। কিম্বা ঠিকও হতে পারে। সেজন্য চোর গুণ্ডা বদমাসদের মতো আপনি এঁদের গায়ে হাত তুলবেন! বিকালের দিতে একজন ডাক্তারকে খবর পাঠাবেন। ওনার শরীর পরীক্ষা করে দেখবে।
ইন্সপেক্টর: জ্বী স্যার, আমি অবশ্যই খবর পাঠাব। এখানকার সিভিল সার্জন যিনি আছেন তিনি খুবই চমৎকার লোক।
সুপার রাজনৈতিক কারণে কারো ওপর এ ধরণের অত্যাচার আমি কখনোই পছন্দ করি না। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা দেশের সম্পদ। এক রাজনৈতিক দলের সাথে আর এক রাজনৈতিক দলের বিরোধ থাকতে পারে, সেটা আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা হবে। গায়ে হাত তুলে নয়। দারা বাহাদুর সাহেব, কি বলেন?
দারা: আপনি এমন সুরে কথা বলছেন, যেন আপনি পুলিশের লোক নন। মনে হচ্ছে কোন দেবতা এসেছেন স্বর্গরাজ্য থেকে।
সুপার: হ্যাঁ আমি পুলিশের লোক। পুলিশের লোক হলেই যে আমাকে খারাপ হতে হবে এমন তো কোন কথা নেই। ইন্সপেক্টর সাহেব, এক্ষণি এখানে আমাদের দু কাপ চা দিতে বলুন। [ইন্সপেক্টর চলে যায়] দেখুন দারা বাহাদুর, আপনার সাথে এদের যে সমস্যা হয়েছে, আমি আশা করি আমার সাথে আপনার সে সমস্যা হবে না।
দারা: সমস্যা তো হতেই হবে। কারণ একজন বিপ্লবীর সাথে আপনি কী করে একমত হবেন আমি বুঝতে পারছি না। আপনার সাথে আমার সমস্যা তখনই হবে না, যখন আপনি আমার আদর্শ গ্রহণ করবেন।
সুপার: বুঝতে পারছি, এখানে আপনার ওপর যে ধরণের অত্যাচার হয়েছে তাতে করে আপনি আমাদের সবার উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। এটা খুবই স্বাভাবিক। সত্যি বলছি, আমাকে অন্ততঃ আপনি আপনার একজন বন্ধু বলে ভাবতে পারেন। কারণ বিপ্লবীদের সমস্যাগুলো আমি জানি।
দারা: প্রত্যক্ষভাবে বিপ্লবে অংশগ্রহণ না করলে বিপ্লবীদের সমস্যাগুলো কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। একজন বিপ্লবীই শুধুমাত্র অপর একজন বিপ্লবীর বন্ধু হতে পারে।
সুপার: ভুল বললেন দারা বাহাদুর। বিপ্লবীই যদি শুধু আর একজন বিপ্লবীর বন্ধু হবে, তাহলে জনগণকে কি আপনারা আপনাদের শক্র ভাববেন? না, না, এ মোটেই ঠিক নয়। চা আসুক, তারপর এ নিয়ে জমিয়ে আলাপ করা যাবে। আপনি বোধহয় জানেন না, ছাত্রজীবনে আমিও একটু আধটু রাজনীতি করেছি।
দারা: সখের রাজনীতি তাই না? নেতার পক্ষে শ্লোগান দেয়া। দেখুন, ছাত্রজীবনে বহু লোকই সখের রাজনীতি করে থাকে। আশা করি আপনি আমার সাথে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে আসেননি।
সুপার: কেন, আমাদের মধ্যে তো রাজনীতির আলোচনা হতে পারে। দারা বাহাদুর সাহেব, আমরা যে রাজনীতি একেবারে বুঝি না, তেমন ভাববেন না। বেশির ভাগ লোক কেন রাজনীতি করছে? কারণ সর্দারি করার আর বিখ্যাত হবার ভারী সুবিধা রাজনীতিতে। দেশের মানুষের ভাগ্য পাল্টাবার নাম করে ক্ষমতায় যাওয়া, তারপর নিজেদের ভাগ্য গড়ে তোলা। জানি, আপনারা ভিন্ন চিন্তা করছেন। সৎভাবে দেশের মধ্যে একটা বিপ্লব ঘটাতে চাইছেন।
দারা: এবং আপনার কাজ হচ্ছে সেই বিপ্লবের পদক্ষেপকে ভণ্ডুল করা। বিপ্লবের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।
সুপার: বিপ্লব তো একটা প্রয়োজনীয় বিষয়। ইতিহাস বারবার আমাদের সামনে একটা সমস্যা এনে দেয়। বিপ্লবের মধ্যে দিয়েই তো তার সমাধান ঘটে। কিন্তু বিপ্লবটা ঘটাবেন কাদের দিয়ে? চারদিকের লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন, তাদের মনোবৃত্তি এখনো পশুর স্তরে। যারা নিজেরাই সম্পূর্ণ দুর্নীতিতে ডুবে আছে এদের নিয়ে বিপ্লব ঘটানো, অসম্ভব। ক্ষমতা দখল চলতে পারে, বিপ্লব নয়। হ্যাঁ, স্কুল কলেজের ছেলেরা মার্কসবাদ, মার্কসবাদ বলে খুব চেঁচাচ্ছে। বলুন তো, তাদের মধ্যে কজন সত্যিকারের বিপ্লবী রয়েছে?
দারা: দেশের বর্তমান রাজনীতির সুন্দর একটা চিত্রই আপনি তুলে ধরেছেন এতে কোন সন্দেহ নেই।
(ইন্সপেক্টরের প্রবেশ। ঢুকে সে দাঁড়িয়ে থাকে)
সুপার: দেখলেন তো রাজনীতির ব্যাপারটা আমার কাছেও পরিষ্কার। শুধু সরকারী চাকুরি করছি বলেই আমার পক্ষে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। ইন্সপেক্টর সাহেব, আপনি বসুন। একটা কথা আপনাকে আবার বলতে হচ্ছে যে, কাজটা আপনি ঠিক করেননি। একজন বিপ্লবীর সাথে আপনি মোটেই তাঁর যোগ্য আচরণ করেননি।
ইন্সপেক্টর: দুঃখিত স্যার, শুধু নাম ঠিকানাগুলো জানার জন্য। উনি যদি আমাদের নাম ঠিকানাগুলো বলে দিতেন তাহলে কোন ঝামেলাই হতো না।
সুপার: উনি তো নামগুলো বলতে বাধ্য নন। আর আপনি বুঝছেন না কেন, এক সাথে যাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছেন তাদের নামগুলো হুট করে বলে দেয়া যায় না। তাহলে কিসের বিপ্লবী বন্ধু সে। নামগুলো বলার আগে তার নিশ্চয়তা পাওয়া দরকার যে সেই সব বন্ধুদের সরকারের তরফ থেকে জীবনের নিরাপত্তা দেয়া হবে। তাই নয় কি?
দারা: দেখুন, আপনি সেয়ানা লোক। বহু চরিয়ে খেয়েছেন। আমার মনে হয় আপনি যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমার সাথে কথা বলতে এসেছেন, তাতে হয়ত আপনি শেষ পর্যন্ত হতাশ হবেন।
সুপার: হব না, আমি জানি আপনি আমাকে হতাশ করতে পারবেন না। আমি এটা খুব ভাল করেই বুঝছি, আপনার বন্ধুদের নাম বলে দেয়া যেমন আপনার উচিত নয়, তেমনি একজন পুলিশের বড় কর্মকর্তা হিসাবে আমারও উচিত নামগুলো জানা। তবে জোর করে না। একটা সমাধানের মধ্য দিয়ে।
দারা: সমাধান! আপনার কথাগুলো বেশ চমৎকার। সত্যিই আপনি বিপ্লবীদের একজন চমৎকার বন্ধু। হ্যাঁ একজন ঝানু পুলিশ অফিসার হিসাবে আপনাকে আমার পছন্দই হয়েছে।
সুপার: আমার সঙ্গে ব্যঙ্গ করছেন? পরে টের পাবেন যে আমি আপনার বন্ধুই ছিলাম। উপরওয়ালাদের কাছে আপনার ব্যাপারে যে প্রতিবেদন পাঠাব সেগুলো সব আপনার পক্ষেই যাবে। ভারতের ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুদিরামের যে বিদ্রোহ, তাকে আজও আমি সম্মান করি। তাহলে আপনাকে কেন করব না?
দারা: বাহ, পুলিশ অফিসারদের মধ্যে বিপ্লবীদের বন্ধু লুকিয়ে থাকতে পারে তা আমার আগে জানা ছিল না। ক্ষুদিরামের গল্প তাহলে আপনি পড়েছেন?
সুপার: আপনি ভীষণ সাহসী। আপনি একজন জাঁদরেল-ক্ষমতাবান পুলিশ কর্মকর্তাকে দেখেও যে ভয় পাচ্ছেন না এতে আমি সত্যিই খুব খুশী হয়েছি। বিপ্লবীদের এমনি হওয়া উচিত।
দারা: বলতে পারেন খেলোয়াড় হিসাবে আপনি নিজেও খুব মন্দ নন। খুব অল্প বয়সেই আপনি অনেক পদোন্নতি পেয়ে গেছেন। বড়কর্তা হয়ে বসে আছেন। [একজন সিপাহী চায়ের কাপ নিয়ে ঢোকে]
সুপার: এই যে আমাদের চা এসে গেল। (সিপাহী কাপগুলো টেবিলের ওপর রেখে চলে যায়) নিন, চা নিন। (চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে) দেখুন, আমি এ কথা মোটেই বিশ্বাস করি না যে পুলিশরা ভুল করে না। রাজনৈতিক দলগুলোর কারণেই পুলিশ নানারকম ভুল করে। এমনকি অন্যায় করতেও বাধ্য হয়। যেমন ধরুন ভাষা আন্দোলনের মিছিলে আমরা পুলিশরাই গুলি চালিয়েছি, চালিয়েছি কিনা? কেন, ভিন্ন একটি রাজনৈতিক দলের হুকুমে।
ইন্সপেক্টর: এজন্য কি আপনি পুলিশকে দায়ী করবেন? আপনারা রাজনৈতিক দলগুলোই যত ঝামেলা পাকান। পুলিশ তো শুধুমাত্র হুকুমের চাকর।
দারা: দেখুন, আমাদের দীর্ঘ সংগ্রাম পুলিশদের বিরুদ্ধে নয়। আমরা সমস্ত সমাজ ব্যবস্থাকে পাল্টাবার জন্য লড়াই করছি। পুলিশের ভুল ক্রটি, গুণাগুণ এখানে প্রধান বিচার্য বিষয় নয়।
ইন্সপেক্টর: তাহলে পুলিশের কাজগুলোকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন? পুলিশ তো রাষ্ট্রের নিয়ম-শৃঙ্খলাই রক্ষা করে চলেছে। করছে না? হ্যাঁ এবার বলুন, পুলিশদের আপনি কি ভাবেন?
দারা: সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী। সরকারের হুকুমে খুন জখম, লুটতরাজ এমনকি নারী ধর্ষণ করার অধিকারও তাদের রয়েছে।
ইন্সপেক্টর: পুলিশ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যটা শুনুন স্যার। পুলিশদের সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করা এখন একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেন দেশের সব খারাপ কাজ শুধু পুলিশরাই করছে।
সুপার: দারা বাহাদুর, আমি কিন্তু আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত। আমরা হচ্ছি সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী। সেজন্য আমাদের লাঠির বাড়ি মাঝে মধ্যে ভুলভাবে ভুল লোকের মাথার ওপর গিয়েও পড়ে। যেমন ধরুন আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, কদিন আগেই ভূতপূর্ব সরকারের হুকুমে আমরা তার মাথার ওপর লাঠি চালিয়েছি। আর এখন কিনা তিনিই আমাদের প্রভু। তাহলেই দেখুন, ভুলভাবে আমরা লাঠি চালাই। কে জানে, কে একথা নিশ্চিত করে বলতে পারে যে, কালকে আপনার দল ক্ষমতায় আসবে না। এখন যদি আপনার সাথে কোনরকম খারাপ ব্যবহার করি, তাহলে কাল শেষে আমার চাকুরি নিয়ে টানাটানি লাগবে। তাই আমি আপনার সাথে বুন্ধত্বমূলক সম্পর্কই গড়ে তুলতে চাইছি।
দারা: চমৎকার দেখছি যুক্তিগুলো আপনার। নিশ্চিত থাকুন আমার দল খুব শীঘ্রই ক্ষমতা আসছে না। এও নিশ্চিত থাকুন আমার দল ক্ষমতায় এলে কয়েকজন ব্যক্তির চাকুরি নিয়ে তারা টানাটানি করবে না। পুরো দেশ তাদের মাথা ব্যাথার কারণ হবে। আমরা সর্বক্ষেত্রেই একটা পরিবর্তন ঘটাব। ব্যক্তির চেয়ে আমাদের কাছে ঘটনা বড়।
সুপার: বেশ তাহলে দেখা যাচ্ছে আমরা বন্ধু হয়ে উঠছি। এটাই আসলে আমি চেয়েছিলাম, বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনার সুযোগ। যার মধ্যে পারস্পরিক লেনদেন সম্ভব। বিপ্লবও একটা লেনদেনের ব্যাপার। পুরান সমাজের সাথে নতুন সমাজের একটা বোঝা পড়া।
দারা: আপনার অর্থে পারস্পরিক লেনদেন মানে তো আমার বিপ্লবী বন্ধুদের নাম ঠিকানাগুলো আপনাদের হাতে দিয়ে দেয়া? তাই নয় কি?
ইন্সপেক্টর: হ্যাঁ। সে কথাই তো আপনাকে একক্ষণ ধরে বোঝানো হচ্ছে। নাম ঠিকানাগুলো দিয়ে দিন।
সুপার: নিঃশর্তভাবে নয়। শর্তাধীনে। কতগুলো ছেলেমেয়ের জীবনের মূল্য আছে আমার কাছে। সেজন্য নাম ঠিকানাগুলো জানার আগে আমরা সরকারের কাছ থেকে এই শর্ত নিয়ে এসেছি যে, গ্রেফতারের পর সরকার তাদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে বাধ্য থাকবে। সরকার এ প্রস্তাবে রাজী হয়েছে।
দারা: সেটা আপনার সরকারের উদারতা। সাধারণত এসব ঘটনায় বিপ্লবীদের গুলি করে মারার হুকুম দেয়াই হয়ে থাকে। সরকার যে গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবীদের গুলি করে মারতে চাইছে না, সেজন্য সরকারকে ধন্যবাদ।
সুপার: সরকার কোন অধিকারে তাদের গুলি করে মারবে? এরা তো কেউ চোর ডাকাত নয় যে সরকার তাদের গুলি করে মারলেই সব ঝামেলা চুকে যাবে। পৃথিবীর ইতিহাস দেখুন, যেখানে বিপ্লবীদের গুলি করে মারা হয়েছে সেখানেই সরকার সমালোচিত হয়েছে। আপনারা হচ্ছেন বিপ্লবী, আর সব দেশেই বিপ্লবীরা ব্যাংক ডাকাতি, লোক হত্যা এসব করেই থাকে। এটা অবশ্যই সরকারকে বুঝতে হবে।
দারা: বিগত বছরগুলোতে আপনারা মানে আপনাদের সরকার শুধু বিপ্লবীদের নিয়েই ভাবল। জনগণের কথা কিছু ভাবল না? জনগণের চেয়েও বিপ্লবীদের নিরাপত্তার ব্যাপারটা তাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দিল? জনগণ না খেয়ে মারা পড়ছে, তাদের জন্য সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, এসব নিয়ে সরকার ভাবছে না কেন?
সুপার: জানেনই তো সব সরকার জনগণের ব্যাপারে একটু উদাসীন হয়েই থাকে। না হলে আপনাদের জঙ্গলে জঙ্গলে কষ্ট করে জনগণের কথা ভাবতে হতো বলুন? নিন সিগারেট খান।
দারা: (পুলিশ সুপার সিগারেট এগিয়ে দিলে দারা একটা সিগারেট নেয়) বেশ দামী সিগারেট। জনগণের ব্যাপারে সরকার উদাসীন হলেও আপনাদের ব্যাপারে মোটেই উদাসীন নয়। আপনাদের জন্য দামী সিগারেটের পয়সা ঠিকই জুগিয়ে যাচ্ছে।
সুপার: দেখুন, একটা জিনিস তো খুব ভাল করেই জানেন যে, পুলিশদের এসব পয়সা দিয়ে কিনে খেতে হয় না। এখান ওখান থেকে যোগাড় হয়ে যায়। ইন্সপেক্টর সাহেব, ওনাকে আজকেই কয়েক প্যাকেট দামী সিগারেট এনে দেবেন।
দারা: আপনার অনুগ্রহের জন্য ধন্যবাদ। সিগারেট আমি খাই না। (সে সিগারেটটা ফেরত দেয়)
সুপার: তাহলে এবার আপনাকে একটা খাতা আর কলম এনে দেই? নাকি নাম ঠিকানাগুলো আপনি মুখে মুখে বলে যাবেন, আর আমরা লিখে নেব? যেভাবে আপনার খুশী। ইন্সপেক্টর সাহেব একটা খাতা কলম নিন।
দারা: নাম ঠিকানাগুলো তো দেয়া যাবে না বন্ধু। সে তো বহু আগেই আপনাদের বলেছি। বন্ধু হিসাবে আপনাকে আমার যথেষ্ট মনে লেগেছে। সব সময় আপনার কথা স্মরণ রাখব।
ইন্সপেক্টর: নাম ঠিকানাগুলো বলতে আপনার আপত্তি কোথায়? স্যার একক্ষণ ধরে এখানে কেন বসে আছে? আপনি বাড়াবাড়ি করছেন দারা বাহাদুর।
সুপার: বললাম তো নাম ঠিকানাগুলো বললে আপনার বন্ধুদের কোন ক্ষতি হবে না। তাদের প্রত্যেকের জীবনের নিরাপত্তা দেয়া হবে।
দারা: বিপ্লবীরা কেউ জীবনের নিরাপত্তা চায় না। তারা জনগণের ভাগ্য গড়ে তুলবার জন্য লড়তে চায়। জীবনের নিরাপত্তা চাইলে তারা কেউ বিপ্লবী হতে আসত না। জঙ্গলে, বনে বাদাড়ে প্রতি নিয়ত মৃত্যুর ঝুঁকি বেছে নিত না। দিনের পর দিন না খেয়ে থেকেও হাসিমুখে জনগণের পাশে দাঁড়াতে পারত না। তারা যথেষ্ট প্রতিভাবান। তারা চাইলে নিজের জীবনের জন্য আপনাদের চেয়েও চমৎকার ভাগ্য গড়ে নিতে পারত। তারা তা চায় না। তারা জীবনের নিরাপত্তা খোঁজে না, তারা শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে মরতে চায়। মৃত্যুর ভয়ে তারা কেউই ভীত নয়।
ইন্সপেক্টর: স্যার, লোকটা সব সময় এভাবেই কথা বলে। যত্তসব মিথ্যা অহংকার। মানুষের সম্মানের সে কোন মূল্যই দিতে জানে না। আপনি যে সম্মান তাকে দেখালেন, সেজন্য তার উচিত ছিল-
দারা: জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা, নিজের বিপ্লবী বন্ধুদের ধরিয়ে দেয়া। একজন বিপ্লবীকে আপনারা কী ভাবেন? তারা কি আপনাদের মতোই সাধারণ? না তারা তা নয়। দু একজন বিশ্বাসঘাতকতা করলেও, একজন বিপ্লবী মানেই সে জনগণের জন্য লড়ে, জনগণের বিরুদ্ধে নয়।
সুপার: ঠিক আছে বিষয়টা নিয়ে আপনি ভাবনা-চিন্তা করুন। আমাদের তেমন কোন তাড়া নেই। আমি বিকালে আর একবার এসে না হয় আপনার সাথে কথা বলে যাব। ওনাকে এখন বিশ্রামে যেতে নিন। [ইন্সপেক্টর বেল বাজালে একজন সিপাহী এসে দাঁড়ায়।] ঠিক আছে আপনি এখন গিয়ে বিশ্রাম নিন। [সিপাহীর সাথে দারা বাহাদুর বের হয়ে যায়। সুপার তারপর ইন্সপেক্টরকে বলে।] একটু শক্ত লোক। মুখে কাপড় বেঁধে পানি ঢালুন। দেখা যাক তারপর কি দাঁড়ায়।
চতুর্থ দৃশ্য
(সেইদিন সন্ধ্যা। থানা অফিসে শূন্য ইন্সপেক্টরের কক্ষ। কথা বলতে বলতে সেখানে প্রবেশ করে পুলিশ সুপার এবং ইন্সপেক্টর।)
ইন্সপেক্টর: আমরা স্যার, মুখে পানি ঢালা শুরু করে যত রকম অত্যাচার করা দরকার করেছি। কিন্তু লোকটার শরীর যেন স্যার লোহা দিয়ে তৈরি। কোনভাবেই মুখ খুলছে না। পিঠের ওপর বরফ চাপিয়েও রাখা হয়েছিল। লাভ হয়নি। অবশ্য আমরা তার ওপর এমন কোন অত্যাচার করার ঝুঁকি নেইনি যাতে সে মারা পড়তে পারে।
সুপার: হ্যাঁ, সেটা ঠিকই করেছেন। সে মারা পড়লে দলের সদস্যদের নাম-ঠিকানাগুলো জানার একটা বড় উৎস আমরা হারিয়ে ফেলব। রাহুল দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও আমাদেরকে নাম ঠিকানা জানার ব্যাপারে তেমন কোন সাহায্য করতে পারেনি।
ইন্সপেক্টর: রাহুল স্যার দলের খুব ছোট খাটো একজন কর্মী এবং বলতে গেলে একেবারে নতুন। সে স্যার দলে ঢুকেছিল সখের কারণে। হিরো হবার জন্য, বিপ্লব সে থোড়াই বোঝে।
সুপার: রাহুলের মত ছেলেরা ওদের দলে ঢোকাতে আমাদের জন্যই লাভ হয়েছে। আমরা ওদের ধরতে পারছি। রাহুলরা হচ্ছে সখের বিপ্লবী। বাহাদুরীর নেশায় কিম্বা রোমাঞ্চ লাভের জন্য এরা গুপ্ত দলে যোগ দেয়।
ইন্সপেক্টর: হ্যাঁ স্যার, আজ না হোক কাল, এক সময় ওরা দল ছেড়ে চলে আসবেই। তখন পুলিশের হয়ে কাজ করবে।
সুপার: দারা বাহাদুরের ব্যাপারটা ভাবুন কি ভাবে কি করা যায়। দলের সব খবরা-খবর রয়েছে ওর হাতে। সব খবর না পেলে বোঝার উপায় নেই গুপ্তদলের কতটা মুখের আস্ফালন আর কতটাই বা সত্যিকারের কাজ।
ইন্সপেক্টর: স্যার, একটা খবর আপনাকে দেয়া হয়নি। রাহুলের সাথের যে ছেলেটাকে পুলিশ কাল আপনার বাসায় ধরতে পারেনি, সে নাকি রাহুলকে আজ একটা চিঠি দিয়েছে। মৃত্যুর জন্য তৈরি হয়ে থাকতে বলেছে রাহুলকে। বেশ নাটকীয় ব্যাপার।
সুপার: রাহুলের ওপর কড়া নজর রাখবেন। রাহুলকেকে মারার জন্য ওদের দল থেকে কাউকে না কাউকে পাঠান হবে। যাকেই পাঠান হোক আক্রমণকারী যেন কোনভাবে পালাতে না পারে সেটা দেখতে হবে।
ইন্সপেক্টর: হ্যাঁ স্যার, আমাদের সেকেন্ড অফিসার দেখছেন ব্যাপারটা। একটা ছোট ছেলেকে নাকি ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে ওখানে। অবশ্য ছেলেটা যে ওদের দলের এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। [বাইরে থেকে দারাকে আসতে দেখে] ঐ যে স্যার, দারা বাহাদুরকে নিয়ে আসা হচ্ছে। [একজন সিপাহী দারা বাহাদুরকে রেখে চলে যায় ]
সুপার: আসুন, আসুন দারা বাহাদুর সাহেব। বসুন। (দারা বসে) সে কি, আপনার ওপর আবার হাত তোলা হয়েছে? কী ব্যাপার ইন্সপেক্টর সাহেব, তাঁর গায়ে আপনি আবার হাত তুলেছেন কেন, আপনাকে না বললাম এসবের কোন দরকার নেই। আপনি দেখছি আমার হুকুমও মানতে চান না।
ইন্সপেক্টর: স্যার, উপর থেকে হুকুম এসেছিল। মানে স্যার, স্বয়ং উপ-পরিদর্শক সাহেব আমাকে টেলিফোন করেছিলেন। উপ-পরিদর্শক সাহেবের ধারণা আপনি খুবই নরম প্রকৃতির লোক। সেজন্য আমাকে বলেছিলেন, নাম ঠিকানাগুলো জানার ব্যাপারে আমি যেন খানিকটা নির্দয় হই।
সুপার: আর আপনিও সেজন্য...। আমি সত্যিই দুঃখিত দারা বাহাদুর। আসলে আমাদের বড় সাহেবরা সবাই একটু মাথা গরম স্বভাবের। সে যাই হোক, আমি স্যারের সাথে কথা বলে নেব। দেখবেন কাল থেকে আর কোন ঘটনা ঘটবে না।
দারা: খুব ভাল নাটক জমিয়েছেন। দেখুন পুলিশ সুপার, কেন একটা জিনিস আপনি বুঝতে পারছেন না যে যতই ডালে ডালে আপনি চলেন না কে একজন বিপ্লবী কখনোই হারে না। সে তার নীতির জন্য প্রাণ দেয় কিন্তু হারে না। লোভ লালসা কোন কিছুর কাছেই সে নিজেকে সমর্পণ করে না।
সুপার: আপনি কি মনে করছেন আপনি কিম্বা আপনার মত আরো দু চারজন লোক প্রাণ দিলেই বিপ্লব সম্পন্ন হবে? শুধু রক্ত দিয়ে তো বিপ্লব হয় না। কোথাও হয়নি। বিপ্লবের জন্য দেশের সমগ্র মানুষের মধ্যে একটি ঐক্য দরকার। দরকার একজন নেতার যাকে সবাই মেনে নেবে। সেসব কোথায়? দেশে এখন হাজার জনের হাজার রকম মত। কেউ সংসদীয় পদ্ধতির সরকার চাচ্ছে, কেউ চাচ্ছে সমাজতন্ত্র। কেউ মনে করছে ধর্মই একমাত্র মুক্তির পথ। এবং সবাই জোরের সাথে বলছে তার মতটিই শুধু সঠিক, বাকি সব ভুয়ো। জনগণ এতসব মতের কোনটি যে বেছে নেবে তাই তো বুঝতে পারছে না।
দারা: দেশের জনগণ নিজেদের ভালমন্দ সম্পর্কে এখনো বোঝে না। সেজন্য যে যার নিজের নিজের সুবিধামত জনগণকে নিয়ে খেলছে। বিপ্লবীদের নানারকম কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়েই এইসব অসচেতন জনগণ ধীরে ধীরে সচেতন হয়ে উঠবে। একটি বিপ্লবের লক্ষ্যে তারা আজ হোক, কাল হোক ঐক্যবদ্ধ হবেই।
ইন্সপেক্টর: যে সন্ত্রাসবাদ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আপনারা বিপ্লব ঘটাতে চাইছেন সে পথে বিপ্লব আসবে না। গত বিশ বছরেই সেটা প্রত্যক্ষ করা গেছে। অতএব জনগণের নৈতিক সমর্থন আদায়ের দিকে আপনারা মন দিন। যদি আপনারা জনগণের জন্যই লড়াই করে থাকেন তাহলে প্রকাশ্য রাজনীতিতে অংশ নিন। জনগণ যদি আপনার পক্ষে থাকে তাহলে আপনাদের পালিয়ে রাজনীতি করার দরকার কি?
দারা: প্রত্যেক দেশেই বিপ্লবীদের প্রথম পালিয়ে পালিয়ে রাজনীতি করতে হয়েছে। এতে লজ্জার কিছু নেই। মুক্তিযুদ্ধের কথাই ভাবুন, জনগণ তো যুদ্ধের পক্ষেই ছিল। তারপরেও মুক্তি যোদ্ধাদের দেশের বাইরে পালিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিল কেন?
সুপার: দুমদাম দু একটা লোককে মেরে ভেবে দেখেন তো, ইতিহাসকে পাল্টানো যাবে? যে সরকারের বিরুদ্ধে আপনারা লড়ছেন, ভেবে দেখেছেন সে সরকার আপনাদের চেয়ে কতবেশি শক্তিশালী। আপনাদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য সরকারের রয়েছে বড় বড় সব প্রতিষ্ঠান। সামরিক বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, আমলা ও গোয়েন্দারা। এদের বিরুদ্ধে লড়তে হলে আপনাদের যে শক্তি দরকার তা কি আপনাদের আছে?
ইন্সপেক্টর: দেখুন, শ্রমিকরাও আপনাদের দলে নেই। তারা হয় ভাগাভাগি করে সরকারের দলে থেকে গেছে। নইলে শক্তিশালী বিরোধী দলগুলোতে আছে।
সুপার: সন্ত্রাসের পথ এবার আপনারা ছেড়ে দিন। জনগণের সাথে মিশে রাজনীতি করুন।
দারা: দেখুন পুলিশ সুপার, আপনি বোকা লোক নন। যথেষ্ট প্রাজ্ঞ। সে জন্যই বলছি গুপ্তদলের কর্মীরা কেউ সন্ত্রাসবাদী নয়। যেটুকু সন্ত্রাস তারা করছে তা বাধ্য হয়ে। সেটাকে সন্ত্রাসবাদ আখ্যা দেয়া ঠিক নয়। বিপ্লবীরা নিজেদের স্বার্থে তো কিছুই করে না এবং সাধারণের জান-মালের ওপরে তারা কখনো হামলা চালায়নি।
সুপার: হ্যাঁ সে কথা খুবই সত্যি। আপনারা আক্রমণ করেন ধনী মহাজনদের ওপর।
দারা: সারা দেশ জুড়ে কারা সন্ত্রাস করে বেড়াচ্ছে পুলিশ সুপার? সরকারের সেই সব পোষা গুণ্ডারা যাদেরকে আপনারা আশ্রয় দিয়ে রাখেন। আপনাদের সমর্থন পেয়ে তারাই সাধারণ নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে। সারাদেশে জুড়ে যে খুন জখম লুটতরাজ এবং নারী ধর্ষণ চলছে গুপ্তদলের কর্মীরা তো তা করছে না। করছে সরকারী দলের চেলা-চামুণ্ডারা।
ইন্সপেক্টর: শুধু সরকারী দলের ওপর সব দোষ চাপাচ্ছেন কেন? বিরোধী দলের লোকরাও এসব ব্যাপারে কম যায় না। সারাদেশে জুড়ে যত খুনাখুনী, বোমাবাজি সবই কি শুধু সরকারের দলের লোকরাই করছে?
সুপার: হ্যাঁ মানছি, সরকারের চেলা চামুণ্ডারা সন্ত্রাস করে বেড়াচ্ছে। পুলিশ সেটা দেখেও না দেখার ভান করছে। কেন? কারণ সংবিধানে আপনারা পুলিশকে সরকারের দাস বানিয়ে রেখেছেন। অতএব সরকারের ন্যায়-অন্যায় সব হুকুম মানতেই আমরা বাধ্য। যখন আপনারা ক্ষমতায় যাবেন, দেখবেন আপনাদের হুকুমে আমরা কত নিরীহ লোকের ওপর কালাকানুন জারী করে বসে আছি।
দারা: না, বিপ্লবীরা সেটা কখনো করবে না। সেটা করবার ক্ষমতাও কোন বিপ্লবীর নেই। বিপ্লবীরা ভিন্ন এক শিক্ষার মধ্যে বড় হচ্ছে। সেখানে ব্যক্তির চেয়ে দেশ বড়। দেশের চেয়ে জনগণ বড়।
সুপার: বিপ্লবীদের সম্পর্কে আমার ধারণা কিন্তু অন্যরকম। যারা নিজের দেশের ইতিহাসটাই ভাল করে জানে না, দেশের আত্মার সাথে যাদের পরিচয় নেই তারাই বলছে কিনা সারা দেশের ইতিহাস তারা পাল্টে দেবে। দেখুন আপনাদের দু চারজনের সততা দিয়ে তো আর বিপ্লব হবে না। বিপ্লবের প্রতি আমার সব রকম শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও বলছি, বিপ্লব করার মতো পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি।
ইন্সপেক্টর: চারদিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখুন, প্রত্যেকের মধ্যেই রয়েছে এক ধরণের অতি বৈপ্লবিক বুদ্ধিজীবী সাজবার প্রবণতা। কাঁচা বয়সের ছেলেরা পর্যন্ত স্কুল, কলেজ না ছাড়তেই বিপ্লবী তত্ত্ব দিয়ে বেড়াচ্ছে।
সুপার: যারা বিপ্লবী তত্ত্ব দিচ্ছে শ্রমিকদের সাথে তাদের কোন যোগাযোগ নেই। আপনি কি তাদের সাথে একমত হতে পারবেন? ছাত্র রাজনীতি তো সম্পূর্ণ আবেগ প্রবণতায় ভুগছে। এমনকি আমাদের জনসাধারণ পর্যন্ত অরাজক হয়ে উঠছে। কথায় কথায় হরতাল ডাকো, অফিস-আলাদত বন্ধ করে দাও। এরা বিপ্লবকে এগুতে না দিয়ে বরং পিছিয়ে দিচ্ছে। দেশের বুদ্ধিমান লোকদের এখন উচিত রাজনীতির কচকচি ছেড়ে দিয়ে সবার আগে দেশটাকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসা।
দারা: রাজনীতি সম্পর্কে আপনি বেশ চমৎকার বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন। আপনার উচিত পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এবার রাজনীতিতে যোগ দেয়া।
সুপার: রাজনীতি করলে আমি খারাপ করতাম না। কারণ দেশের সমস্যাগুলো কি আমি তা জানি।
ইন্সপেক্টর: বেশির ভাগ রাজনৈতিক নেতাকে জিজ্ঞেস করুন দেখবেন তারা তার কিছুই জানে না। এমন কি আপনারাও কিছু কিছু ব্যাপার একদম বুঝতেই চান না।
সুপার: শুধু শুধু ছেলে-ছোকরাদের পেছনে লাগি না। কী স্বার্থ আছে আমাদের বলুন? আপনারা বিপ্লবীরা ভিন্নজাতের মানুষ। পার্টি ছাড়া কিছুই বুঝতে চান না।
ইন্সপেক্টর: দারা বাহাদুর, এবার কিন্তু আপনার নাম ঠিকানাগুলো বলে দেয়া উচিত। স্যার তো বলল আমরা তাদের কোন ক্ষতি করব না।
দারা: বাহ। এতক্ষণ এত আলোচনার পর আপনি ঘুরে ফিরে সেই পুরানো জায়গাতেই ফিরে গেলেন। বন্ধু হিসাবেই আপনাদের বলছি, নাম ঠিকানাগুলো তো আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।
ইন্সপেক্টর: কেন বলবেন না? ঐ লোকগুলো আপনার কে? ঐ লোকগুলোকে বাঁচাবার জন্য কেন আপনি নিজেকে নিঃশেষ করবেন?
সুপার: আমি বন্ধু হিসাবে সৎ পরামর্শই দিচ্ছি। নামগুলো বলার পর আমরা আপনাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেব। সেখানে আপনি সুখে জীবন যাপন করবেন। আমার সাথে দুপুরে মন্ত্রাণালয়ের কথা হয়েছে।
দারা: চমৎকার, আমার সুখ-দুঃখ নিয়ে দেখছি আপনাদের মন্ত্রণালয়গুলো যথেষ্ট মাথাব্যাথা রয়েছে। দেখুন নাম ঠিকানাগুলো বলে দিলে আপনারা যেমন আমাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবেন, তেমনি বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে আমার দলের লোকেরা আমার গলা কাটবে।
সুপার: না, সেটা সম্ভব হবে না। দলের লোকরা যাতে আপনার ক্ষতি করতে না পারে সেজন্যই তো আমরা আপনাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেব। এ দেশের লোকেরা তো এখন ইউরোপ বা আমেরিকায় যাবার জন্য পাগল। ভেবে দেখুন, সেই ইউরোপ বা আমেরিকার কোন শহরে আপনি থাকতে পারছেন।
ইন্সপেক্টর: স্যার, যে-কোন লোকের জন্য এ সুযোগ লাভ এখন হাতে স্বর্গ পাওয়ার মতো।
দারা: হ্যাঁ, নাম ঠিকানাগুলো আমার বলে দেয়াই উচিত। ইউরোপ বা আমেরিকার কোন হোটেলে গিয়ে বয় বেয়ারার কাজ করব কিম্বা কোন দোকানের সেলসম্যান, এর চেয়ে সুখের জীবন আর কি হতে পারে। (স্বরপাল্টে) সুপার, আপনি আমাকে লোভ দেখাতে এসেছেন! এই সামান্য লোভ দেখিয়ে আপনি আমার মতাদর্শ কিনে নিতে চান? শুনুন, সুপার, ভাল করে জেনে নিন, এই দেশের ভাগ্যের সাথেই আমরা নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছি। এই দেশের সমস্ত মানুষের মুক্তি মানেই আমাদের মুক্তি।
সুপার: তাহলে আপনি আমাকে ভিন্ন খেলা খেলতে বাধ্য করলেন। বন্ধু হিসাবে সেজন্য আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। বুঝতেই পারছেন আমি আমার চাকুরির প্রতি বিশ্বস্ত। আমার কাজ হচ্ছে দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা। বেশ নিষ্ঠার সাথেই আমি তা করে থাকি।
দারা: আমিও বিপ্লবের প্রতি সর্বান্তকরণে বিশ্বস্ত এবং মনে রাখবেন, বিপ্লব আমার কাছে কোন চাকরি নয়। সামাজিক এক দায়িত্ব।
সুপার: বিপ্লবের প্রতি আপনি যতই বিশ্বস্ত থাকুন না কেন, সরকারের সাথে লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত আপনারা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন ভেবে দেখুন। সরকারের রথের চাকায় গুঁড়িয়ে যাবেন। সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই আপনাদের দু একজন বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এরপর আরো বহুজন দল ছেড়ে চলে আসবে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন আপনারা।
দারা: নিজের কথা ভাবুন। বন্ধু, শুধু নিজের কথা ভাবুন, আপনারা কী ঘটবে। খেয়াল রাখবেন, বিপ্লবীরা যেন শেষে আপনার প্রাণটা না নিয়ে নেয়।
সুপার: বেড়াল হয়ে বাঘের হুংকার দিচ্ছেন। আমার প্রাণ নেবে আপনাদের বিপ্লবীরা। নিজেদের যতটা শক্তিশালী আপনারা ভাবছেন ততটা শক্তিশালী আপনারা নন। দু একটা বোমা ফাটিয়ে আর দু চার জনকে খুনজখম করে সারা দেশ দখল করা যায় না। আপনি যেমন ধরা পড়েছেন, আপনাদের বাকি বিপ্লবীরাও একে একে সেভাবেই ধরা পড়বে।
দারা: আমার মনে হয় আপনার সাথে আমার আর কিছু আলোচনা করবার নেই। একথা আমি খুব স্মরণ রাখব যে, আপনি ছিলেন আমার শেষ বন্ধুদের একজন (দারা উঠে রওয়ানা দেয়)
সুপার: আপনার আঙুল আমি একটা একটা করে ভাঙাবো, দাঁত একটা একটা করে টেনে তুলব এবং দরকার হলে আপনার জিহবা ছিঁড়ে নেব। তারপরেও দেখব, আপনি নাম ঠিকানাগুলো কী করে না বলে পারেন!
দারা: ভয় দেখাচ্ছেন, আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন, ভয় দেখাবেন না, ভয় দেখাবেন না, আমাকে ভয় দেখাবেন না। (দারা বাহাদুর কক্ষ থেকে প্রস্থান করে। হঠাৎ টেলিফোন বেজে ওঠে। ইন্সপেক্টর রিসিভার তুলে নেয়)
ইন্সপেক্টর: হ্যালো, হ্যাঁ স্যার (সে উঠে দাঁড়ায়) জ্বী স্যার, এখানেই আছেন। দিচ্ছি স্যার। (পুলিশ সুপারের দিকে রিসিভার এগিয়ে দেয়) স্যার, আপনার টেলিফোন। উপ-পরিদর্শক সাহেব।
সুপার: (রিসিভার নিয়ে) হ্যালো, হ্যাঁ স্যার। আপনি কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। (রিসিভার রেখে দেয়) ইন্সপেক্টর, দারা বাহাদুরের ওপর যেন আর কোন অত্যাচার না করা হয়।
ইন্সপেক্টর: কেন স্যার?
সুপার: কাল ওর বাবা আসবেন ওর সাথে দেখা করতে। তিনি যেন এসব কিছু টের না পান।
ইন্সপেক্টর: দারা বাহাদুরের বাবা! কে স্যার?
সুপার: দেশের একজন বড় ব্যবসায়ী। তিনি চেষ্টা করবেন ছেলের কাছ থেকে নাম ঠিকানাগুলো আদায় করতে। মনে রাখবেন দারা বাহাদুরের বাবা সরকারী দলকে বিরাট অংকের টাকা চাঁদা দিয়ে থাকেন। আপনার ওপর তিনি যদি অখুশী হোন আপনার চাকুরি নিয়েও টানাটানি লাগতে পারে। চলবে