ফরহাদ মজহারের কুরবানি বিষয়ক প্রস্তাবনা ও কিছু কথা

শেষ পর্ব

তুহিন খান

প্রকাশিত : জুলাই ২৭, ২০২১

বাইবেলে হযরত ইব্রাহিমের ঘটনাটা কীভাবে বর্ণিত আছে, অনেকেই জানেন। বাইবেলে আল্লাহর আদেশ বা ওহিটি সরাসরি এবং সুনির্দিষ্ট; সেখানে ব্যক্তি, স্থান, আদেশ এবং কাজের ধরন— সবই সুনির্দিষ্ট। এবং হযরত ইব্রাহিমই সেখানে একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সজ্ঞানে খোদার এই আদেশ পালনে অংশগ্রহণ করতেছেন। কোরবানির ঘটনাটি সেইখানে একান্তই হযরত ইব্রাহিমের; এতটাই একান্ত যে, যিনি কোরবানি হবেন, সেই ইসহাকও কিছুই জানতেন না। খোদার আদেশ পালনে ইব্রাহিমের এই অসহায় একাকিত্ব ও চরম গোপনীয়তা রক্ষারেই কিয়ের্কেগার্ড বলছেন `ঈমানের পরম সাক্ষী`; দেরিদার ভাষায়, `পরমের সাথে একজনমাত্র ব্যক্তির পরম সম্পর্ক`। কোরআনে ঘটনাটা তেমনভাবে বলা হয় নাই।

কোরআনে সুরা সাফফাতের ১০১-১০৭ নম্বর আয়াতে ঘটনাটা বর্ণনা করা হইছে। কোরআনে বর্ণিত এই ঘটনাটি বিশ্লেষণ করতে গিয়া, মুফাসসিরিন কোন কোন দিকগুলা নিয়া আলাপ করছেন, এবং এই ঘটনার সাথে বাইবেলের ঘটনার কী কী অমিল আছে, সেগুলা আমরা সামনে বলার চেষ্টা করব।

প্রথমত, কোরআনে বর্ণিত ঘটনাটিতে কোন ছেলেরে উৎসর্গ করা হইছিল, সেটা ডিরেক্ট বলা নাই। আলাপটা আলোচ্য তর্কের ক্ষেত্রে মাইনর ধইরা নিলেও, কোরআনের সাথে বাইবেলের বর্ণনার ফারাকের ক্ষেত্রে, মেজর; এই ফারাক থেকেও আমরা কোরআন ও বাইবেলের ন্যারেটিভ বা বর্ণনাভঙ্গির কিছু ইউনিকনেস আবিষ্কার করতে পারি। ফরহাদ মজহার তার লেখায় বলছেন, এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর সকল মুফাসসির একমত যে, এই পুত্র ইসমাইল। তথ্যটা সঠিক না।

মোটাদাগে বলা যায়, মুতাকাদ্দিমিন বা পূর্বযুগের অনেক মুফাসসিরের মতে, এই পুত্র ইসহাক (বাইবেলের মতও তাই)। কিন্তু মুতাআখখিরিন বা উত্তরযুগের মুফাসসিরদের মতে, ইনি ইসমাইল।

১. আল্লামা তাবারি (২২৪-৩১০ হি.) তার তাফসিরে `আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম— এর ব্যাখ্যায়, বিখ্যাত মুফাসসির ও তাবেয়ি ইকরিমা ও কাতাদার বরাতে লিখছেন যে, এই পুত্র ইসহাক। এমনকি এ ব্যাপারে কোন ভিন্নমতের উল্লেখও উনি করেন নাই। (তাবারি, ৩৭: ১০১)

২. আরেক বিখ্যাত মুফাসসির আল্লামা কুরতুবি (মৃ. ৬৭১ হি.) তার তাফসিরে ভিন্নমতের উল্লেখ করে বলছেন: `বেশিরভাগ আলেমের মত এই যে, এই ছেলে ইসহাক`। এরপর তিনি এই মতের পক্ষে থাকা আলেমদের লিস্ট দিছেন, যা এরকম: (সাহাবিদের মধ্যে) হযরত আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হযরত আলি, হযরত উমর এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উমর। (তাবেয়ি ও অন্যান্যদের মধ্যে) আলকামা, শা`বি, মুজাহিদ, সাইদ ইবনে জুবাইর, কা`ব আল আহবার, কাতাদা, মাসরুক, ইকরিমা, কাসেম বিন আবু বাযযা, আতা, মুকাতিল, আব্দুর রহমান বিন সাবিত, যুহরি, সুদ্দি, আব্দুল্লাহ ইবনে আবু হুজাইল, ফকিহ মালেক ইবনে আনাস। অনেকের থেকে আবার দুই ধরনের বক্তব্য বর্ণিত আছে। যেমন: আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উমর।

যাই হোক, কুরতুবির মতে, হযরত ইসহাকের দিকেই বেশিরভাগ আলেমের মতামত। কুরতুবি তার তাফসিরে ভিন্নমতাবলম্বীদের যুক্তিগুলা খণ্ডনও করছেন। (কুরতুবি, ৩৭:১০২)

৩. আরেক বিখ্যাত মুফাসসির ইমাম বাগাভি (৪৩৩/৩৬-৫১৬ হি.) তার তাফসিরে দুইপক্ষের মতামত ও দলিল উল্লেখ কইরা, কোন পক্ষ না নিয়া শুধু এতটুকু বলছেন: `রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে দুই ধরনের বর্ণনাই পাওয়া যায়`। (বাগাভি, ৩৭:১০২)

৪. আরেক বিখ্যাত মুফাসসির আল্লামা ইবনুল জাওযি (৫১০-৫৯৭ হি.) তার তাফসিরে দুইটি মত, উভয়পক্ষে থাকা আলেমদের নাম ইত্যাদি উল্লেখ করার পর লিখেছেন: `আমাদের সাথীরা প্রথম মতরেই (ইসহাক) প্রাধান্য দেন।` (ইবনুল জাওযি, ৩৭:১০২)।

৫. আল্লামা ইবনে কাসিরই (৭০১-৭৭৪ হি.) সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ মুফাসসিরদের মধ্যে সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি খুব দৃঢ়ভাবে হযরত ইসমাইলের পক্ষে মতামত দিছেন, এবং হযরত ইসহাকের পক্ষের মতগুলারে `ইহুদি-খ্রিস্টান পাদ্রিদের থেকে অনুপ্রবেশকৃত মতামত, কোরআন-সুন্নাহয় যার কোন প্রমাণ নাই` বলে শক্তভাবে নাকচ ও বাতিল করছেন। উনার মতে, আহলে কিতাব আলেমরা সব জানার পরেও, হযরত ইসমাইলের প্রতি হিংসাবশত (যেহেতু উনি আরবদের নেতা) হযরত ইসহাকের নাম ঢুকায়ে দিছেন তাদের কিতাবে। ইবনে কাসির কা`বুল আহবার নামের একজন মুফাসসির তাবেয়িরে এইসব বর্ণনার জন্য দায়ী করছেন। উনার মতে, কা`বের মাধ্যমেই এসব বর্ণনা তাফসিরের কিতাবে অনুপ্রবেশ করছে, কারণ কা`ব অনেক বেশি আহলে কিতাবদের ঘটনা বয়ান করতেন। এবং এসব করার জন্য ইবনে কাসির ওনার সমালোচনাও করছেন। (ইবনে কাসির, ৩৭:১০২; তাফহিম, ১৩/৬৫-৬৬)

মুতাআখখেরিন এবং মডার্ন স্কলারদের অধিকাংশই ইবনে কাসিরের এই ফয়সালা মেনে নিছেন। মাওলানা মওদুদি তার তাফহিমে দুইপক্ষের মত বয়ান কইরা, হযরত ইসমাইলের পক্ষে যুক্তি প্রমাণ দিছেন এবং এ ব্যাপারে ইবনে কাসিরের ব্যাখ্যারেই চূড়ান্ত ধরছেন। উনার মতে, কা`বুল আহবারের অসতর্কতা, ইহুদিদের অপপ্রচার ও মুসলিম স্কলারদের সরলমনই এসব বর্ণনা তাফসিরের কিতাবে ঢোকার জন্য দায়ী (তাফহিম, ১৩/৬৫-৬৬)। মুফাসসিরদের মধ্যে ইসরাইলি রেওয়ায়েতের সমালোচনা এবং সেসব গ্রহণের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাইয়ের ধারা চালু থাকার একটা নজির হিশাবে, এই মতামতটিরে পড়া যাইতে পারে।

তবে, অনেকেই আবার দৃঢ়ভাবে এসব মতামতের কোন একটারে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারটারে বিপজ্জনক ভাবছেন। এমন একজন আলেম হলেন উপমহাদেশের বিখ্যাত স্কলার, অনেক দেওবন্দী আলেমের উস্তাদ ও আহলে হাদিস আন্দোলনের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক নওয়াব সিদ্দিক হাসান খান (১৮৩২-১৮৯০)। উনি ওনার তাফসিরে এ ব্যাপারে যা লিখছেন, তার সারকথা এই যে: এ ব্যাপারে দুই দলের মতামতই অনুমাননির্ভর, এবং তাদের দলিলগুলা এমন না, যার দ্বারা দৃঢ়ভাবে কোন একটা মত বিশ্বাস করা বা প্রাধান্য দেওয়া জরুরি। আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সূত্রে এ প্রসঙ্গে যেসব বর্ণনা আছে, সেগুলা হয় বানোয়াট বা খুবই দুর্বল। আর, কোরআনের যেসব ইশারা ইঙ্গিত এ ব্যাপারে দলিল হিশাবে আনা হয়, সেগুলা অকাট্য না, এহতেমালি। এ ধরনের দলিল দিয়া কোনকিছু অকাট্যভাবে সাব্যস্ত হয় না। তাই এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকাই জরুরি। (ফাতহুল বায়ান, ৩৭:১০২)

উপরের আলাপ থেকে এইটাই বোঝা গেল যে, কাকে কোরবানি করার কথা কোরআনে বলা হইছে, এ ব্যাপারে স্কলারদের মধ্যে বেশ বড়সড় এখতেলাফ আছে। যারা হযরত ইসমাইলের পক্ষে দলিল দিছেন, তারা ইহুদিদের জাতপ্রীতিমূলক চক্রান্তের আলাপ আনছেন বটে; কিন্তু ভিন্নমতের মুসলিম স্কলাররা কেন সেসব মত গ্রহণ করলেন, তার কোন শক্তিশালী জবাব দিতে পারেন নাই। ইসরায়েলি রেওয়ায়েত হিশেবেই এই মতটারে তারা বাতিল করতে চাইছেন। কিন্তু, কেন খোদ কোরআনে এ ব্যাপারে পষ্ট কিছু বলা হয় নাই, তা নিয়ে কোন মুফাসসিরেরই বিশেষ কোন আলাপ আমার চোখে পড়ে নাই।

আমার ধারণা, হযরত ইসহাক ও ইসমাইলরে কেন্দ্র করে যে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব ও বিদ্বেষের পরিবেশ তৈয়ার করছিল আহলে কিতাবরা, যে কারণে আরবদের মধ্যে, ইসমাইলের বংশে রাসুল আসায় তারা মাইনা নিতে চায় নাই, সেই জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাটারে কম গুরুত্ব দিতে চাওয়া এর একটা কারণ হইতে পারে। আমরা দেখছি, ছেলের নাম বিষয়ক ডিবেটে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের আলাপগুলাই প্রমিন্যান্ট হয়ে উঠছে। এই এক কারণ হইতে পারে।

ফিলিস্তিনি স্কলার শায়খ বাসসাম জাররার এক্ষেত্রে আরেকটা কারণ বয়ান করছেন। উনার মতে, কারে জবাই করার জন্য নেওয়া হইছিল, কোরআনে এইটা গুরুতর কোন বিষয় না। যারেই নেওয়া হোক, কোরআনে এই ঘটনা বয়ানের মাকসাদ তাতে ছুটে না। কিন্তু, বাইবেলে এইটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে; এতটাই যে, বাইবেলে পুত্রের নাম তো বলাই হইছে, সাথে `একমাত্র পুত্র` শব্দটাও আছে, তাও তিন তিনবার; যা যৌক্তিক না। কারণ ঘটনার সময় ইসহাক ইব্রাহিমের একমাত্র পুত্র ছিলেন না। শায়খ বাসসামের মতে, পুত্রের নামের ক্ষেত্রে বাইবেলের এই অহেতু জোরারোপ, তাও ঐতিহাসিক ফ্যাক্টের বিপরীতে গিয়া, বেশ সন্দেহজনক। কোরআন ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রে এই ধরনের ডিটেইলিংয়ে যায় নাই কখনোই। এছাড়া আরো কারণ থাকতে পারে অবশ্য। আল্লাহ সর্বজ্ঞ।