বাঙালির বই লেখার মতো করুণ ট্র্যাজেডি জগতে বিরল
ফাহাম আবদুস সালামপ্রকাশিত : নভেম্বর ১৫, ২০২০
একটা সময়ে বাংলাদেশে একটা ডিসেন্ট মিলের ৭০-১০০ টাকা। এখন পাঁচশো টাকা। এইদেশে একটা ব্র্যান্ড নিউ বইয়ের গড় (মিডিয়ান) দাম হবে তিনশো টাকার আশপাশে। একটা ডিসেন্ট মিলের ৬০% দামে আপনি একটা নতুন বই কিনতে পারছেন। এই ঘটনা ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডে অকল্পনীয়। অষ্ট্রেলিয়ায় একটা ডিসেন্ট মিল হবে ১২ ডলার এবং একটা নতুন বইয়ের (হার্ড ব্যাক) গড় দাম হবে ৩০ ডলার। আমার অনুমান, ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডে একটা ডিসেন্ট মিলের আড়াই গুণ হবে একটা বইয়ের দাম।
একটু কনটেক্সটে ফেলি? পশ্চিমের সাথে তুলনা করলে বাংলাদেশে একটা নতুন হার্ড ব্যাক বইয়ের দাম হতে পারতো ১২৫০ টাকা। অথচ এখানে বইয়ের মিডিয়ান প্রাইস হবে হয়তো তিনশো টাকা। কিন্তু কেউ বই কেনে না, পড়েও না। প্রথম বিশ্বের মানুষ বই কেনে, বই পড়ে এবং নন-একাডেমিক লোকরা বই নিয়ে আলোচনা করে। ঢাকা আর সিডনীতে জীবনধারণের খরচ কিন্তু প্রায় একই। বরঞ্চ ক্ষেত্র বিশেষে ঢাকা বেশি এক্সপেন্সিভ।
ঢাকা শহরে কোনো মানুষ দিনে মিনিমাম দেড় ঘণ্টা ট্র্যাফিক জ্যামে চুপ করে বসে থাকেন না, এমন মানুষ খুবই কম। কিন্তু তারা বই পড়েন না। আমি বাংলাদেশে জীবনে কোনোদিন কোনো চুলপাকা মহিলাকে কোনো বইয়ের দোকানে দেখিনি, আল্লাহর কসম। এই গ্রূপ অফ পিপলকে আপনি ওয়েস্টে যেকোনো দোকানে পাবেন। এবং আমার অভিজ্ঞতা বলে, ক্যানবেরায় য়ুনিভার্সিটি-সেটিংয়ের বাইরে বয়স্ক মহিলারাই সবচেয়ে ওয়েল রেড এবং কালচার্ড (কনভেনশনাল সেন্সে)।
বইয়ের দাম এত কম, বই পড়ার এত অফুরন্ত সময়— ঢাকা ইজ টেইলর-মেইড ফর বুক লাভার্স। কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষ বই পড়বে না। কখনোই পড়বে না। যে বই পড়লে চাকরি হয় না, সে বইয়ের চেয়ে বাঙালির জীবনে একটা জাঙিয়ার মূল্য অনেক বেশি। আপনি বলতে পারেন, এখানকার লেখকরা লালুভুলু বলে বই প্রকাশনা শিল্প গড়ে ওঠেনি। কথার মেরিট আছে। কিন্তু অন্য ভাষার বইও তো তেমন কেউ পড়ে না।
বাংলা ভাষায় কেউ ম্যাকবেথ লিখলেও কেউ জানতেই পারবে না, একটা মাস্টারপিস লেখা হয়েছে। কারণ বাংলাদেশের মানুষ প্রবলভাবে এন্টিইন্টেলেকচুয়াল। ১৬ কোটি মানুষের দেশে (যেখানে মিনিমাম ৯-১০ কোটি মানুষ পড়তে জানে) একজন ফিকশন রাইটার নাই যে ফিকশান লিখে জীবনধারণ করতে পারে। একজনও নাই। ১৯৯৪ সালে পেশাওয়ারে আমি এমন বইয়ের দোকানে গেছি যেই একটা দোকানের একটা ফ্লোর। পুরা আজিজ সুপার মার্কেটের সব দোকান মিলালে তার চাইতে অনেক বড় হবে।
আমি লাহোরের কথা বলছি না। অশিক্ষিত জাহিলদের পেশাওয়ারের কথা বলছি। পুরাপুরি মনে নেই এখন, কিন্তু এত বড় দোকানে আমি কোনো উর্দু-পশতু বই দেখি নাই। আপনি যদি মনে করে থাকেন, এই দেশে কখনোই প্রকাশনা শিল্প তৈরী হবে, ইউ আর মিস্টেকেন। কারণ এখানে ডিমান্ড নাই। মূল সমস্যা সাপ্লাইয়ের না, ডিমান্ডের। মহৎ সাহিত্য তৈরি হয় কারণ পাঠক মহৎ সাহিত্যের চেয়ে নিচে কিছু গোনায় ধরে না। বাংলাদেশের ৯৯টি শিক্ষিত মানুষের জীবনে বইয়ের কোনো স্টেডি ডিমান্ড নাই।
ইন ফ্যাক্ট য়ুনিভার্সিটি পাশ করার পর প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো বই হাতে তোলে, এমন বাঙালি আমি জীবনে দেখেছি সম্ভবত চারজন। এখানে বই নিয়ে আলোচনা করা, প্রকাশনা নিয়ে হাপিত্যেশ করার কোনো মানে হয় না আসলে। শেষ বিচারে, বাঙালির জন্য বই লেখার মতো করুণ ট্র্যাজেডি জগতে সত্যিই বিরল।
























