মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ

ভারত ভাগ হ‌য়ে‌ছে দ্বিজা‌তির প্রশ্নে, এটা একটা মিথ্যাচার

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৬, ২০২৫

ভারত ভা‌গ হ‌য়ে‌ছে দ্বিজা‌তির প্রশ্নে নয়, না হিন্দু-মুস‌লিম বি‌রো‌ধের প্রশ্নে। ভার‌ত ভা‌গ হয়ে‌ছে সাংবিধা‌নিক প্রশ্নে। মূল বি‌রোধটা ছিল সংবিধান রচনা নি‌য়ে। ভার‌তের মুসলমান‌দের বিরাট অংশ কৃষক বা শ্রমজীবী, ভার‌তের হিন্দু‌দের বৃহৎ অংশ ছিল কৃষক, শ্রমজীবী, দ‌লিত বা নিম্ন ব‌র্ণের। দু’পক্ষই ছি‌ল অসাম্প্রদা‌য়িক দরিদ্র মানুষ। ভারত ভা‌গে এদের সামান‌্য ভূ‌মিকা ছিল না। দ্বিতীয় কথা, দ্বিজা‌তি ত‌ত্ত্বের প্রশ্নটি কখ‌নো জিন্নাহ প্রথম উপস্থাপন ক‌রেন‌নি। দ্বিজা‌তি ত‌ত্ত্বের কথা প্রথম উপস্থাপন ক‌রেন ১৯২৫ সা‌লে লালা লাজপত রায় তার ধ‌ারাবা‌হিক রচনায়। দ্বিতীয় বার ১৯৩৫ সা‌লে‌ রো‌য়েদাদ‌কে ঘি‌রে দ্বিজা‌তি ত‌ত্ত্বের কথা ব‌লেন বাংলার বর্ণ‌হিন্দুরা, এ ব‌্যাপা‌রে জয়া চ‌্যাটার্জীর `বাংলা ভাগ হ‌লো` বইয়ে স্পষ্ট বলা আছে। যখন ১৯৩৮ সা‌লে হিন্দু মহাসভার নেতা দ্বিজা‌তি তত্ত্বকে আরও‌ ফু‌লি‌য়ে-ফাঁ‌পি‌য়ে ব‌লে যে, ভারতে জা‌তি আছে দুটা: হিন্দু আর মুস‌লিম। স্বাধীন ভার‌তে মুস‌লিমরা হ‌বে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগ‌রিক। গান্ধী এ ব‌্যাপা‌রে হিন্দু মহাসভার বক্ত‌ব্যের বিরু‌দ্ধে না দাঁড়া‌লে জিন্নাহ ম‌নে ক‌রেন, সংখ‌্যালঘু মুসলমানরা ভার‌তে কংগ্রেস আর হিন্দু মহাসভার কা‌ছে নিরাপদ নয়।

 

জিন্নাহ বুঝ‌তে পার‌লেন, মুসলমান‌দের যেভা‌বে হিন্দু মহসভা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগ‌রিক ব‌লে‌ছে তা মে‌নে নেয়া যায় না। ভিন্ন দি‌কে কং‌গ্রেস তার প্রতিবাদ ক‌রেনি। ভার‌তে মুসলমান‌দের কং‌গ্রেস তাহ‌লে সমান অধিকার দি‌তে চায় না। তি‌নি তখন বল‌লেন, মুস‌লিম প্রধান পাঁচ‌টি প্রদেশ আর হিন্দু প্রধান ছয়‌টি প্রদেশ নি‌য়ে ভার‌তে এক‌টি কন‌ফেডা‌রেশ রাষ্ট্র তৈ‌রি কর‌তে হবে। সেটা ভারত ভাগ করা নয়। তি‌নি সংখ‌্যালঘু মুসলমান‌দের অধিকার প্রতিষ্ঠা কর‌তে চে‌য়ে‌ছি‌লেন। সারা বি‌শ্বে আজ সংখ‌্যালঘু‌দের অধিকার প্রতিষ্ঠা‌কে সম্ম‌ানের স‌ঙ্গে দেখা হয়। তি‌নি কখ‌নো ভারত ভাগ চান‌নি, চে‌য়ে‌ছেন প্রদেশগু‌লির পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন সহ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র। এমন‌কি ১৯৪০ এর লা‌হোর প্রস্তা‌বে পা‌কিস্তান শব্দটাই ছিল না। লা‌হোর প্রস্তা‌বের সভা শেষ হয় রাত ১টার দি‌কে। তার আগেই কং‌গ্রেসের প‌ত্রিকা মনগড়াভা‌বে বা উদ্দেশ‌্যমূলকভা‌বে ব‌লে দেয় জিন্নাহ `পা‌কিস্তান` চাইছে। লা‌হোর প্রস্তা‌বের দ‌লিলপত্র দেখ‌তে পা‌রে‌ন যে কেউ। জিন্নাহ কখ‌নো ভারত ভা‌গের কথা ব‌লেন‌নি। লা‌হোর প্রস্তা‌বে পা‌কিস্তা‌নের দা‌বি ছিল না।

 

জিন্নাহর স‌ঙ্গে কং‌গ্রেসের মূল যে বি‌রোধ, তা সাং‌বিধা‌নিক প্রশ্নে যে কথা‌টি কং‌গ্রেস এবং অন‌্যান‌্য ভারতীয় রাজ‌নৈ‌তিক ব‌্যক্তিত্বরা এড়ি‌য়ে যান। বাংলা‌দে‌শের রাজ‌নৈ‌তিক ব‌্যক্তিত্ব‌দের এ নি‌য়ে জানা আছে কিনা সেটা স‌ন্দেহ, কারণ তারাও এ নি‌য়ে কখ‌নো আলোচনা ক‌রে‌ন‌নি। ভার‌ত ভা‌গের আলোচনায় সবসময় দ্বিজা‌তি তত্ত্ব হা‌জির ক‌রে ‌জিন্নাহ‌কে দায়ী করা কং‌গ্রেসসহ অন‌্যান‌্যদের কূটচাল। একই স‌ঙ্গে বর্ণ‌হিন্দুরা বা কং‌গ্রেস আর হিন্দুমহাসভা নি‌জে‌দের দায় এড়া‌তে, সেই স‌ঙ্গে সাম্প্রদা‌য়িক বাতাবরণ তৈ‌রি কর‌তে জিন্না‌হকে সবসময় খলনায়ক বানা‌তে চে‌য়ে‌ছেন। কারণ গণমাধ‌্যম ও সংবাদপত্রগু‌লির মা‌লিকানা ছিল বর্ণ‌হিন্দু‌দের হা‌তে। নি‌জে‌দের মন মতন তারা জিন্নাহর প্রতি বি‌ষোদগার ক‌রে‌ছে, মিথ‌্যাচার ক‌রে‌ছে। সাম্প্রতিক সম‌য়ের গণমাধ‌্যমের দি‌কে তাকা‌লে তারা কীরকম মিথ‌্যাচার কর‌তে পা‌রে, সক‌লেরই জানা। দিন‌কে রাত বানা‌তে পা‌রে গণমাধ‌্যম।

 

জিন্নাহর স‌ঙ্গে ১৯২৭ সাল থে‌কে কং‌গ্রেসের প্রধান বি‌রোধ ছিল সং‌বিধান রচনার প্রশ্নে। জিন্নাহ বল‌তেন, সং‌বিধা‌নে সকল ক্ষমতা থাক‌বে প্রদেশগু‌লির হা‌তে, কে‌ন্দ্রের হা‌তে নয়। তিনি পররাষ্ট্র, বি‌ভিন্ন প্রদেশগু‌লির মধ‌্য যোগা‌যোগ রক্ষাসহ মাত্র তিন‌টি ক্ষমতা দি‌তে চে‌য়ে‌ছি‌লেন কে‌ন্দ্রের বা দিল্লীর হা‌তে। ভিন্ন দি‌কে কং‌গ্রেস চাইত, সকল ক্ষমতা থাক‌তে হ‌বে কে‌ন্দ্রের হা‌তে, যা‌তে কেন্দ্র চাইলে সকলভা‌বে প্রদেশগু‌লি‌কে নিয়ন্ত্রণ কর‌তে পা‌রে। জিন্নাহ আর এক‌টি কথা ব‌লে‌ছি‌লেন, এগা‌রো‌টি প্রদে‌শের যেখা‌নে মুসলমানরা সংখ‌্যাগ‌রিষ্ঠ, সেখা‌নে সংখ‌্যালঘু হিন্দু‌দের জনসংখ‌্যার অনুপা‌তের চে‌য়ে সামান‌্য কিছু আসন বে‌শি দিতে হবে। ঠিক একইভা‌বে যে ছয়‌টি প্রদে‌শে হিন্দুরা সংখ‌্যাগ‌রিষ্ঠ সেখা‌নে মুসলমান‌দের জনসংখ‌্যার চে‌য়ে কিছু আসন বে‌শি দি‌তে হ‌বে সংখ‌্যালঘু‌দের প্রতি সম্মান দেখা‌তে। কং‌গ্রেস এসব মান‌তে চায়‌নি। তা‌দের প্রধান কথা ছিল, কে‌ন্দ্রের হা‌তে সব নিয়ন্ত্রণ থাক‌তে হ‌বে। প্রদেশগু‌লি স্বাধীন থাক‌তে পার‌বে না। ভার‌তের বর্তমান সং‌বিধান যে কেউ দেখ‌তে পা‌রেন। প্রদেশগু‌লি কীভা‌বে কে‌ন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে আছে, কতবার বি‌ভিন্ন দে‌শের নির্বা‌চিত সরকার‌কে বাতিল ক‌রে দি‌য়ে‌ছে কেন্দ্র।

 

ক‌্যা‌বি‌নেট মিশন ভারত‌কে স্বাধীনতা দেয়ার জন‌্য ভারত‌কে এক‌টি যুক্তরাষ্ট্র হি‌সে‌বে দেখ‌তে চেষ্টা ক‌রে। তারা হিন্দু সংখ‌্যাগ‌রিষ্ঠ হিন্দু‌দের পাঁচটি প্রদেশ নি‌য়ে ক অঞ্চল গঠন ক‌রে। মুস‌লিম সংখ‌্যাগ‌রিষ্ঠ চার‌টি প্রদেশ নি‌য়ে খ অঞ্চল গঠন ক‌রে। ভিন্ন‌দি‌কে বাংলা ও আসাম প্রদেশ‌কে নি‌য়ে এক‌টি গ অঞ্চল গঠন ক‌রে। ১৯৪৬ সা‌লে ক‌্যা‌বি‌নেট মিশ‌নের প্রস্তাব জিন্নাহ এবং মুস‌লিম লীগ পু‌রোপু‌রি মে‌নে নিয়েছিল। সেখা‌নে দেশভা‌গের কথাই ছিল না। ‌ছিল ভারত যুক্তরা‌ষ্ট্রের কথা। কিন্তু কং‌গ্রেস তা মে‌নে নেয়‌নি। কারণ ক‌্যা‌বি‌নেট মিশ‌নে বলা হ‌য়ে‌ছিল, স্বাধীন ভার‌তের সকল শাসন ক্ষমতা থাক‌বে প্রদেশগু‌লির হা‌তে। কে‌ন্দ্রের হা‌তে থাক‌বে মাত্র তিন‌টি ক্ষমতা। প্রদেশগু‌লি চাইলে দশ বছর পর ভারত যুক্তরাজ‌্য থে‌কে আলাদা হ‌য়ে যে‌তে পার‌বে। কং‌গ্রেস এটা মান‌তে রা‌জি ছিল না। কং‌গ্রেস চাইছিল হিন্দু মুস‌লিম সংখ‌্যাগ‌রিষ্ঠ প্রতি‌টি প্রদে‌শে কে‌ন্দ্রের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ, যা‌তে কেন্দ্র ইচ্ছা কর‌লে প্রদেশগু‌লি‌কে অচল ক‌রে ‌দি‌য়ে তার পদানত রাখ‌তে পা‌রে। বি‌ভিন্নভা‌বে প্রদেশগু‌লি‌কে শোষণ করা হ‌লেও যা‌তে তারা স্বাধীন হ‌তে না পা‌রে।

 

স্বাধীন ভার‌তের সং‌বিধান রচনার সম‌য়ে তাই করা হ‌য়ে‌ছিল। সমস্ত ক্ষমতা থাক‌লো কে‌ন্দ্রের হা‌তে। ভার‌তের ছয়‌শোর মতন বি‌ভিন্ন স্বাধীন রাজ‌্যগু‌লো দখল ক‌রে‌ছিল ভারত। জিন্নাহ কিন্তু সবসময় চাইতেন, প্রদেশগু‌লির হা‌তে সকল ক্ষমতা থা‌কবে, কে‌ন্দ্রের হা‌তে নয়। সেটাই ছিল ১৯২৮ সা‌ল থে‌কে কং‌গ্রেসের স‌ঙ্গে জিন্নার ‌চিন্তার মূল মতপার্থক‌্য। ‌জিন্নাহ সম্প‌র্কে এসব ব‌্যাপা‌রে দলিলপত্র আছে। প‌রে কং‌গ্রেসের মওলানা আজাদ, গান্ধীবাদী শৈ‌লেশকুমার, বি‌জে‌পির য‌শোবন্ত সিংহ, সাম‌্যবাদী সুনী‌তিকুমার ঘোষ, আইনজীবী বিমলানন্দ শাসমলসহ অনেকে ব‌লে গে‌ছেন ভারত ভা‌গের দায় জিন্নাহর নয়। জিন্নাহ যে ভারত ভা‌গের জন‌্য দায়ী নন, তি‌নি যে সামান‌্য সাম্প্রদা‌য়িক ছি‌লেন না উল্লি‌খিত‌দের বইতে তা স্পষ্ট বলা আছে। ‌‌কং‌গ্রেসি বর্ণ‌হিন্দুদের একদল যেমন নানা মিথ‌্যাচার ক‌রে‌ছেন, ঠিক আর একদল বর্ণ‌হিন্দু বা সাধারণ হিন্দুরাই আবার ইতিহা‌সের সত্যি কথাগু‌লি উচ্চা‌রিত ক‌রে‌ছেন সাহ‌সের স‌ঙ্গে। তা‌দের কা‌ছে কৃতজ্ঞতা জানাই এই লেখায়।

 

বি‌দেশি‌দের লেখা ফ্রিডম অ‌্যাট মিডনাইট বইতে আছে, জিন্নাহ বাংলা আর পাঞ্জাব ভাগ না করার জন‌্য মাউন্টব‌্যা‌টেন‌কে আবেদন জানা‌চ্ছেন। মাউন্টব‌্যা‌টেন‌কে নিয়েই মূলত ফ্রিডম অ‌্যাট বইটা লেখা। সেখা‌নে লেখকদ্বয় জিন্নাহ সম্প‌র্কে নানা বি‌ষোদগার করার প‌রেও লি‌খে‌ছেন, জিন্নাহ মাউন্ট ব‌্যা‌টেন‌কে অনু‌রোধ জানান যা‌তে বাংলা আর পাঞ্জাব‌কে দ্বিখ‌ণ্ডিত না করা হয়। জিন্নাহ ব‌লেন, একজন বাঙালি প্রথ‌মে বাঙালি, তারপ‌রে সে হিন্দু বা মুসলমান। একজন পাঞ্জাবি প্রথ‌মে পাঞ্জাবি, তারপ‌রে সে হিন্দু বা মুসলমান। ফ্রিডম এ‌্যাট মিডনাইট বইয়ের লেখকদ্ব‌য় বইটা লে‌খেন জিন্নাহ মারা যাওয়ার বেশ প‌রে। তারা সেখা‌নে ব‌লেন, “এ সম‌য়ে জিন্নাহর চো‌খে পা‌নি চ‌লে আসে। ‌কিন্তু মাউনটব‌্যা‌টেন জিন্নাহর কথা রাখ‌লেন না। পাঞ্জাব আর বাংলা‌কে ভাগ করা হ‌লো কং‌গ্রেসের পরাম‌র্শে।”

 

ইতিহাস লেখার ক্ষে‌ত্রে ধানাই পানাই করা, নির‌পেক্ষ সাজার জন‌্য নরম সুর ব‌্যবহার করার সু‌যোগ নেই। ভার‌তে ভা‌গে‌ জিন্নাহর ভূ‌মিকা ততটাই, যতটা কং‌গ্রেস এবং হিন্দু মহাসভা তাঁর উপর চা‌পি‌য়ে দি‌য়ে‌ছিল। মুস‌লিম লী‌গের কা‌রো তথ‌্য দিলাম না তা প্রমা‌ণের জন‌্য। ক‌্যা‌বি‌নেট মিশন ভা‌লোভা‌বে বি‌শ্লেষণ কর‌লে গান্ধী, জওহরলাল নেহরু আর কং‌গ্রেসের ভারত ভা‌গের ভূ‌মিকা জ্বলজ্বল ক‌রে ফু‌টে উঠ‌বে। ইতিহাস‌কে চাইলে নি‌জের মতন নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।

 

লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক