মারুফ ইসলামের গদ্য ‘পশুপাখির ভাষা’

প্রকাশিত : আগস্ট ০৭, ২০২২

পড়াশোনা করে জানলাম, এক শালিক আরেক শালিকের ভাষা বোঝে। এক কুকুর আরেক কুকুরের ভাষা বোঝে। এক বিড়াল আরেক বিড়ালের ভাষা বোঝে। এক তিমি আরেক তিমির ভাষা বোঝে। এ বিষয়ে বিজ্ঞানীদের অনেক গবেষণা আছে। তারা গবেষণা করে দেখেছেন, নাচের মাধ্যমে মৌমাছিরা একে অন্যের সাথে কথা বলে। এক তিমি আরেক তিমির সঙ্গে যোগাযোগ করে বিশেষ একপ্রকার সঙ্গীতের মাধ্যমে। হাতিরা একে অন্যকে বিভিন্ন শব্দগত সংকেত দেয়।

কিন্তু স্বগোত্রের বাইরে গিয়ে এক প্রাণি কি আরেক প্রাণির ভাষা বোঝে? কুকুর কি বিড়ালের ভাষা বুঝতে পারে? তিমি কি বুঝতে পারে হাঙ্গরের ভাষা? শিয়াল কি খরগোশের ভাষা বুঝতে পারে? হাতি কি পিঁপড়ার কথা শুনতে পায়? বুলবুলি কি ময়নার কথা বুঝতে পারে? এ বিষয়ে কোনো লেখাপত্র খুঁজে পেলাম না।

গত বছর টাঙ্গাইলে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনা পত্রিকায় খবর হয়েছে। খবরটা পড়ে আমার মনে হলো, সম্ভবত স্বগোত্রের বাইরে গিয়েও এক প্রাণি আরেক প্রাণির ভাষা বোঝে।

ঘটনা ঘটেছে টাঙ্গাইলের সখীপুরে। এক কুকুরের বাচ্চাগুলোকে খেয়ে ফেলেছে শিয়াল। আর এক বিড়াল দুটো বাচ্চা জন্ম দিয়ে নিজেই মরে গেছে। ফলে বিড়ালছানা দুটো পড়েছে বিপদে। একটা তো না খেতে পেয়ে মরেই গেছে। আরেকটার অবস্থাও মর মর। এ অবস্থায় এগিয়ে এসেছে বাচ্চাহারা কুকুরটি। সে নিজের দুধ পান করাচ্ছে বিড়ালছানাকে। সে এক অদ্ভুত সৃন্দর দৃশ্য!

কী ভাষায় কথা বলেছিল ওরা নিজেদের মধ্যে? কল্পনায় দেখার চেষ্টা করি দৃশ্যটা:
সন্তান হারিয়ে বিষণ্ন মনে এক কদম গাছের নিচে বসে আছে মা কুকুরটি। তার চোখে ভিজে আছে কান্নায়। ঠিক তখন এক দুর্বল, অশক্ত ছাইরঙা বিড়ালছানা কোনোমতে হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় কুকুরটির। তার চোখেও জল।

ঘেউ ঘেউ! (কি রে, কী হয়েছে তোর?)। কুকুরটি শান্ত গলায় বলল।
মিউ মিউ! (আমার মা মরে গেছে। কয়েকদিন ধরে কিছুই খাইনি আমি। তুমি কি আমাকে একটু দুধ খেতে দেবে?)

ঘেউউউউউ….। হুহু করে কেঁদে উঠল কুকুরটি। নিজের সন্তানগুলোর কথা মনে পড়ল। তার চোখে অশ্রুর বান নামলো। আয়, বুকে আয়। (ঘেউউউ)!

হয়তো এভাবে তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলেনি। হয়তো অন্যভাবে বলেছে। কীভাবে বলেছে, আমি জানি না। শুধু জানি, তাদের মধ্যে কোনো না কোনোভাবে ভাষার আদান-প্রদান হয়েছে। না হলে কুকুরটা বুঝল কী করে যে, বিড়ালশিশুটির দুধ প্রয়োজন? বিড়ালছানাটিই বা বুঝল কী করে, কুকুরটির স্তনে দুধ আছে?

এ বড় জটিল পৃথিবী। কত কিছুই আমাদের অজানা! এক প্রাণি আরেক প্রাণির ভাষা বোঝে, অথচ আমরা মানুষ, এক মানুষ আরেক মানুষের ভাষা বুঝি না। একজন হয়তো হঠাৎ হাত বাড়িয়ে বলেছিল, হাতটা একটু ধরবে? আমরা বুঝিনি এই হাত ধরা বলতে সে কী বুঝিয়েছে। কেউ একজন হয়তো হাত ধরে হাঁটতে হাঁটেতে পথের শেষ প্রান্তে এসে হঠাৎ হাত ছেড়ে দিয়ে পেছন ফিরে জলভরা চোখে তাকিয়েছিল। আমরা তার জলের ভাষা বুঝিনি।

ছেড়ে দেওয়া হাতের কেউ একজন হয়তো বছর কুড়ি পরে হঠাৎ ইনবক্সে চিঠি লিখেছে এক লাইনের, ‘কেমন আছ?’ আমরা তার এক লাইনের মানে বুঝিনি।

লেখক: কথাসাহিত্যিক