মাহবুব মোর্শেদের গদ্য ‘দৈনিক পত্রিকা নিয়ে কথকতা’

প্রকাশিত : আগস্ট ২২, ২০২২

আমরা যখন প্রথম সংবাদপত্রের কাজে যোগ দেই তখন যে পত্রিকায় কাজ করতাম সেই পত্রিকাটি বাসায় বাধ্যতামূলকভাবে রাখতে হতো। মাস শেষে হকার পত্রিকার যে বিল দিয়ে যেত সেটি অফিসে জমা দিলে  টাকাটা দিয়ে দেওয়া হতো। পরে পদোন্নতি হলে পত্রিকার সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। একটি থেকে তিনটি, তিনটি থেকে ছয়টি, এমনকি আটটি পত্রিকাও দেওয়া হতো। পরে অবশ্য পত্রিকাগুলো ব্যয় সংকোচনের জন্য সাংবাদিকদের কম পত্রিকা রাখতে উৎসাহ দিতে‌ শুরু করে।

তবে, দীর্ঘদিন ধরে আমি বাসায় সাতটি পত্রিকা রাখি। সকালবেলা প্রথম কাজ হল পত্রিকাগুলো উল্টে দেখা। এটা দৈনন্দিন অভ্যাস হয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হলো, এতগুলো পত্রিকা রাখলেও খুব কম ক্ষেত্রে কোন সংবাদ বা কলাম বা ফিচার আমি পত্রিকা থেকে পড়ি। আমি মূলত দেখি ট্রিটমেন্ট। কোন পত্রিকা কোন নিউজ পিক করলো। কারা কোন নিউজ ডাম্প করলো। কোন নিউজ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করলো। কোন নিউজটি প্রথম পাতায় দেওয়ার দরকার থাকলেও ভেতরের পাতায় দিল। কোন ছবিটি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করলো। কোনটি একদমই ছাপলো না।

এগুলো বিশেষভাবে লক্ষ্য করার বিষয়। কোনো একটি পত্রিকা কোনো বিশেষ নিউজ একেবারেই প্রকাশ না করলে সেটি তারা ইচ্ছাকৃতভাবে করেছে নাকি মিস করে গেছে সেটি জানার চেষ্টা করা খুব জরুরি কাজ। কোনো পত্রিকায় কোনো রিপোর্টার ভালো রিপোর্ট করতে থাকলে সেটিও ফলো করতে হয়। নতুন কোনো কলামিস্ট হয়তো নতুন অ্যাপ্রচে লিখতে শুরু করেছেন। কোনো পত্রিকার বিনোদন পাতা খুব ভালো হচ্ছে। বিজনেস পেজে এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ ছাপা হচ্ছে। এগুলো খেয়াল করা আমাদের নৈমিত্তিক কাজ। ফলে দেখা যাচ্ছে, পড়ার বাইরে পত্রিকায় আরো অনেক বিষয় থাকে যেগুলো আমরা পাতা উল্টে বোঝার চেষ্টা করি।

আরেকটি জরুরি বিষয় সাংবাদিকরা অনেকেই খেয়াল করেন। কোন পত্রিকা কেমন বিজ্ঞাপন পেল, কোন কোন কোম্পানির বিজ্ঞাপন পেল। বিজ্ঞাপন দাতারা কাদের গুরুত্ব দিচ্ছে। সাংবাদিকদের অনেকেই একই কাজ করেন। সাধারণত সাংবাদিকরা পত্রিকা পড়েন না। সারাদিন সংবাদের মধ্যে থাকতে থাকতে তারা বিষয়গুলো সম্পর্কে আগেই জেনে যান। পরদিন সকালবেলা পত্রিকা থেকে সংবাদ জানার প্রয়োজন তাদের হয় না। অবশ্য এক্সক্লুসিভ কোনো নিউজ কেউ ছাপলে সেটি পড়তেই হয়। আমিও পড়ি।

পুরনো দিনের সাংবাদিকদের দেখতাম মোটামুটি সকালবেলাতেই গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ ও লেখা তারা পড়ে ফেলতেন। কোনো পত্রিকায় ভুল কোনো কিছু ছাপা হলে তা নিয়ে দিনভর হাস্যরস করতেন।

আগে আমিও পত্রিকা পড়ার চেষ্টা করতাম। সকালবেলায় কিছু নিউজ মাথায় নেয়ার অভ্যাস তৈরি করেছিলাম। বহুদিন সেটা করা হয় না। ইদানীং আরেকটা বদ অভ্যাস হয়েছে। পত্রিকায় দেখা এক্সক্লুসিভ নিউজটি পত্রিকা থেকে না পড়ে অনলাইন ভার্সনে খুঁজে নিয়ে পড়ি। কখনো কখনো এমনও হয়, পড়বো বলে ভেবে রেখেও শেষ পর্যন্ত  পড়া হয় না। কোনো লেখা পত্রিকায় দেখে পড়ার কথা ভেবেছি, পড়া হয়নি, পরে ফেসবুকে কেউ শেয়ার দিল তখন আবার মনে পড়লো এই লেখাটি পড়ার কথা ভেবেছিলাম, তখন হয়তো লিংকে ক্লিক করে পড়ে ফেলি। তার মানে দেখা যাচ্ছে, কোনো নিউজ দুই বা তিনবার সামনে এলে তা পড়া হয়।

আমার এক বন্ধু বাসায় কোনো দৈনিক পত্রিকা রাখেন না। কিন্তু তিনি দিনের শুরুতেই বারোটি পত্রিকার ই-পেপার নিয়ম করে পড়েন। তিনি আমাকেও পরামর্শ দিয়েছেন, ছাপা পত্রিকা ঘরে না রেখে ই-পেপার পড়তে। আমি বলেছি, ছাপা পত্রিকা দেখা আমার পেশার অংশ।
কিভাবে?
কে কোন নিউজপ্রিন্টে ছাপছে সেটাও তো দেখার বিষয়। রাশিয়ান কাগজের ছাপা একরকম, দেশি কাগজের ছাপা একরকম, সুইডিশ কাগজের ছাপা একরকম। কারো হয়তো ছাপা খারাপ হচ্ছে, ছবি মার খেয়ে যাচ্ছে, পরের পৃষ্ঠার ছাপ আগের পৃষ্ঠায় চলে আসছে। এগুলো দেখাও আমাদের দায়িত্ব। আমি বললাম, আমি না হয় পেশাগত কারণে এতগুলো পত্রিকা পড়ি কিন্তু আপনি কী মনে করে সকালবেলা কষ্ট করে এতগুলো ই-পেপার পড়েন?

বন্ধু বললেন, সারাদিন আমরা ফেসবুক থেকে নিউজ পাই। অনলাইন পোর্টালেও দু’চারবার চোখ বোলাই। আলোচিত বা ভাইরাল ইসুগুলো বাদ যায় না। ইদানীং ভিডিও থেকেও অনেক কিছু জানা যায়। ব্যস্ততার কারণে অবশ্য টিভি দেখা হয় না। সে অভাবটা পূরণ করে ইউটিউব ও ফেসবুকের ভিডিও।

কিন্তু একটা বিষয় কি জানেন? অনলাইন পোর্টাল ফেসবুক ইউটিউব এগুলো থেকে আপনি টোটাল ধারণাটা করতে পারবেন না। সামআপ করতে পারবেন না। জিস্টটা বোঝার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হবেন। কোনটা বড় ঘটনা বা কোনটা বড় ঘটনা হতে পারত সে বিষয়ে ধারণা পেতে হলে আপনাকে দৈনিক পত্রিকা ওল্টাতে হবে। আপনি আগের দিনের গুরুত্বপূর্ণ নিউজগুলো মাথায় নিয়ে দৈনিক পত্রিকা ওল্টান আপনার কাছে অনেক কিছু ক্লিয়ার হয়ে যাবে। আমার কাছে মনে হয়, বেশিরভাগ অনলাইন পোর্টাল, এমন কি পত্রিকার অনলাইন ভার্সন ফোকাস করতে পারে না বা বুঝতে পারে না কোন নিউজটি বড়। মূল কথা হলো, ট্রিটমেন্ট ব্যাপারটি অনলাইনে পাওয়া যায় না।

আরেকটা ব্যাপার আছে। দৈনিক পত্রিকাগুলো একটা কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। এখানে নিয়ম করে প্রথম পাতায় জাতীয় সংবাদ, অর্থনীতি ও বাণিজ্যের সংবাদ, খেলা, বিনোদন, টেকনোলজি, স্বাস্থ্য, ঢাকার বাইরের সংবাদ ইত্যাদি ছাপা হয়। পাতা বরাদ্দ থাকার কারণে কোনো বিষয়ে কম ছাপার সুযোগ নেই। গুরুত্বপূর্ণ ওইসব বিষয়ে আপনি প্রয়োজনীয় নিউজগুলো পেয়ে যাবেন। একটি পত্রিকাকে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ দিয়ে প্রথম পাতা ও শেষ পাতা ভরতেই হবে। ফলে নিউজের অনুসন্ধানে পিছিয়ে পড়লে তাদের পাতা ভরবে না। অগুরুত্বপূর্ণ নিউজ প্রথম পাতা শেষ পাতায় ছাপলে সহকর্মীরা বলবে এদের নিউজের ঘাটতি ছিল।

আরেকটি বিষয় আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। বন্ধু বললো। সেটি হলো নীতি নির্ধারকরা কী মনে করছেন, তারা কীভাবে ভাবছেন, কোন বিষয়টি সামনে আসুক বা কোন বিষয়টি পিছনে পড়ুক সেটা কেন চাইছেন এগুলো পত্রিকা পড়লে বোঝা যায়। ফলে ই-পেপারগুলো আমাকে অনেক সহায়তা করে।

আমি তাকে বললাম, কিন্তু ই-পেপার থেকে পত্রিকা পড়া তো খুব কঠিন। অনেক পত্রিকার ইভার্সন পাঠক বান্ধব নয়। আবার কোনোটা কিনতেও হয়।

বন্ধু বললো, কিনলেও লস নেই। কিন্তু বেশিরভাগ ই-পত্রিকা আমি ফ্রি পাচ্ছি।  সাধারণত ই-পেপার থেকে আমি সংবাদ পড়ি না। আমি খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করি, পত্রিকাগুলো কোন নিউজকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কেন দিচ্ছে। শাসকশ্রেণি আসলে কী চায়। আপনি যদি বিগ বাজেটের পত্রিকাগুলো নিয়মিত না দেখেন তবে বুঝতে পারবেন না কোটি কোটি টাকা খরচ করে শাসকগোষ্ঠী আসলে কী প্রচার করতে চাইছে। আপনাকে মনে রাখতে হবে, এগুলোর সাবস্ক্রাইবারও তারাই। ফলে, আপনি যখন প্রতিদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে চাইবেন তখন আপনাকে পত্রিকা পড়তেই হবে।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক