মিতা নিয়োগীর গল্প ‘মন খারাপের মেঘ’

প্রকাশিত : জুন ২৩, ২০২৫

ক’দিন ধরেই মনের ঘরে মেঘ জমেছে তিথির। সেই আঠেরো বছর বয়েসে বিয়ে হয়ে এসেছিল। অনেক আদরে বেড়ে ওঠা মেয়েটি এই সংসারে এসে হিমশিম খেত। শাশুড়ি মা অবশ্য তখন বেঁচে ছিলেন। দুই ভাসুর তাদের পরিবার নিয়ে থাকতেন নিজেদের কর্মস্থলে। ননদেরও বিয়ে হয়ে গেছিল।

পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই বিয়ে হয়। এজন্য ঘরকন্নার কাজ কর্মটুকুও তার সেভাবে শেখা হয়নি তখন। কখনো উনুন ধরাতে গিয়ে নাকাল, কখনো ভাতের মাড় গালতে গিয়ে হাত পোড়ানো, কখনো রুটি বেলতে দিয়ে বিভিন্ন দেশের মানচিত্র বানিয়ে হাসির খোরাক হওয়া বা নিত্য নৈমিত্তিক কাজে কিছুনা কিছু ভূল ত্রুটিতে বেহাল অবস্থা তার।

কতদিন সবজি কুটতে গিয়ে হাত কেটেছে, তার হিসাব নেই। সেই কাটার যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে, কিছুই পারে না গোছের মন্তব্য শোনার হাত থেকে বাঁচতে লুকোনোর চেষ্টা করতে হয়েছে বারবার। যদিও এসব মেয়েলি কাজ মেয়েদের সহজাত, তাই শিখে নিয়েছিল অচিরেই। শাশুড়ি মায়ের তাতে অনেক ভূমিকা ছিল।

বছর ঘুরতেই সন্তান আসে তার কোলে। কখন বাচ্চার দায়িত্বর সাথে সংসার সামলে কবে যে পুরো গিন্নি হয়ে উঠেছিল, নিজেই জানে না।

উপহার পেতে ভালো লাগে না, এমন মানুষ হয়তো হাতেগোনা। বিশেষ বিশেষ দিনে বিশেষ মানুষের কাছ থেকে উপহার পেতে বেশি আনন্দ হয়, সে যেকোনো কিছু হোক না কেন! আর না পেলে অভিমান, চোখে জল এসব তো স্বাভাবিক। অশোক বাবু মানে তিথির বর এসব বিষয়ে বরাবর উদাসীন।

না-না, তিনি খারাপ মানুষ তা নয়, তবু একটু অন্যরকম। বিবাহবার্ষিকী ও জন্মদিনের মতো বিশেষ দিনগুলিতে তিথিকে কোনো উপহার দেওয়া বা মুখে শুভেচ্ছা জানানো তার ধাতে নেই। তবে কেউ বলতে পারবে না, তিনি তিথির সাথে দুর্ব্যবহার করেন বা ভালো বাসেন না। তবে কোনোকিছুর বহিঃপ্রকাশ নেই।

শাশুড়ি মা বেঁচে থাকতে তিথির জন্মদিনে পায়েস করতেন। ছেলেকে বলতেন, আজ বৌমার জন্য একটা শাড়ি তো আনতে পারতিস! ছেলে তখন লজ্জা লজ্জা মুখে বলতো ওসব বিবাহবার্ষিকী জন্মদিন আলাদা করে কিছু সেলিব্রেসন না আমার ঠিক মনে থাকে না। সবাই যখন বলতো, বউকে কি দিলি, তখন তিনি হেসে হেসে বলতেন, কী আর দেব, আমার সব কিছুই তো ওর!

সবাই বলতো, ওসব মিষ্টি কথায় চিড়ে ভিজবে না, একটা শাড়ি বা ওর পছন্দের কোনো জিনিস তো দিতে পারতিস। তখন তিনি বলতেন, তিথিকে কি নেবে বলো, চলো একটা শাড়ি কিনে আনি, নইলে টাকা নাও, তোমার পছন্দ মতো যা খুশি কিনে নাও!

একরাশ অভিমান নিয়ে তিথি বলতো, না থাক, লাগবে না কিছু। আর শাড়ি নিয়ে কি করবো, পূজোর শাড়িতো সব পরা হয়নি, কোথায় যাব নতুন নতুন শাড়ি পরে! দরকার নেই ওসবের।

উনিও হেসে হেসে বলতেন, হেহেহে বললাম না ওর অতো শাড়ি। আর নিয়ে কি করবে শুধু শুধু। বেকার মিস ইউস ওসব। আমার বউ খুব সমঝদার, যখন যা লাগবে ঠিক চেয়ে নেবে।

আর ঐ চাওয়াটাই তিথির হতো না। চেয়ে কিছু নিতে ওর ভালো লাগতো না্ আর নিজের লোকদের কাছ থেকে কি কিছু গিফ্ট চেয়ে নিতে হয়? কই বিয়ের আগে তো বাবা মা, দাদার কাছে বিশেষ দিনে কিছু চাইতে হতো না। তারা তাদের সাধ্যমত যা পারতো দিতো, আর সে খুশিতে বন্ধুদের দেখিয়ে বেড়াতো।

ছেলে মেয়ে যখন বড় হোলো, তখন তারা মনে করিয়ে দিতো বাবাকে, আজ তোমাদের বিবাহ বার্ষিকী, আজ জন্মদিন, ট্রিট দাও, তখন সেই উপলক্ষে স্পেশাল কিছু বানাতে হতো, কয়েকবার ওদের জোরাজুরিতে টাকা দিয়েছে অশোক আর সেই টাকা দিয়ে নিজের পছন্দের শাড়ি কিনেছে তিথি। তবু অশোক কোনোদিন কিছু কিনে এনে বলেনি, এই নাও, এটা আমি তোমার জন্য পছন্দ করে কিনে এনেছি!

ছেলে মেয়ের মন রাখতে তিথি বাধ্য হয়েই কিনতো, ঐ কেনার মধ্যে কোনো আনন্দ ছিল না তার। তার মনে হতো গিফ্ট সবসময় টাকা বা দাম দিয়ে বিচার করা যায় না। গিফ্ট সবসময় অমূল্য হয়। অনেক বার বলেছে এসব কথায় কথায়।

তিথি মনে অভিমান গুলো যত্ন করে পুষে রাখে,মানে অভিমানীনির অভিমান যেন মন থেকে বেরোতেই চায় না। বিয়ের বেশ কয়েক বছর পর সে যখন একটু স্বাবলম্বী হয়েছে, সংসার থেকে টাকা বাঁচিয়ে অশোককে জন্মদিনে, বিবাহ বার্ষিকীতে গিফ্ট কিনে দিয়েছে ! গিফ্ট পেতে বা দিতে ও সবসময় খুব খুশি হয়, আর আশাও করে তাকে সেই মানুষটা কিছু একটা নিজে পছন্দ করে কিনে আনুক, সে একটা পেন্ হোকনা কেন!

দীর্ঘদিনের আক্ষেপটা শুধু আক্ষেপ হয়েই থেকে গেছিল তার মনে। পরে তার আর কোনো কিছু আগের মতো করে খারাপ বা ভালো লাগতো না। সয়ে গেছিলো একপ্রকার। তবু বিবাহবার্ষিক এলেই মনে হতো ধুসসস্ এসব দিন না এলেই ভালো হয়, কোনো আনন্দ তো হয় না ,শুধু শুধু মন খারাপ বাড়ে।

বিবাহ বার্ষিকীটা আসে বলেই তিথির নিজের জন্মদিনের কথা মনে পড়ে। কারণ বিবাহ বার্ষিকীর তিনদিন পর তার জন্মদিন। ছেলেমেয়ে সব বাইরে থাকে, সে সময় তারা থাকলে মা বাবাকে গিফ্ট দেয়, কেক কেটে উইশ করে। ওটাও খুব কমই হয় ,কারণ যে যার জগত নিয়ে ব্যাস্ত।

এখন ইন্টারনেটের দৌলতে এই বিশেষ দিনগুলিতে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছার ঝড় বয়ে যায়, তবু তিথির অভিমান তাকে কষ্ট দেয়, পুরোনো দিনের মতো।সে তবু নীরব থাকে, সে চাইলেই পাবে জানে কিন্তু সে চাইতে পারে না, তার অভিমান গুলো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।

আজ তিথির ৩০তম বিবাহবার্ষিকী। সকাল থেকে ছেলেমেয়ে, আত্মীয় স্বজন ফোনে ও ম্যাসেজ করে অভিনন্দন জানায় তাদের। সকালেই দুটো নতুন সার্ট অশোকের হাতে তুলে দিয়ে তিথি বলে আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী, আজ একটা তুমি পরো। অশোকও খুশি হয়ে বলে, বাহ্ খুব সুন্দর, গরমে এই সার্টগুলো পরে খুব আরাম পাওয়া যাবে, সত্যি তোমার মনেও থাকে এসব, আমার কোনো দিনই এসব মনেই থাকে না।

শোনো না, মেয়ে ফোনে বলছিল তোমাকে শাডড়ি কিনে দিতে। সামনেই তো আবার তোমার জন্মদিনও আসছে।
তিথি গম্ভীরভাবে বলে, না না ওসব কিছু লাগবে না। শাড়ি, জামাকাপড়ের কোনো অভাব নেই, লাগবে না কিছু!

আরপাঁচটা দিনের মতোই সকালটা শুরু হলো। যথারীতি মন খারাপ নিয়েই মন্দিরে পূজো দিয়ে এলো। রান্নাবান্না সেরে ফেসবুকে নিজেদের পুরোনো ছবিগুলো আপলোড করলো। শুভেচ্ছা কুড়োলো কিছু।

বিকালের দিকে অশোক তিথিকে কাছে ডেকে বললো, তোমার অনেক দিনের ইচ্ছে দেওঘর যাওয়ার, তোমাকে আমি কখনো এই বিশেষ দিনে কোনো উপহার দিইনি। তার ও দুটো কারণ আছে, একে তো আমি মনে রাখতে পারি না, দুই. আমি মনে করি এই দিনে আলাদা করে ভালোবাসা দেখানোর জন্য কোনো উপহার এনে দেওয়া এসবটা লোক দেখানো ব্যাপারটা আমি ঠিক পারি না। আমি জানি, এই নিয়ে তোমার খুব রাগ হয়।

সামনে তোমার জন্মদিন আছে ,তাই ভাবলাম তোমাকে একটা সারপ্রাইজ গিফ্ট দি, চলে কটা দিন দেওঘর থেকে ঘুরে আসি। ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে নাও, দুদিন বাদেই আমাদের টিকিট!

অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তিথি তার দিকে, তিরিশ বছর বাদে নিজে থেকে কিছু নিয়ে এসেছে তিথির জন্য। আনন্দ, খুব আনন্দ হলেও কোথাও যেন পুরোনো মন খারাপগুলো বেশি ভারি হওয়ায় সবকিছু বড় ফিকে লাগে।

যে তিথি একটা পেন্ বা একটা কার্ডে খুশি হতো খুব, আজ এতগুলো বছর পেরিয়ে এসে ঘুরতে যাওয়ার টিকিট পেয়েও তেমন খুশি হতে পারো না।
কী যে চায় সে, তা নিজেই বোঝে না!