মুজাহিদ আব্দুল্লাহর ‘নয়া দামান’ নিয়া আলাপ

তুহিন খান

প্রকাশিত : মে ০৮, ২০২১

`নয়া দামান` ভাইরাল হইছে। এই প্রসঙ্গে দুই একটা কথা কইতে চাই। আমেরিকাপ্রবাসী সিলেটি শিল্পী মুজারে (মুজাহিদ আব্দুল্লাহ) নিয়া আগেও লেখছি। তারে ফলো করতেছি এরাউন্ড টু-থ্রি ইয়ার্স। ইদানীং বেশ কয়েকজন প্রবাসী বাঙালি শিল্পী নতুন ধারার বাঙলা গান তৈয়ার করতেছেন। এদের মধ্যে অনেকেই আবার দেখলাম সিলেটের, যেমন: মুজা ও মাস্টার ডি। মাস্টার ডি`র `তুমি যাইও না` বা মুজার `বন্ধুরে` বিদেশে এবং দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাইছে। সাধারণত ওয়েস্টার্ন ধারার বাঙলা গান নিয়া একটা রুচির সমস্যা কাজ করে বাঙালি শ্রোতাদের মধ্যে; মুজা আর মাস্টার ডি সেই সমস্যাটা অনেকাংশেই যে দূর করতে পারছেন, তার প্রমান পাবেন তাদের গানগুলার ইউটিউব ভিডিওর কমেন্ট বক্সে।

মূলধারার বাঙলা গানের মিউজিক ও টেস্টে একটা চেঞ্জ আসছে গেল কয়েকবছরে। হিপহপ, ফোক আর ওয়েস্টার্নের একটা মিক্সার যেসব গানে আছে, সেগুলাই মূলত ভাইরাল হইতেছে গত কয়েক বছর যাবত। কথা ও সুরের ক্ষেত্রে, মিউজিকের ক্ষেত্রে, এইসব গান `মূলধারা`র বাঙলা গান থিকা সিগনিফিকেন্টলি আলাদা। আর এসব গান ভাইরাল হওয়া ও ট্রেন্ডিংয়ে আসার পিছনে সবচাইতে বড় অবদান রাখতেছে টিকটক। টিকটক কীভাবে বাঙলা গানের রিসেন্ট ট্রেন্ডগুলারে ইনফ্লুয়েন্স করতেছে, তা এ আর জাহাঙ্গিরের ভাষায় পড়ি:

‘আরেকটা জিনিস দেখবেন, দেশি মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির সব থেকে বড় সাপোর্ট আসবে এই টিকটক থেকে। টিকটকের ইকোসিস্টেমে কনটেন্ট বানাইতে অনেক পপ মিউজিক লাগে। পপ মিউজিকের ছোট একটা পার্ট ভাইরাল হয়ে যায়। তো নেক্সট হিডেন জেম বা পপ মিউজিক ট্রেন্ডও আসবে টিকটক থেকে।

রিয়েলিটিটা হলো, মিডিয়াম হিসাবে টিকটক কনটেন্ট মেকার ও কনজিউমার দুই সাইডেই এক্সেসিবল। কনটেন্ট মেকার সাইডে অন্যদের সাথে ইন্টারএক্ট করার এবিলিটি অনেক ইন্টেরেস্টিং। ইজিলি মিলিয়ন ভিউয়ারকে রিচ করা যায়। কনজিউমার এন্ডে এটা খুব শর্ট উইন্ডোতে মানুষকে বিনোদন দিতে পারে। কোন রকম মেন্টাল ইনভেস্টমেন্ট ছাড়াই ইচ্ছামত বিনোদন নেয়া যায়; যতক্ষণ ইচ্ছা স্লট মেশিনের মত ঘুরাতে থাকবে আর নতুন কনটেন্ট দেখতে থাকবে। একদম আর্মচেয়ার বিনোদন যেটা হাইপার কানেক্টেড সোশ্যাল ওয়ার্ল্ডে সব থেকে পপুলার।’

`নয়া দামান` উপরের এই অ্যাজাম্পশনের একদম টেক্সটবুক এক্সাম্পল। `নয়া দামান` ভাইরাল হওয়ার পেছনে তো বটেই, এমনকি মুজার যে রিমেকের কারণে গানটা নতুন কইরা আলাপে আসল, সেই রিমেকের পেছনেও টিকটকের সরাসরি ভূমিকা আছে।

মুজা যখন বিয়াবাড়িতে জামাইবরণ বিষয়ক গান খুঁজতে লাগলেন, তখন এই গান তার মাথায় আসলো। গানটা গাওয়ার জন্য মুজা খুঁজতেছিলেন একটা পিওর ভার্নাকুলার সিলেটি ভয়েস। আর এইরকম ভয়েস খুঁইজা পাওয়ার জন্য মুজা হেল্প নিলেন টিকটকের। তসিবা বেগম নামে যিনি মুজার সুরে গানটায় ভয়েস দিছেন, উনি প্রথম টিকটকেই এই গানের কয়েকটা লাইন গাইয়া আপলোড দিছিলেন। সেখান থেকেই মুজা তারে পিক করেন, এবং ইনস্টাগ্রামে নক দিয়া গানটা গাওয়ার জন্য তারে এসাইন করেন।

গানটা ভাইরাল হওয়ার পিছনেও টিকটকের অবদান খুবই মৌলিক। মুজা এবং তসিবা বেগম— কেউই বাঙলাদেশের কথিত `মূলধারা`র শিল্পী না। তবে, গান রিলিজের ক্ষেত্রে যেহেতু এখন আর ক্যাসেট বা সিডি লাগে না, ফলে বিভিন্ন সোশাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে সহজেই কথিত মূলধারার বাইরেও অনেক গান রিলিজ হয়, এবং জনপ্রিয়তা পায়। তসিবা সিলেট থেকেই গানটা রেকর্ড কইরা আমেরিকায় মুজারে পাঠান, এবং মুজা সেখান থেকেই ইডিটিং শেষে গানটা রিলিজ করেন।

স্বাভাবিকভাবেই ইউটিউবে গানটা রিলিজ হওয়ার পর প্রথম আউটবার্স্টটা হয় টিকটকে, যেহেতু তসিবা একজন পপুলার টিকটকার। উনি টিকটকে এই গানের একটা ক্লিপ শেয়ার করার পরে, ৩-৪ দিনের মধ্যেই এই গান নিয়া প্রায় ৬০-৭০ হাজার কন্টেন্ট তৈয়ার হয় টিকটকে, হুইচ ইজ ওভারহোয়েলমিং অ্যাকচুয়ালি। ইউটিউবে এখন `নয়া দামান` লেইখা সার্চ দিলে একদম শুরুতেই যে ভিডিওটা আসে, ওইটা খুলনার মেডিকেলের ছাত্রী সূচনার গায়ে হলুদের ভিডিও। নিজের গায়ে হলুদে এই গানে নাচছিলেন সূচনা। এরপরে দীর্ঘদিন টিকটক কাঁপায় এই গান। দেশি তো বটেই, বিদেশিরাও এই গানে টিকটক করেন; এমনকি বাঙলাদেশের বিখ্যাত অভিনেত্রী মৌসুমিও মুজা ও তসিবার এই গানে টিকটক ভিডিও বানান। পপুলার টিকটকারদের প্রায় সবাই এই গানে ভিডিও বানাইছেন।

এর মধ্যে অন্যান্য সোশাল প্লাটফর্মেও গানটা জনপ্রিয় হয়। আমাদের আল আমিন ভাইয়ের আকদের ভিডিওর সাথে এই গান লাগাইয়া ফেসবুকে আপ দেন আরেফিন মোহাম্মদ। এইরকম আরো অনেকেই এই গানটারে বিভিন্ন ভিডিওর সাথে ইউজ করতে থাকেন। সর্বশেষ ঢাকা মেডিকেলের তিন ডাক্তারের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পরেই মূলত গানটা লইয়া মিডিয়ায় আলাপ শুরু হয়।

তো, `নয়া দামান` বা `টাকলা সং`— রিসেন্টলি যে বাঙলা গানগুলা ট্রেন্ডিংয়ে আসতেছে, দেশ পার হয়ে বিদেশেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাইতেছে (টাকলা সং বাঙলাদেশের চাইতেও বেশি ভাইরাল হইছে কোলকাতায়), এবং দেশের মিউজিক ট্রেন্ড ও রুচিরে শেপ দিতেছে, সেগুলা মূলত টিকটকে ভাইরাল হইতেছে আগে। রুচিবানদের জন্য, শুদ্ধতম কবি ও শিল্পীদের জন্য দুঃখজনক ব্যাপার হইলেও, আমি এতে মোটেই দুঃখিত না, কিছুটা আনন্দিতই বরং।