শামীমা জামানের গদ্য ‘আলহামদুলিল্লাহ’

প্রকাশিত : জুলাই ২০, ২০২২

একটি ফোনকল।
আমার ব্লাড ক্যান্সারটিকে বলে নন হচকিন্স লিম্ফোমা। যখন ধরা পড়ল তখন স্টেজ ফোর। অনকোলজিস্ট প্রথম সাক্ষাতে বলেছিলেন, ৪০ পার্সেন্ট মানুষ ভালো হয়। আশা করি আপনি তার মধ্যে থাকবেন।

তার সেই কথার পরে আমি আর কোনো ডাক্তারকে প্রশ্ন করিনি আমি ভালো হবো কিনা। যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলাম। যদিও আপনজনেরা বারবার  জানতে চাইতো, ডাক্তার কি বলে।

আমার বড় ভাই একদিন বললেন, একটিবারের জন্যও নেগেটিভ চিন্তা করবা না। তুমি যেভাবে চিন্তা করবে আল্লাহ সেভাবেই তোমার ব্যাপারে ফয়সালা করবেন। আমি কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করেছিলাম।

যখনই মৃত্যুচিন্তা ভিড় করতো মনে সঙ্গে সঙ্গেই সে চিন্তাকে দূর করে দিয়ে ভালো চিন্তা করতাম। অলমাইটির প্রতি পুর্ণ আস্থা রেখে যা করণীয় সেদিকে মন দিতাম। কাছের, দূরের, বন্ধু-শত্রু সকলে আমার জন্য দুশ্চিন্তা করেছে আতংকিত চিত্তে। তাছাড়া সকলে আরেকটি কাজ করেছে, দোয়া। এত এত মানুষের দোয়া পেয়েছি, আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

ভয় পাইনি। সেটা আমার সাহস নয়। আসলে ভয় পেতে ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। তারচেয়ে সহজ ছিল সৃষ্টিকর্তাকে ডাকা। দুলাভাই বললেন, সূরা ইনশিরাহ আর সুরা তাওবার শেষ দুই আয়াত পড়বি। একদম সুস্থ হয়ে যাবি।

বিশ্বাস করলাম। বিশ্বাস করতে তো ডলার লাগে না, গায়ের কষ্টও লাগে না। শুধু স্মার্টনেস কিছুটা কমে যায়। সেটা মৃত্যু থেকে অনেক তুচ্ছ। বেঁচে থাকলে তবে তো সবকিছু। পড়তে পারতাম না। ইউটিউব ছেড়ে ওমর হিশামের মেলোডিয়াস কন্ঠে শুনতাম। সব দুঃখকষ্ট উড়ে কী যে এক অপার্থিব শান্তি পেতাম!

ইহুদি, খ্রিস্টান নার্সগুলো এসে শুনে বলতো, নাইস সং। একজন বললো, বিপদের দিনে বেশি বেশি দোয়া ইউনূস, দরুদ আর আস্তাগফিরুল্লাহ পড়তে হয়। বিপদ দূর হয়। মিস্টার বাংলাদেশ সাইদুর রব ভাইয়ের স্ত্রী প্রিয় ভাবি একটা তসবিহ দিয়ে এসেছিলেন। সেটা দিয়ে এই তিন জিকিরও করতে থাকলাম। মুখে জিকির চলা অব্ধি এক চিন্তাহীন, আনন্দ উদ্যম অনুভব হতো। জিকির বন্ধ করলে চিন্তারা পায়ে পায়ে আসার চেষ্টা করতো। তবে এসব ছিল তৃতীয় কেমো পরবর্তী সময়ের কথা।

কেমোর আগে বা দ্বিতীয় কেমো অব্দি এগ্রেসিভ সময়গুলোতে যে যতই দোয়ার কথা বলুক, কিছুই করা যায়নি। নিজের অজান্তে প্রচণ্ড ব্যথায় জিহবা শুধু ভাঙা রেকর্ডের মতো ‘আল্লাহ আল্লাহ’ ডেকে গেছে। সে কেন ডাকছে, আমিও জানি না। এক একটা দিনের ব্যথা, এক একটা দিনের সীমাহীন কষ্টের সাথে কোনো কিছুরই তুলনা চলে না। অই প্রচণ্ড কষ্টের ভিতর নিজের খুব কাছে, একান্ত কাছে আমি তার মহান অস্তিত্ব অনুভব করেছি। আর তখনই নিজেকে বলেছি, আর একটু সহ্য করো, এইতো আর কটা দিন।

প্রিয় লুতফুন নাহার লতা আপার কান্নামাখা মর্মর কন্ঠের কথাগুলোও মনে আসতো, কেমোর ক‘টা দিন দাঁতে দাঁত চিপে সহ্য করবে সোনা। কত কত ঝড়ের গল্প আর উপলব্ধি। যাই হোক, অনকোলজিস্ট বাঙালি ডাক্তার শামস এ শাকিলের কথায় ফিরে আসি। কাল তার ফোন এলো নর্থওয়েল থেকে। বলল, আপনার পেট স্কান রিপোর্ট খুব ভালো এসেছে। আপনার আর কোনো ডিজিজ নেই। ক্যান্সার ফ্রি। আগামী কয়েক মাস শুধু ছাগলের মতো খাবেন আর ওয়েট বাড়াবেন।

মৃদুস্বরে বললাম, কাজে ফিরতে চাই।
একটু চোখ পাকিয়ে বললেন, আগামী ছয় মাস কোনো কাজ না। শুধু খাওয়া আর রেস্ট।

এরপরও কি খ্যাৎ হওয়ার ভয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলবো না?
আলহামদুলিল্লাহ
আলহামদুলিল্লাহ
আলহামদুলিল্লাহ
আলহামদুলিল্লাহ

লেখক: কথাসাহিত্যিক