
শিবনারায়ণ রায় এবং বইপত্রের মিথ্যামিথ্যি বিজ্ঞপ্তি
চয়ন খায়রুল হাবিবপ্রকাশিত : অক্টোবর ০৩, ২০২২
২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি চলে গেল শিবনারায়ণ রায়ের জন্মশতবার্ষিকী। জন্মেছিলেন ১৯২১ সালে ব্রিটিশ ভারতের কোলকাতায়। মারা যান ৮৭ বছর বয়সে শান্তিনিকেতনে ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। এর ভেতর রাশি রাশি লিখেছেন ও সম্পাদনা করেছেন। মানবতাবাদী চিন্তাবিদ মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ওপর গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। বিশ্ব মনীষী বার্ট্রান্ড রাসেল লিখেছিলেন, শিবনারায়ণ রায়ের দৃষ্টিকোণ সারা পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সময়ের যে কোনো লেখকের তুলনায় তার লেখালেখি অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহ্য।
রাসেলের ইংরেজি মন্তব্যটির এই অনুবাদ পাওয়া যায় ওয়াইকিপিডিয়া বাংলাতে। তাতে বাংলা ভাষার অনুবাদের সামগ্রিক দুরবস্থা বোঝা যায়। ওপরের অনুবাদটি আমার করা। ওয়াইকি বাংলা অনুবাদক শিবনারায়ণ ও মানবেন্দ্রনাথকে গুলিয়ে ফেলেছেন। এ ধরনের অনুবাদকের কাছে যাহা রায়, তাহাই সত্যজিৎ। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করে কিছুদিন কোলকাতা সিটি কলেজে পড়িয়েছেন। তারপর ষাট দশকে যোগ দেন মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারততত্ত্বে অধ্যাপক হিশেবে। সেখানে বিভাগীয় প্রধান হিশেবে অবসর নেন ১৯৮০ সালের শেষ দিকে।
অবসরের পর ১৯৮১ থেকে ১৯৮৩ পশ্চিম বঙ্গে বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র ভবনের অধ্যক্ষ ছিলেন। সারা জীবন বিশ্বের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খণ্ডকালীন অধ্যাপনা করেছেন। শিবনারায়ণ রায় যখন অবসর নিয়েছেন অর্থাৎ আশির দশকের মাঝামাঝি, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য অনুষদে ভর্তি হই। সামরিক শাসনের যাঁতাকলে বিভিন্ন সেশন জটে আটকে ১৯৯০তেও স্নাতক চূড়ান্ত বর্ষে আটকে আছি। সে সময় অনুবাদ করি ওলে সোয়িঙ্কার স্ট্রং ব্রিড নাটকটি, রক্তবীজ নামে। একই সালে সদ্য গঠিত নাট্যকলা বিভাগ, ইংরেজি বিভাগ ও ডাকসুর যৌথ প্রযোজনায় নাটকটি নির্দেশনা দেই কমনওয়েলথ লিটারেচার সেমিনারে ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিলে।
সে-সময় নাটকটি প্রকাশ করেন প্রয়াত কবি আবিদ আজাদ ওনার শিল্পতরু প্রকাশনী থেকে। ২০০৪ সালে একই নাটক আমার ভূমিকাসহ পুরোপুরি প্রকাশ হয় শিবনারায়ণ রায় ও শামীম রেজার যৌথ সম্পাদনায়, ‘আফ্রিকার সাহিত্য সংগ্রহ’ দ্বিতীয় খণ্ড সঙ্কলনে, কোলকাতার দেজ পাবলিশিং ও ঢাকার কাগজ প্রকাশনীর সমন্বয়ে। আমি সে-সময় থাকি বিলেতে, আমার হাতে সঙ্কলনটি পৌছে দেয় ‘রক্তবীজ’ এর কেন্দ্রীয় চরিত্র রূপায়নকারী অপু চৌধুরী। শিবনারায়ণ রায়ের বয়স তখন ৮৩। কখনো ওনার সাথে দেখা হয়নি।
১৯৯৯ সালে প্যাট্রিসিয়াসহ শান্তিনিকেতনে কিছু দিন ছিলাম। দেখা করবার সুযোগ ছিল। কিন্তু তখন আমি ও ফরাসি তরুণী প্যাটি পরস্পরে বিভোর। শিবনারায়ণের নাম অনেকের সাথে আমিও জানতাম। কিন্তু জীবনানন্দ ও বুদ্ধদেবের যেভাবে তুলনা করেছিলেন, তাতে আমার মনে হয়েছিল, উনি আমার সময়কে হয়ত বুঝতে পারবেন না। দেখা হলে হয়তো শেষ বেলায় ওনাকে না বুঝে, তর্ক করে ব্যথা দিয়ে ফেলতাম। এখন উনি আমার কাছে সেই না দেখা হওয়া কিন্তু খুব কাছের একজন অধ্যাপক। ওনার সম্পাদনায় আমার অনুবাদ জায়গা করে নিয়েছিল, এটা ভেবে আমি কেঁপে উঠি, সাহিত্যের অনানুষ্ঠানিক নিষ্ঠায়, নিজের লেখালেখিতে আস্থা বাড়ে।
রক্তবীজের দ্বিতীয় সংস্করণ এখন প্রেসে চলে গেছে ঢাকাতে জাগৃতি প্রকাশনীর তত্ত্বাবধানে। এই সংস্করণে ভূমিকা ৩০ পৃষ্ঠা ছাড়িয়ে গেছে। শিল্পতরু সংস্করণে ভূমিকা ছিল সাকুল্যে আড়াই পৃষ্ঠা। ৩২ বছর পর দ্বিতীয় সংস্করণের বিস্তারিত ভূমিকা ও প্রুফ রিডিংয়ের সময় আমার বারবার মনে হয়েছে, শিবনারায়ণ ওনার মোটা ডাটির চশমা চোখে স্মিত হেসে আমাকে আশীর্বাদ করছেন। সে-আশীর্বাদের জোরেই ৯ বছর ধরে শেষ করেছি জুলেখা ট্রিলজি এবং ২০১৬ সালে নির্দেশনা দিয়েছি ‘ডৌল: জুলেখার জেরা পর্ব’। যার অদৃশ্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার পাথেয়।
কী ধরনের লেখালেখি করতেন শিবনারায়ণ রায়? যারা বাংলাদেশের দার্শনিক আহমদ শরীফকে উল্টেপাল্টে পড়েছেন, তাদের কাছে শিবনারায়ণ রায়কে আপন মনে হবে। আহমদ শরীফের ‘বাঙলা, বাঙালি ও বাঙালিত্ব’ গ্রন্থটি পড়বার পর শিবনারায়ণ রায়ের ‘স্বদেশ, স্বকাল, স্বজন’ প্রবন্ধটিকে মনে হবে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত একটি দৃষ্টিকোণ। শিবনারায়ণ বাঙালি শিক্ষিত সমাজে তিনটি প্রবণতাকে চিহ্নিত করেন। প্রথমটি ধর্মপরায়ণতা, দ্বিতীয়টি স্বজাতিপরায়ণতা এবং তৃতীয়টি মার্কসবাদ। এই তিন ধারাকে তিনি স্রোত হিসেবে আখ্যা দিয়ে মুক্তমনা বলতে একজনকে এই তিন স্রোতের বিরুদ্ধে ও মানবতাবাদের পক্ষে দাঁড়ানোর আহবান জানান।
প্রতিতুলনার জায়গাতে শিবনারায়ণকে রাহুল সাংকৃত্যায়নের যাত্রাসঙ্গীও বলা যায়, তবে গন্তব্য ভিন্ন। কেদারনাথ পাণ্ডে নামে রাহুলের জন্ম ১৮৯৩, মৃত্যু ১৯৬৩। সর্বগ্রাসী পাঠক শিবনারায়ণ যে ‘ভলগা থেকে গঙ্গা’র লেখকের কাজের সাথে পরিচিত ছিলেন, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সনাতন হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নিয়ে বর্ণাশ্রম ত্যাগ করে মার্ক্সবাদ ঘুরে রাহুল বৌদ্ধ দর্শনকে জীবনের পাথেয় করেছিলেন। কিন্তু মূল অন্বেষা ছিল সামগ্রিক মানবতার মুক্তি। শিবনারায়ণ জন্মেছিলেন যে নাম নিয়ে সে নাম ও পদবী বজায় রেখেছেন আজীবন। কিন্তু তার সাথে সংশ্লিষ্ট সংস্কারগুলোকে বর্জন করেছিলেন। মার্কসবাদের পথে গিয়েও যে মানব-মুক্তির কথা বলেছেন তাতে নৈর্ব্যাক্তিক নির্বাণের বদলে ব্যাক্তির স্বাতন্ত্র্য ও বোধের বৈচিত্র্য প্রাধান্য পেয়েছে।
জীবনানন্দ ও বুদ্ধদেবের তুলনা করে শিবানারায়ণ লিখেছিলেন, জীবনানন্দের রচনা পড়ে আমার মনে হয়েছে, যেন তিনি এক নক্ষত্র-বিম্বিত জলাশয়, যেখানে গভীর অন্ধকারের স্তরে স্তরে নানা অনুভব ও ভাবনার ওঠাপড়া আছে, কিন্তু কোনও বহমানতা নেই। অপরপক্ষে বুদ্ধদেব যেন কোনও তুষারাবৃত শৈলশিখর থেকে উৎক্ষিপ্ত একটি নির্ঝর, ধাপে ধাপে বহমান, ক্রমে নদী এবং তার শাখাপ্রশাখায় প্রসারিত হয়ে মহাসমুদ্রের দিকে নিয়ত প্রবাহী। রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ভাষায় বুদ্ধদেবের মতো এত বহুমুখী এবং নিয়ত গতিশীল প্রতিভা আর একটিও দেখতে পাই না।
আশির দশক থেকে আমরা যারা বাংলাদেশের কবিতায় মেতে উঠেছিলাম এবং এখনো সক্রিয় তারা পঞ্চাশ ও সত্তরের কবিতার শৈলী পেরিয়ে এসেছে, যে পঞ্চাশের শৈলী বাংলাদেশে হ্যাঁচকা টানে তিরিশিও ভঙ্গিকে পেছনে ফেলে এসেছে। তিরিশের ভঙ্গি নিয়ে আমাদের কোনো নস্টালজিয়া ছিল না। শিবনারায়ণের মতো একজনের সাথে আরেকজনের প্রতিতুলনা না করে, আমরা তিরিশ ও পঞ্চাশকে দেখেছি সময়খণ্ড হিশেবে। অন্যান্য দশকগুলোর এবং আশিতেও গৌণ কবিদের নস্টালজিয়াতে মেতে, ক্রল করে বিনয় মজুমদারের শব্দ ধরে ধরে জীবনানন্দে পৌঁছাতে হয়েছে আড্ডায় চমকে দিতে। কিন্তু আমাদের অনেকের হয়ে তিরিশিয় প্রবণতার মূল সোপানকে শিবনারায়ণ বলে গেছেন, `কোনও প্রবহমানতা নেই।
এই আবদ্ধতাকে বা এরেস্টেড প্রবণতাকে চিহ্নিত করতে শিবনারায়ণ একটা আগাম কাজ করে দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন সৃজনশীল ধারায় এই এরেস্টেড প্রবণতা বা আবদ্ধতা দেখা যাবে লোকজ ধারার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ও প্রায় বিকলাঙ্গ আনুগত্যে। শিবনারায়ণ যথার্থ সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর বাংলা ভাষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসিক বলেছেন। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ‘লাল শালু’ নিয়ে তার আলোচনায় এবং অন্যান্য বিস্তারে বোঝা যায় বাংলাদেশের ও ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে কি পরিমাণ ব্যথিত হতেন। ওনার সম্পাদনায় আমার যে ‘রক্তবীজ’ নাটকটি প্রকাশিত হয়েছিল, তার বর্তমান সংস্করণের প্রকাশক জাগৃতির প্রতিষ্ঠাতা ফয়সল আরেফিন দীপনকে ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবার শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে মৌলবাদী জঙ্গিরা হত্যা করে।
একইদিনে রাজধানীর লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর মালিক আহমেদুর রশিদ চৌধুরী টুটুল, তার বন্ধু তারেক রহিম ও রণদীপম বসুকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা চালায় মৌলবাদী জঙ্গিরা। শিবনারায়ণ রায় কখনো তার কলমে উৎপীড়ক, আগ্রাসীকে সমর্থন করেন নাই। যে অস্ট্রেলিয়াতে তিনি দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন, সেখানের স্থানীয়দের কিভাবে শ্বেতাঙ্গ উপনিবেশিকরা উচ্ছেদ করেছে তার বিবৃতি দিয়ে গেছেন একের পর এক শ্বেতাঙ্গ সংখ্যাগুরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘শেক্সপীয়রের তিন বেগানা’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘টেম্পেস্ট নাটকের ক্যালিবান চরিত্র হচ্ছে পশ্চিমা সভ্যতার ভাড়ারে লুকানো পরাজিতের কঙ্কাল।‘ সহিংস বা অহিংসার কোনো পথেই যে শিবনারায়ণ চাপানো চিন্তাকে নিতেন না তা তার প্রত্যেকটি লেখাতে স্পষ্ট।
একজন শিবনারায়ণকে নিয়ে লেখার শিরোনামে শেষাংশে যোগ করেছি, ‘বইপত্রের মিথ্যামিথ্যি বিজ্ঞপ্তি!’ যেভাবে অন্যান্য পেশাজীবীদের সাথে মিশে গিয়ে কথিত লেখক, শিল্পীরা দেশে ও প্রবাসে কপটাচার করছে তাতে মননশীলতার সত্যাসত্য আমাদের কাছে ক্রমশ ধুসরতর হয়ে উঠছে। কিম্বা কপটাচারীরা যেভাবে সৃজনশীলতায় ঢুকে যাচ্ছে তাতে মিথ্যাটাকে স্বপ্ন বলে ভুল হতে পারে। তারপর আছে না পড়তে পড়তে দৃষ্টিপাত ভোঁতা হয়ে যাওয়া অথচ ওপরচালাকি করে যাপন চালিয়ে যাওয়া। কিম্বা চটুল অর্থে সেসব সেসব ভাম এবং তাদের কথিত তরুণ মোসাহেবরা যারা সাহিত্যকে ঢেকে দিচ্ছে অসাহিত্যের কচুরিপানায়, যাদের দৌরাত্মে নাটক, কবিতাসহ একের পর এক প্রজন্ম বাংলা ভাষা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
বিজ্ঞপ্তি তো ছোট্ট হবার কথা, চুম্বক অংশ দিয়ে শেষ হবার কথা। বইপত্রেও যেরকম বানিয়ে, বানিয়ে কথা বলা যায়, বিজ্ঞপ্তিতে তা আরো বেশি করা যায়। নিজের কাছে এটুকু পরিষ্কার যে, এটা বইপত্র বা আমার বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড বা আমার স্বামী, স্ত্রী দাম্পত্যের পারস্পরিক পিঠ চুলকানি নয়। এক শিবনারায়ণ রায়ের কিছু দিক-নিরূপিত লেখালেখি ও সম্পাদনা ধরে বইপত্রে প্রকাশিত ততটুকু সত্যে পৌঁছানো, সময়ের ছাকনিতে যা থেকে যাবে, যেটুকু সত্য নিস্পত্তিহীন! শিবনারায়ণের প্রয়াণেও তার স্মিত হাসি মাখা আশীর্বাদ যে-সত্যকে কেবল সামনে এগিয়ে দেয়, যে-সত্য কেবল বিস্তৃত হতে থাকে।
ব্রিটানি, ফ্রান্স