শিমুল বাশারের আত্মগদ্য ‘অন্ধকারের পেটের ভিতর’
প্রকাশিত : জানুয়ারি ০১, ২০২১
বেঁচে থাকার চেয়ে বড় স্বার্থকতা আর নাই। টিয়ার বিয়ের দিন! ফার্মগেটে একটা রেস্টুরেন্টে সে আমার মুখে ভাত তুলে খাওয়ালো। হাতে একটা বেনারসি শাড়ির প্যাকেট। কনে সাজবে সে! পার্লারে পৌঁছে দিয়ে যেন আমার কিছুই এসে যায় না, এমন কঠোর পার্সোনালিটি নিয়ে অফিসে ফিরলাম। দিনের কাজকর্ম স্বাভাবিক ছন্দেই শেষ করে ঘরে ফিরলাম মাঝরাতে। আমার আনন্দ আর উচ্ছ্বাস ভরা দিনের ইতি ঘটতে থাকলো। শেষ বন্ধু হিসেবে আমার পাশে ছিল রাজিব ও ইসমাইল। হঠাৎ করেই বিদেশ চলে গেল দুজন। আহাদ আসতো মাঝেমাঝে। নিকেতনের সাত তলার ওপর নিঃসঙ্গ ফ্ল্যাটটাতে তখনো আমি ঠিক খারাপ ছিলাম না। হঠাৎ এক্সিডেন্ট হলো। আমি পায়ের ওপর আর দাঁড়াতে পারি না। ওয়াশরুমে যেতেই ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা হয়। ঘরে খাবার নাই বলে সাততলা সিঁড়ি ভেঙে অফিসে যাই। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কাজ করি। লাঞ্চ আর ডিনার পর্বটা শেষ করি ওখানেই। নিঃসঙ্গ ফ্ল্যাটটাতে কী যে ভয়াবহ দিন কাটতে থাকলো আমার! রাজিব, একটু কল্পনা করে দেখলেই ফিল করতে পারবি বিষয়টা। সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি কাজ করতো। পথে কুড়িয়ে পাওয়া একটা রঙিন ঘুড়ি ছিল আমার বেডরুমে, মনে আছে? ঘুড়িটার দিকেই তাকিয়ে থাকতাম সারাদিন। নিজেকে একটা সুতো ছেঁড়া ঘুড়ি মনে হইতো বন্ধু!
বছরের শেষদিন গেল। নতুন আরো একটা বছর শুরু হচ্ছে আজ। স্বপ্ন নাই... সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে। যেখানে আলো দেখি, একটু এগিয়ে ভালো করে তাকাতেই সে আলো ধপ করে নিভে যায়। আমার অন্ধকার জগতে নতুন কোনো আলো আর প্রবেশ করে না। কেউ আর আমার পথ আলোকিত করতে পারে না বা চায় না। মনে হয়, কোনো অন্ধকার পথে হেঁটে যাচ্ছি দৃঢ় পায়ে। একটু আগে ডিনার করলাম। ফলি মাছের তরকারি রান্না করেছে মেঘলা বুয়া। খাচ্ছি এমন সময় বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবতে ডুবতে আমি খাচ্ছি। বাইরে বর্ষ বরণের আলো, আওয়াজ আসছে ধুম ধুম। আমি নিশ্চিত, ফলি মাছ নয়, দুনিয়ার কোনো মাছের কাঁটাই আমার গলায় আর আটকাবে না। আমি অন্ধকারের পেটের ভিতর ঢুকে চোখ বন্ধ করে দিলাম এবং চেটেপুটে সব খেয়ে ঠিকঠাক প্লেটটা ধুঁয়ে সঠিক জায়গায় রেখে দিয়ে বারান্দায় এলাম।
আকাশজুড়ে আতশবাজির আলো ঝিলমিল করছে, ফানুস উড়ছে। মনে হচ্ছে, পৃথিবীতে করোনা বলে কিছুই ছিল না.. নাইও। মহামারির মধ্যেই কত কত স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা... নিউ ইয়ার্স রেজুলেশন, আহা! বন্ধু, আমি ফানুসের দূরে উড়ে যাওয়া দেখি আর ভাবি, এখানে তোমরা তবু থাকিবে না? যাবে চলে তবে কোন পথে?
সেই পথে আরও শান্তি — আরও বুঝি সাধ?
আরও বুঝি জীবনের গভীর আস্বাদ?
তোমরা সেখানে গিয়ে তাই বুঝি বেঁধে রবে আকাঙ্ক্ষার ঘর!..
যেখানেই যাও চলে, হয় না কো জীবনের কোনো রূপান্তর;
এক ক্ষুধা, এক স্বপ্ন, এক ব্যথা- বিচ্ছেদের কাহিনী ধূসর
ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাঙ্ক্ষার ঘর!
সিগারেট ধরালাম। বছর নয়, শেষ দিনটাকেই শুধু বিচার করতে বসলাম। গত দু’দিন হাউমাউ করে বুক ভাসিয়ে কেঁদেছি। বছরের এই শেষ দিনটায় আমার ঘুম ভেঙেছে টিয়ার ফোনে। টিয়া আজ আয়োজন করে সকল এক্সদের ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছে। একথা শুনে আমি হাসতে হাসতে বললাম, দিনের আলো থাকতেই সবার খোঁজ নেয়ার মহৎ কাজটা শেষ করতে পারবা তো? ফোনে পর্যাপ্ত ব্যালেন্স আছে? লেগে গেল ঝগড়া।
নুরা আর নুচুর জন্মদিন শুরু হবে একটু পরে। নুরাকে অনেকদিন পর মেসেঞ্জারে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার জন্মদিন ঘটা করে এফবিতে উইশ করলে খুব রাগ করবা নাকি? সে জানালো, রাগ না খুশিই হবে। কি লিখবো তাকে নিয়ে? ভেবে পাচ্ছিলামনা ঠিক তখন... রাজিব, তর একটা বার্তা পেলাম এফবিতে। আবেগাক্রান্ত হলাম খুব।
আমার কাছে আবেগ খুব দামি ব্যাপার। যুক্তি যদি হিরার আংটি হয় তবে সে আংটি থেকে বিচ্ছুরিত আলোটাই হচ্ছে আবেগ। মনে আছে কবি বন্ধু আপন একদিন খুব দুঃখ নিয়ে বলেছিলো, ‘শিমুল ভাই, আমাদের আবেগ সব খরচ হয়ে যাচ্ছে!’ রাজিব আমার আজকাল আবেগ খুব দ্রুত খরচ হয়ে যাচ্ছে... গলগল করে কোথাও যেন গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে। মনে হয়, যুক্তির এক অপরূপ আংটি আঙুলে নিয়ে আমি পৃথিবীর উদ্যানে উদ্যানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ফুল গাছের তলায় হাঁটছি। কত কত ফুল ফুটে আছে, আহা! কিছু ফুল কুড়িয়ে নিচ্ছি যত্ন করে। বেশিরভাগই নিচ্ছি না। যেসব ফুল কুড়িয়ে হাতে রাখছি, তার সুবাস আমাকে মাতাল করছে ঠিকই। কিছু কিছু ফুল ভুল করে কুড়িয়ে নিয়ে আবার ফেলেও দিচ্ছি পথে। কিছু কিছু ফুল জীবনের ভাঁজে যত্ন করে রেখে দিচ্ছি। তেমনই একবৃন্তের দুটি বুনো গন্ধযু্ক্ত ফুল নুরা আর নুচু। শুভ জন্মদিন নুরা, নুচু।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী
























