শিমুল বাশারের আত্মগদ্য ‘চিত্রকলা নিদারুণ এক ছলনা’
প্রকাশিত : নভেম্বর ১১, ২০২০
বেঙ্গল বইয়ে মার্কেজের নিঃসঙ্গতার একশ বছরের পাতাগুলো পুনরায় পড়তে গিয়ে যখন মাথা টলে টেবিলে পড়ে যাই, তখন কোত্থেকে লামিয়া ছুটে আসে। আমাকে এ অবস্থায় দেখে প্রায় জোর করেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার চোখ পরীক্ষা করে তাৎক্ষণিক একটা চশমা ধরিয়ে দেন। এরপর থেকেই কোনো বই পড়তে গেলে খুব ভয় লাগে। এখনো ওইখানে যাই ঠিকই তবে বই পড়ার আগের পরিবেশটা আর নাই। বাঁশবাগানে দাঁড়ায়ে থাকি... সবুজ শাড়ি পরে নুসরাত আর আসে না। নামি দামি হোটেলগুলোর জাঁকজমকে নক্ষত্রের আলোতে একটা ঝলমলে চাঁদ হয়ে সে নাচে।
ইদানীং আবার বেঙ্গলের বাঁশবাগানে দাঁড়ালে আমার আর চাঁদের মাঝে থার্ড একটা চাঁদ দেখতে পাই। থার্ড চাঁদটা ততোধিক উজ্জ্বল! সেদিন গ্যালারিতে মর্তুজা সাহেবের চিত্রকর্ম দেখতে দেখতে বীথিকে বলি, আর্টিস্টের মনন আর তার পিসটা কমপ্লিট হয়ে যাবার মধ্যবর্তী অদৃশ্য স্টেটেই হয়তো প্রকৃত কলাটা ঝুলে থাকে। সেই কলাটা সবাই দেখতে পাবে না, পায় না। এটা দেখার জন্য একটা বিশেষ ইনসাইট থাকা লাগে। যেমন, কোনো বই আমাদের চিন্তা জগৎটাকে পাল্টে দেয় না। বইয়ের মধ্যে লেখা লাইনগুলো শুধু আমাদের চিন্তায় শক্ত একটা প্রভাব ফেলে। বইয়ের সেই একেকটা লাইন আমাদের ইনসাইট দেয়। তবে বইয়ের নলেজ সব সময় নিজেকেই প্রসেস করতে হয়। বাস্তবতার সাথে কানেক্ট করে তা কাজে লাগাতে হয়। ব্যক্তির চিন্তার ক্ষমতা এবং ব্যাকগ্রাউন্ড নলেজের ওপর নির্ভর করে কত তাড়াতাড়ি সেই প্রসেসের কাজটা সম্পন্ন হবে। একজন আর্টিষ্ট তার সমগ্র শিল্পীসত্তা দিয়ে তিনমাস বা ততোধিক সময় ব্যয় করে এমন একটা পিস তৈরি করলেন আর তুমি মাত্র তিন সেকেন্ডে তা বুঝে নিতে চাইছো, বিষয়টা কেমন না?
এরপর মারজানকে কাছে ডেকে প্রাচীন এপিটাফ দেখতে দেখতে গ্যালারি থেকে বের হয়ে আসি। একটা গল্প বলি, বহুবছর আগে আমি এক আর্টিস্ট নারীর প্রেমে পড়েছিলাম এবং আমার সৌভাগ্য ও সাহস হয়েছিল সেই অনুভবটার কথা তাকে জানানোর। একদিন অনলাইনেই তাকে বিষয়টা জানিয়েছিলাম। আমরা তখন প্রায়ই রাত জেগে নানা বিষয়ে কথা বলতাম, জিওপলিটিক্স, হিস্ট্রি, সাইকোলজি, ফিলোসফি ও চিত্রকলার পাশাপাশি অনুরাগের কথাও। তারও বহুদিন পর কোনো এক ভোরে সেই আর্টিস্ট প্রথমবারের মতো কল দিয়ে জানতে চায় আমি কোথায় আছি। সে নিজেই আমাকে খুঁজে নেয়। এরপর আমরা পথে পথে রিকশায় ঘুরি। সে আমারে হাঁটতে হাঁটতে গান শুনায়, কফিশপে পেস্ট্রি খাওয়ায়। সেই সম্পর্কটা আমাকে চিত্রকলায় খুব আগ্রহী করে তুলেছিল। প্রতিটি সম্পর্কই কিছু না কিছু দিয়ে যায়। সুন্দর সেই দিনগুলোতে আমি ভ্যানগগ, পল সেজান, ক্লদ মনেট, পল ক্লে, মাতিস, ক্লিম্পট, দালি ও পিকাসোসহ চিত্রকলার নানা ইজম ও বিবর্তন বুঝতে চাইতাম।
একদিন কোনো এক পাহাড়ি ঝরনার কাছে গেলে সে আমার হাত ছেড়ে দৌড়ে জলে নেমে যায়। আমি ঠায় দূরে দাঁড়ায়ে থাকি। জীবনে বহুবার ঝরনা দেখেছি কিন্তু কোনোদিন দলবেঁধে ওই ঝরনার জলে আমার নামতে ইচ্ছা করে নাই। কিছু মানুষ ওই ঝরনার শীতল জলে নেমে গায়ের সব উষ্ণতা ঝরাচ্ছে সেখানে আমিও গিয়ে লাফিয়ে পড়বো, সত্যিকার অর্থেই এই ইচ্ছাটা আমার কোনোদিন আসে নাই। ভাবলেই কেমন যেন গা গুলিয়ে ওঠে আমার! বিষয়টা বলাও যায় না সব সময়! এমনকি কক্সবাজারের উথাল ঢেউয়ের পানিতেও আমি কোনোদিন নামি নাই। ওই একটাই কারণ, হাজারো মানুষ জলে নেমে বিব্রত ভঙ্গিতে দাঁপাচ্ছে! আসলে আমার জলে নামতে চাওয়ার কাঙ্ক্ষিত ঝরনাটা, প্রত্যাশিত সমুদ্রটা খুব নিভৃতের এবং নির্জনতার।
সেদিন সে জলে নেমে আমাকে খুব করে ডাকতে থাকলো। আমি তার চোখে মুখে একটা শিহরন দেখতে পাচ্ছিলাম, কিছুটা আনন্দ আর কিছুটা ভয়ের। সেদিনই প্রথমবারের মতো অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঝরানার জলে নেমে তার হাত ধরেছিলাম। আরো গভীর জল সাঁতরে গিয়ে ঝরনার প্রবহমান ধারায় সরাসরি ভিজতে চাইলো সে। আমি তাকে নিয়ে যেতেও উদ্যমী হলাম। মনে হলো যেন জলের ভেতরে সাঁতরাতে থাকা জীবন্ত একটা রুই আমার বুকের ভেতরে খলবল করছে! আমি তাকে ছেড়ে ডাঙায় ওঠে এলাম... ছবি তুলবো এবং জুতা পাহারা দেব বলে। একটু আগের মানবী থেকে মাছে রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া তাজা স্মৃতি কিংবা জলের শীতলতায় খুব কাঁপছিলাম আমি।
সেই ট্যুরে পাহাড়েই তাকে রেখে চলে এসেছিলাম ঢাকায়। অবশেষে একদিন রুইমাছের পেটের ভেতর ডিম রাখার ঘনিষ্ঠতম ইচ্ছার কথা জানিয়ে দিয়ে জাল কেঁটে বের করে দিয়েছিলাম মাছটাকে কিংবা নিজেকে বের করে এনেছিলাম জাল ঘেরা জলের ভেতর থেকে। সেসময় আমাদের দুজনের মাঝখানেও অদৃশ্য এক কলা ছিল। বিমূর্ত কলা! এরপর থেকে চিত্রকলা আমার কাছে নিদারুণ এক ছলনা, প্রবল প্রতারণা।
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী
























