শিমুল বাশারের গদ্য ‘আমার কোথাও যাবার তাড়া নেই’
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১১, ২০২০
নিঃসঙ্গতার অনুভুতি আমার হয় না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আমি হাঁটতে থাকলাম পান্থপথ ধরে শুক্রাবাদ হয়ে ধানমন্ডির দিকে। এ পথে কোথায় যেন ছাতিম ফুলের গাছ আছে। নাকে মিষ্টি গন্ধের ঝাপটা লাগছে বারবার। সারাদিন অনেক পরিশ্রমের পরও গন্তব্যহীন এই হাঁটতে থাকা আমাকে ক্লান্ত করছে না।
শহরে এ বছর প্রচুর প্রজাপতি উড়তে দেখছি। এরআগে কখনো এমন দৃশ্য দেখিনি বা হয়তো খেয়াল করিনি। বেশিরভাগ প্রজাপতিই ধূসর বর্ণের, পেটের দিকে কালচে ম্লান আলপনা আঁকা। একটা প্রজাপতি উড়ছে আমার পাশে পাশেই। আরো নিবিড়ভাবে খেয়াল করবো বলে প্রজাপতিটার দিকে মনোযোগ দিলাম। হাঁটা থামিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম।
প্রজাপতিটা আমার মাথার চারপাশে ঘুরে ঘুরে উড়ছে। আমি বসে পড়লাম ফুটপাতের ওপর । চক্রাকারে উড়ে উড়ে অবশেষে প্রজাপতিটা আমার ডান বাহুতে বসলো। আমি স্থির হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম নুসরাতের ফোন কলের জন্য।
আমার আজ কোথাও যাবার তাড়া নেই। কাল ডে অফ। নুসরাতের সাথে পরিচয় বেশি দিনের নয়। বলা চলে পরিচয়ই হয়নি। কয়েকবার দেখেছি মাত্র। চিবুকের পাশে গভীর কালো একটা তিল উৎসুক হয়ে সব সময় তাকিয়ে থাকে। কখনো কখনো মনে হয়, ওই তিলটা তার না বলা কথার নোট সব টুকে রাখে।
গালে হাত রেখে ফেলে আসা আমার সামনেই আমি বসে থাকি। অতীতের ঝরাপাতাদের স্মৃতি মনে পড়ে। আবেগে থর থর নষ্টালজিতে আমি তলিয়ে যেতে থাকি ধীরে। আমার তখন শীত কাতর মধ্যাহ্নের পত্রচ্যুত মেহগনির বুকের ব্যথা অনুভব হতে থাকে। নুরুর কথা মনে হয়, আহা! প্রিয় ফুল, ঝরাপাতা তুমি আমার সাথি। নুরু আমার বন্ধু। মানসিক অসুস্থ হয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল একদিন।
এরও অনেকদিন পর ওর চাচা শহরে এসে ওর জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল। নুরু, আমার কখনোই আর একা লাগে না কিংবা আমি কখনোই একা হবার মতো সমৃদ্ধ মানুষ হতে পারিনি। সব সময়ই নিজেকে পাশে পাই কিংবা সারাক্ষণই কিছু না কিছু নিয়ে মানসিক অথবা শারীরিকভাবে বিজি থাকতে হয়। হঠাৎ গায়ে বসা প্রজাপতিটাকে কেমন যেন নিস্প্রাণ লাগে আমার। হালকা বাতাসে তিরতিরিয়ে কাঁপছে পতঙ্গটার ধুসর দুই ডানা।
ভাবছি... শহরের এই বিব্রত প্রজাপতিটা নিয়ে আজ আমি আর মাহমুদ নুসরাতের কাছে যাব। এমন একটা উপহার পেয়ে নিশ্চয়ই নুসরাত খুব চমকে যাবে। এসব ভাবতেই নিজেকে কেমন যেন প্রোগ্র্যামড... প্রোগ্র্যামড মনে হয়। আমি যত্ন নিয়ে প্রজাপতির ডানাটা আলতো করে চেপে ধরলাম। উড়ে যাবার কোনো তরঙ্গ ওর ডানায় আর টের পেলাম না। চমকে ছেড়ে দিলাম পরক্ষণেই। নিষ্প্রাণ হয়ে নিজেকে শুধুই বসিয়ে রেখেছে পায়ের আকড়ে।
শীতল রক্তযুক্ত এ পতঙ্গটি ঠাণ্ডা মৌসুমে চলাচল করতে পারে না। দৈহিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে আনতে খুব বেগ পেতে হয় তাদের। পরিবেশের তাপমাত্রা তাদের নিজেদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখে। এ সময় প্রজাপতিদের খাদ্য সংগ্রহেও সমস্যা হয়। কারণ চলাফেরার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে সূর্য তাপ এ সময় পাওয়া যায় না। পতঙ্গদের মধ্যে প্রজাপতি দল ক্ষীণায়ু হয়।
মাহমুদ জানে না কিন্তু নুসরাত হয়তো ঠিকই জানে, আমাদের ফুলফলের গন্ধ মুছে যায় ওয়ালেটের ঘষায়। মাহমুদ, নিজেকে আজকাল শীতকাতর প্রজাপতির মতো মনে হয়... আমি ধানমন্ডি-শুক্রাবাদ এলাকায় ঝাঁকে ঝাঁকে গুইসাপ ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবি।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী
























