সরকার আবদুল মান্নানের গদ্য ‘রৌদ্রস্নাত স্কুল’

শেষ পর্ব

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১০, ২০২৩

আবারও বলি, স্কুলটিতে গিয়ে আমি খুই বিস্মিত হয়েছিলাম। স্কুলে ফলের বাগান নেই, পুকুর নেই, ঝোপঝাড় নেই, নির্জনতা নেই, আড়াল-আবডাল নেই। সবদিকে খোলা। একটি রৌদ্রস্নাত স্কুল। ক্লাসে চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ জন ছাত্রছাত্রী। ছাত্রীদের সংখ্যা অতি সামান্য, পাঁচ-ছয়জন। কিন্তু পরে যখন স্যার রোল কল করছিলেন তখন দেখি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ষাটের বেশি। কিন্তু কারো সঙ্গেই আমার কোনো কথা হয়নি। মাত্র কয়েক দিনের ওই স্কুল-জীবনের কারো কথাই আমার মনে নেই। পরবর্তী জীবনে ওইসব সহপাঠী কারো সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে বা পরিচয় হয়েছে তাও নয়। ফলে চরকালিয়া স্কুলের অধ্যায়টি সম্পূর্ণ বিস্মৃতির অতলে চলে গেছে। তবে কয়েকজন শিক্ষকের কথা মনে আছে। এদের মধ্যে বভূতিভূষণ স্যারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল বরাবরই।

 

আমাদের পাশের গ্রামের নমসানকিভাঙ্গার মানুষ ছিলেন বিভূতিভূষণ স্যার। তাদের বাড়িতে আমাদের খুব যাওয়া-আসা ছিল। তিনি আমার বড় ভাই রুহুল আমিনেরও শিক্ষক ছিলেন। সম্ভবত ১৯৭৫ সালের ওই সময় চরকালিয় স্কুলের প্রধান শিক্ষকও ছিলেন তিনি। আমার বাবার সঙ্গে তাঁর ছিল হৃদ্যতার সম্পর্ক। সম্ভবত বিভূতিভূষণ স্যারের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে বাবা আমাকে এই স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। তিনি আমাকে খুব ভালোবাসতেন। স্কুলে যাওয়ার পর থেকে তিনি আমার খোঁজখবর রাখতেন। হালকা-পাতলা একহাড়া গড়নের লম্বা এই মানুষটিকে দেখলে আমার মনে হতো খুব ভালো মানুষ, পৃথিবীর কাউকে সামান্য কষ্ট দেওয়ার কষ্ট তিনি কখনোই নিতে পারেন না। আমাকে সব সময় বাবা সম্বোধন করতেন। বলতেন, মান্নান, কেমন আছ বাবা? পড়াশোনা ঠিক মতো হচ্ছে তো?

 

যখন আমি কলেজে অধ্যাপনা করতে শুরু করি, তখনো বিভূতি স্যারের সঙ্গে এমন সম্পর্কই ছিল। স্কুলে তিনি আমাদের সিক্সে কোনো ক্লাস নিয়েছিলেন কিনা, এখন আর মনে করতে পারছি না। তবে মনতোষ স্যারের কথা বেশ মনে আছে। তিনি ইংরেজি পড়াতেন। মনে আছে নিতাই স্যারের কথা। তিনি বাংলা পড়াতেন। বদিউল আলম স্যারও কি বাংলা পড়াতেন? মনে নেই। মনে আছে বিজ্ঞার পড়াতেন সোহরাব স্যার। ভুলও হতে পারে। আর সেরাজুল হক মৌলভি স্যার পড়াতেন গণিত। ওই স্কুলের আর কোনো শিক্ষকের কথা মনে করতে পারাছি না। কিন্তু যে বিষয়টি কখনো ভুলব না তা হলো, স্কুলের শৃঙ্খলার কথা। যে কটা দিন স্কুলে ছিলাম সে দিনগুলোতে কখনে কোনো শিক্ষকে বিলম্বে ক্লাসে আসতে দেখিনি, শিক্ষার্থীদের বেত্রাঘাত করতে দেখিনি কাউকে, অপমান-অপদস্তও করেননি কেউ। শিক্ষার এই পরিবেশ আমাকে মুগ্ধ করেছিল।

 

শীতের সকালে সেই স্কুলযাত্রা যে খুব খারাপ লাগত, তা নয়, দু’একদিন ভালোই লেগেছে। অপরিচিত দূরের এলাকায় একটি শিশু সঙ্গীসাথিহীন একাকী স্কুলে যাচ্ছে, এই নিয়ে কার-ই বা কী অভিযোগ থাকতে পারে! দলে-বলে স্কুলে যেতে হবে, এমন কোনো নিয়ম তো ধরা নেই। কিন্তু তবুও কয়েক দিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, সর্বনাশ হয়েছে। বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার যে আনন্দ, তার কিছুই নেই। মনে হচ্ছিল, খায়ের স্যার ভুলেই যেতেন যে, একটি শিশু তার সঙ্গে আছে। আপন মনে তিনি হেঁটে যেতেন। আমি অনেকটা রোবটের মতো তার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে স্কুলে গিয়ে পৌঁছতাম। চার-পাঁচ দিন ওভাবেই স্কুলে গেলাম। ক্লাসে তো নয়-ই এমনকি পুরো স্কুলে আমার পরিচিত তেমন কেউই নেই। আমার এক চাচাত বোনের দেবররা উপরের কোনো ক্লাসে পড়ত। তারা একদিন আমার সঙ্গে দেখা করে আমাকে বল-ভরসা দিয়ে গেছে। তারপর আর দেখা নেই।

 

স্কুল ছুটি হওয়ার পর খায়ের স্যারকে আর পাওয়া যায় না। অবিবাহিত যুবক। কোথায় চলে যান তার খোঁজ কে রাখে। তিনি না থাকলে আমার বরং ভালোই হয়। নিজের মতো করে ফিরতে পারি। স্কুলে আসার সময়ও তিনি অনেক সময় আমাদের বাড়ি লাগোয়া পথে আসেন না, অন্য কোনো পথে চলে যান। সেদিন আমার আর স্কুলে যাওয়া হয় না। সুতরাং ভেতরে ভেতরে স্কুল ছাড়ার পরিকল্পনা করছি। খুব জুতসই একটি কারণ দাঁড় করাতে না পারলে তো বাবা রাজি হবেন না। স্কুলের দোষ দেওয়া যাবে না, শিক্ষকদের দোষ দেওয়া যাবে না। ওরকম কিছু বললে উলটো ফল ফলবে। এমন কিছু বললে বাবা বলবেন, তোমাকে এই স্কুলেই পড়তে হবে, এই শিক্ষকদের কাছেই পড়তে হবে। সুতরাং, কিছু না বলে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। খায়ের স্যার দু’একদিন আমার খোঁজ নিয়েছেন। তারপর তিনিও আর কিছু বলেননি।

 

আমি মহানন্দে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। মাছ ধরা, পাখির বসা খুঁজে বেড়ানো, গ্রামময় হৈহৈ করে ঘুরে বেড়ানো- ভালোই যাচ্ছিল সময়। এভাবে দুই-তিন মাস চলে যায়। বাবা বিষয়টা টের পেয়েছেন এবং বুঝতে পেরেছেন চরকালিয়া স্কুলে ভর্তি করা ঠিক হয়নি। তিনি এখন বিকল্প ভাবছেন। সুতরাং আমার কোনো অজুহাত দাঁড় করাতে হয়নি। মে মাসের দিকে আমাকে এখলাসপুর উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় এবং এই স্কুল থেকে ১৯৮০ সালে আমি এসএসসি পাস করি।