সরকার আবদুল মান্নানের স্মৃতিগদ্য ‘হারিয়ে যাওয়া হেমন্ত’
প্রকাশিত : জুন ০৪, ২০২০
এই আমাদের দেশ। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। কতদিন ধরে আমি চিনি এই দেশটিকে। আর কতভাবে যে চিনি, তার কি কোনো শেষ আছে! খুব শৈশবের কথা। একটি প্রজাপতি আমাকে নিয়ে চলল। পথ-বেপথের ভাবনা নেই কোনো। কাঁটার আঁচড়, খোঁচা, সাপ, জোঁক, বিছা— তার নেই কোনো ভয়। থাকবেই বা কেন। প্রজাপতি তো নয়, যেন রঙের আলো। আলোর রঙ। প্রাণের তরঙ্গ। আমি সেই রঙের পিছনে চলছি। আলোর পিছনে চলছি। প্রাণের পিছনে চলছি।
এ-পাতা ও-পাতা। এ-ডাল ও-ডাল। যেন খেলা। খেলছে আমাকে নিয়ে। মায়া জাড়ানো সেই খেলায় আমার ক্লান্তি নেই। দিকবিদিক খেয়ালও নেই। খেলছি তো খেলছিই। এক সময় দেখি, হারিয়ে ফেলেছি আমার প্রিয় প্রজাপতিটি। দক্ষিণের বাগান পেরিয়ে জমি। ধানক্ষেত। তারপর খাল। কোথায় যাবে সে! কোন দূরে! আছে কোথাও! কাছে-পিঠেই। প্রিয় এই বাংলার কচিঘাসের আড়ালে। মনকে সান্ত্বনা দিই।
হঠাৎ দেখি কাশবন। খালের পাশ ঘেঁষে। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। দোল নেই, ঢেউ নেই। কী হলো কাশবনের? মন খারাপ! কাশবন তো বাংলার হৃদয়ের মতো। দোল খাবে ডাইনে-বাঁয়ে; দোল খাবে পুবে-পশ্চিমে। কিন্তু না। তার কিছুই নেই। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। ফুলে তার শিশিরের জল। শিশিরের জলে ভিজে ভিজে যেন কাশফুলের কাকস্নান। তারপর ঝরে যাবে। কোথায় যেন এখন কাশবন মিলে গেছে আকাশের সঙ্গে। ধূসর সাদা মেঘ দাঁড়িয়ে আছে যেখানে। নড়নচড়ন নেই। তাড়াহুড়ো নেই। অলকা থেকে রামগিরি যাবে না সে। সে মিতালি পাতিয়েছে কাশবনের সঙ্গে। ভুলে গেলাম প্রজাপতিটিকে। ভুলে গেলাম কি! হারিয়ে ফেললাম কি! না, কিছুই ভুলিনি। হারাইনি কিছুই। শুধু সঞ্চয়। মুগ্ধ বালক এক। বিপুল কাশবনের বিস্তীর্ণ শুভ্রতার মধ্যে হারিয়ে গেলাম।
ঘাসের ডগায় ঝুলে থাকা শিশির তখনো উবে যায়নি। দূর্বার শিশির। সেই শিশিরে পা ভিজাই আমি। কাশবন আমাকে ডাকে, ‘আয়’। আমি যাই। নরম পেলব কাশফুলে হাত বুলাই। শিশিরের জলে হাত ভিজাই। ভাবি, নিতে তো পারি কয়েক গোছা। রহিমা আপু খুব পছন্দ করে কাশফুল। চালতা ফুলও তার পছন্দ। আর পছন্দের সেরা কদমফুল। এখন নিই কাশফুল। মুঠিভরে কাশের ডাঁট। হাতে দিলেই ডাগর ডাগর চোখ তুলে বলবে, ‘কিরে, কী মতলব?’ বলব, ‘কিচ্ছু না, আপু। তোমারে দিতে আইলাম।’
কিন্তু আপু জানে, ভোরেই ভাপাপিঠার গন্ধ পেয়ে গেছি আমি। আপু পিঠা নিয়ে আসবে। গরম গরম ভাপা পিঠা। ভিতরে গুড়। আগুনের তাপে গুড়টা গলে পিঠার ভিতরে অনেকটুকু ছড়িয়ে যায়। আর তাতে আরও থাকে নারকেলের টুকরো। খেতে খুব মজা। যখন কাশফুলের ডাঁট ভাঙতে ভাঙতে পিঠা খাওয়ার কথা ভাবছি, ঠিক তথনই দেখি আমার দিকে চেয়ে আছে একজন। জল কমতে কমতে কাদা আর সামান্য পানি রেখে রেখে যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে পানি, ঠিক সেখানে। আধো জল আর আধো পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে মাছ খুঁজছে, আর বারে বারে দেখছে এদিক-সেদিক।
নাম তার ডাহুক। ডাহুক খুব বেশি দূর উড়তে পারে না। শিশুর দল মোরগ-মুরগির মতো এদের ধরে ফেলতাম দৌড়িয়ে। কোনো রকমে ঝোপঝাড় থেকে বের করে খোলা মাঠে নিতে পারলেই হতো। তার পর আর যায় কোথায়। ফাঁদও পাততাম কখনো কখনো। হাঁটতে গিয়ে ওদের পা আটকে যেত ফাঁদে। বক, ডাহুক পড়তো ধরা। আমি একা। দৌড়াতে গেলামনা ওই ডাহুকটির পিছু। মায়া পড়ে গেল। এমন নিবিড়ভাবে কখনো তো দেখা হয় না। কি যে শান্ত! কি যে চঞ্চল। কি যে নীরব। আর এত সুন্দর! কুয়াশার হালকা আস্তরণ ভেদ করে ওর তেল মাখা গায়ে যখন সকালের নরম রোদ এসে পড়ল, তখন আমার মনে হলো, পৃথিবীর সব রূপ মাখামাখি করে আছে ওর গায়ে। আমার চোখ জুড়িয়ে গেল। এমন সময় টুপ করে কিসের শব্দ। ডাহুকটি এদিক-সেদিক চেয়ে চলে গেল কাশবনের কোন রহস্যময় গোপন আশ্রয়ে। একেও কি হারিয়ে ফেললাম? না। কখনোই না। জীবনানন্দ দাশের খইরঙা হাঁসটির মতো ‘কোনোদিন পৃথিবীর ভিড়ে/হারাব না তারে আমি— সে যে আছে আমার এ বাংলার তীরে।’
কালু কাকুর ডাক শোনা গেল। তার নাম কলিমুল্যা সরকার। চিৎকার করে ডাকছেন কাকু, ‘গেলি কই রে ।’ গোরু আর লাঙল-জোয়াল নিয়ে যেতে হবে উজানের জমিতে। উঁচু জমি। ধানকাটা হয়ে গেছ আগেই। হেমন্তের শুরুতে। এখন মরিচ, পিঁয়াজ, রসুন বোনা হবে একই জমিতে। কাকুর পিছু-পিছু জোয়াল কাঁধে নিয়ে হাঁটছি। চারদিকে ধান আর ধান। পাকা ধান শুয়ে আছে পৃথিবীব্যাপী। পাড়া-প্রতিবেশী আপনজনেরা ধান কাটছিল। খনি থেকে যেন তুলে নিচ্ছে সোনার মোহর। হেমন্তলক্ষ্মী যেন ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে। ধূসর রঙের কুয়াশার আস্তরণ ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে আমরা চলছি উজানের জমিতে। পথে পথে উঁচিয়ে থাকা ধান আর খড়ের শিশিরে ভিজছি আমরা। কুয়াশার আস্তরণে ঢাকা বিপুল এক শান্ত আকাশের নিচের এই সকাল। এই সোনার ধান, হিরকখণ্ডের মতো ফোঁটায় ফাঁটায় ঝরে পড়া কুয়াশা, এই সুখি কৃষক, এই আমি- দুরন্ত এক শিশু। আর নরম আলোর নিচে ধূসর কুয়াশা ঢাকা হেমন্তের সকাল।
গোরুর কাঁধে লাঙল জুরে দিলেন কাকু। আমার বিদায়। গ্রামের কোনো কিশোর, কোনো কিশোরী কখনো কি বাড়ি ফিরতে পারে ঠিক সময়! আমি কখনো দেখিনি। বাড়ির পথে রওয়ানা হয়ে দেখি পারুল আর ওর ছোট ভাই সুমন বিল্লালদের ধানকাটা জমিতে কী যেন করছে। গিয়ে দিখি, কাঁচি দিয়ে ইঁদুরের গর্ত খুড়ছে। বললাম, ‘জানস, হাপে ইন্দুর খায়। ইন্দরের গর্তে হাপ থায়ে। কামড় দিব কিন্তু।’
পারুল পাত্তাই দিল না। অবজ্ঞার সুরে বলল, ‘যাহ্ যাহ্ । এই মাইট্টা হাপে কামড়াইলে কী অয়! ওগ দাঁতঅ বিষ থাহে না। কামড়াইলে কিচ্ছু অইব না। তুই যে কী! একটা ভীতুর ডিম।’ পারুল আমার বড়। ফোরে পড়ে। আমি পড়ি থ্রিতে। বড়রা এরকম এক-আধটু অপমান করেই। কিন্তু টুতে পড়া সুমনের সামনে! খুবই অপমানজনক কথা। চুপ মেরে গেলাম। অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম গর্তের ভিতর থেকে থোকা থোকা ধান বের করে আনছে পারুল। কী যে সুন্দর সোনালি রঙ! না-দেখলে কল্পনা করা করা যায় না। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপু, ধানগুলি এমন সোনা মতন রং অইল কেমনে?’
পারুল আপা খুব অবাক হলো। সব সময় ওকে তুই তোয়াক্করি করে কথা বলি। আজকে আপু বলছি।
‘কীরে তুই আমারে আপু বললি? ভালো। শোন, মাডির নিচের তাপে সোনালি ধানগুলি আরো সোনালি অইছে। বুঝলি?’
কিচ্ছু বুঝিনি। কিন্তু আর কোনো প্রশ্ন করলাম না। সুমন জানতে চাইল, ‘আপু আমরা ধান লইয়া গেলে ইন্দুরেরা কী খাইব? ওরাই তো অনেক কষ্ট কইরা ধানগুলি কাইট্ট কাইট্টা আনছে?’
পারুল খুব বিরক্ত। ‘ইন্দুরের খাওন-দাওন লইয়া তোর ভাবতে অইব না। ওরা ধান কাডে কিলিগা? ওগো খেত?’
অকাট্য যুক্তি। সুমনের আর কিছু বলার থাকল না। একটি গর্ত থেকে ধান কুড়িয়ে পারুল আর সুমন অন্য ইঁদুরের গর্তের খোঁজ করতে লাগল। আমি চললাম বাড়ির দিকে। এখানে মাঠের উজান। ধান কাটা হয়ে গেছে জমির। উজার মাঠে খড়-নাড়া আর বিধ্বস্ত বেড়া। খড়ের নিচে থেকে গজিয়ে উঠেছে নাম না-জানা ঘাস। পুরনো লাঙলের ধার মুছে গেছে প্রায়। আলে পায়ের পারা পড়েনি অনেক দিন। ছেঁড়া-ছেঁড়া নবীন ঘাস গজিয়েছে আলের কোথাও কোথাও। ঝিনুক-শামুক পড়ে আছে এখানে-সেখানে। হাঁসের জন্য সংগ্রহ করবে কেউ কেউ।
বড় দেখে একটা ঝিনুক নিই আমি। ঘষে ঘষে আম কাটার অস্ত্র হবে একদিন। তখন সেটা অমূল্য সম্পদ হবে। উজার মাঠে ফরিঙের বিচরণ। মাথা মোটা ফরিঙগুলো খায় কী? হেলিকপ্টারের মতো উড়ে উড়ে ল্যান্ড করছে খড়বিচালির ডগায়, বিবর্ণ ধানপাতায়। লেজে ধরলে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে আঙুলে কামড় বসায়। বর্ষার সময় মাছ শিকারীরা জমির আল থেকে ঘাস আর মাটি সরিয়ে চিংড়ি মাছের পথ করে দিয়েছে। ডুব দিয়ে দিয়ে সরিয়েছে তারা ঘাস আর মাটি। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকারে গোপনে পেতে রাখত চাই। খুব ভোরে গিয়ে চাই উঠাতো নৌকায়। প্রত্যেক চাইয়ের মধ্যে চিংড়ি, শিং, বেলে বা অন্য মাছ ডুকলে আর বেরুতে পারত না। হেমন্তের শুরুতে চাই পাতার জায়গাগুলোতে পানি জমে আছে। সেই পানি সেঁচে সেঁচে মাছ ধরছে কিশোর-কিশোরীরা। টাকি, কই, শিং, পুঁটি, টেংরা, বেদা আরও কতরকম মাছ যে থাকে সেই পানিতে!
খালে, পুকুরে, ঝিলে নদীতে মাছ ধরছে বড়রা। ধর্মজাল, ঝাঁকিজাল, ঠেলাজাল- কত রকম জাল দিয়ে মাছ ধরত গ্রামের মানুষ। দিনের মাছ দিনে খেয়ে শেষ করতে পারা যেত না অনেক সময়। পাড়া-প্রতিবেশীকে দাও। আত্মীয়-স্বজনকে পাঠাও। পরে দাও শুটকি। টিনের চালে বিছিয়ে রাখলেই হলো। কবে থেকে গ্রামের মানুষ বাজারে গিয়ে মাছ কিনে? জানি না। তবে তা যে বেশিদিন আগের কথা নয়, তা বুঝি। আমার মাছ ধরার যন্ত্রণায় মা অস্থির থাকতেন। সময় নেই, গময় নেই মাছ ধরে নিয়ে যেতাম বাড়িতে। কখনো-কখনো মা খুব খুশি হতেন। বুঝতাম, বাড়িতে মাছ নেই। কখনো-কখনো রেগে আগুন। ‘খবরদার, মাছ লইয়া বাইত উঠবি না। এই হাঞ্জা বেলা তোর মাছ কুটব কে? ভাগ।’
সারা শরীরে কাদা মেখে ভুতের মতো চেহারা নিয়ে মার কাছে গিয়ে ধবধবে সাদা দাঁতগুলো বের করে হাসি দিতাম। মা তখন হাসতেন না। কান ধরে হিড়হিড় করে নিয়ে যেতেন পুকুরঘাটে। ছাগল খুঁটি ধরে লাভ হতো না কোনো। হিম-শীতল হেমন্তের পানিতে গোরুধোয়া করে নিয়ে আসতেন বাড়িতে। মেখে দিতেন গায়ে সর্ষের তেল। মার চোখে-মুখে তখন খুশির ইশারা। গোপন আদর টের পাই আমি। কখনো কখনো শিশু-কিশোরদের দল মিলে বাড়ির পাশে নাড়াক্ষেতে গোল্লাছুট খেলা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। হালকা শীত ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। পশ্চিমে অস্ত যায় সূর্য। লাল। গাঢ় লাল। মস্ত বড়। আর পুব আকাশ জুড়ে ম্লান চাঁদ। সেও কম বড় নয়। শুধু কুয়াশার চাদর ভেদ করে করে ক্লান্ত চাঁদের আলোয় সন্ধ্যা মিলিয়ে যায় রহস্যময় রাতে। জীবনানন্দ দাশ বরিশালের গ্রামে হেমন্তের এই চাঁদ দেখেছিলেন। এম করে কেউ কি দেখেছে কখনো?
মেঠো চাঁদ রয়েছে তাকায়ে
আমার মুখের দিকে, ডাইনে আর বাঁয়ে
পোড়ো জমি-খড়-নাড়া-মাঠের ফাটল
শিশিরের জল...
হেমন্তে তো ফুল নেই। উজাড় বাগান। পাখিও গায় না গান। তা হলে আপনার প্রিয় কী, হেমন্তে? জিজ্ঞাসা করে যদি কেউ, কী বলবেন? আমি বলব, চাঁদ। হেমন্তের চাঁদের মতো রহস্যঘেরা চাঁদ আর হয় না কখনো। কেউ যদি হেমন্তের চাঁদ না দেখল, তাহলে দেখল কী জীবনে? শহরে থেকে এই চাঁদ দেখা? কখনোই না। হেমন্তের চাঁদ শহরে থাকে না। এই চাঁদ থাকে গ্রামে। গ্রামের পথে-ঘাটে-খালে-বিলে প্রান্তরে। বাড়ির উঠোনেও থাকে হেমন্তের চাঁদ। বর্ষার চাঁদের মতো ফটিকস্বচ্ছ নয় হেমন্তের চাঁদের আলো। মায়া জড়ানো কথা বলা না-বলার মতো এই আলো। রহস্যে সুন্দর। বলা না-বলায় সুন্দর। বাক্ রুদ্ধ করে এই আলো। খুলে দেয় মনের দুয়ার। হেমন্তের চাঁদ তাই কবিতার। বর্ষার চাঁদ গানের-গল্পের। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু গানের মধ্যেই ধরতে চেয়েছেন হেমন্তকে।
হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা
হিমের ধন ঘোমটা খানি ধুমল রঙে আঁকা।
সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে,
কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্প মাখা।
শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই পাওয়া যায়। কিন্তু হেমন্ত পাওয়া যাবে না। এমন কি এই যে পাশের দেশ ভারত, সেই দেশের অনেক স্থানে হেমন্ত নেই। হেমন্ত একান্তই আমাদের। কুকুরের গন্ধ বোঝার শক্তি যেমন প্রখর, কিছু মানুষেরও তেমনি প্রকৃতিকে বোঝার, প্রকৃতির গন্ধ অনুভব করার ক্ষমতা অসাধারণ। হেমন্তকে বুঝতে হলে সেই চোখ-কান আর গন্ধের অনুভব থাকা দরকার। অনেকের কাছেই শরৎ আর শীতের মাঝে হেমন্ত হারিয়ে যায় প্রায়।
আমন ধান উঠেছে। বাড়িতে বাড়িতে ধানের মিষ্টি গন্ধে চারদিক বিমোহিত। ঢেঁকিতে চাল গুঁড়া করার শব্দ। মেয়েদের গান, হাসি, তামাশা। আর পিঠা-পায়েস তৈরির ধুম চারদিকে। হিন্দু প্রতিবেশীদের বাড়িতে নবান্ন উৎসব। দেবতা অগ্নি, কাক, ব্রাহ্মণ ও আত্মীয়-স্বজনদেরও নিবেদন করে গ্রহণ হবে নতুন গুড়ে নতুন অন্ন। তার আগে সাজিয়ে নিত বাড়ি-ঘর। আলপনা আঁকা হতো বাড়ির উঠোনে, ঘরের মেঝেতে, দুয়ারে। তারপর পিঠা-পায়েস আদান-প্রদান। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবার কাছে। এ-বাড়ির লোক ওই বাড়িতে, ওই বাড়ির লোক এ-বাড়িতে। আনন্দ-উৎসব। বাড়িতে বাড়িতে কীর্তন, পালাগান, জারিগান। কোথাও কোথাও নাচও ছিল।
আজকের মতো হেমন্ত তখন মোটেই দরিদ্র ছিল না। দুই ঋতুর মাঝে মিলিয়ে যেতো না হেমন্ত। কালীপূজা বা শ্যামাপূজা হতো হেমন্তেই। এ উপলক্ষে হতো আলোক উৎসব। কুয়াশা ঘেরা রাতে আলোক-উৎসব দেখতে যায়নি কে? মুসলমান পাড়ার কাউকে দেখিনি দীপালিকায় বসে থাকতে ঘরে। বিপুল এই সৌন্দর্য বাইরে রেখে ঘুমুতেই বা গিয়েছে কে? ভিতরে ভিতরে কী যে একটা পবিত্রতা বোধ করতাম তখন, ব্যাখ্যা নেই তার। অনেক পরে বুঝেছি রবীন্দ্রনাথের একটি গানের মর্মকথা।
হিমের রাতে এই গগনের দীপগুলিরে
হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে...
লেখক: শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক
























