সলিমুল্লাহ খান

সলিমুল্লাহ খান

সলিমুল্লাহ খান বাংলাদেশের একমাত্র বালেগ বুদ্ধিজীবী

ডা. অপূর্ব চৌধুরী

প্রকাশিত : জুলাই ২৮, ২০২১

শুরুতেই হয়তো শব্দ চয়নে ভালো লাগবে না অনেকের। না লাগাই স্বাভাবিক। রুচির ভান করা সহজ, রুচিকর হওয়া সহজ নয়। আমি একসময় বাংলাদেশের একমাত্র বুদ্ধিজীবী ভাবতাম একজনকে, ড. আহমদ শরীফ। ওনার সমসাময়িক আরসব লেংড়া কিংবা ফজলি আম, বেশি কিছু নয়। এমনকি বুদ্ধিজীবী দিবসের তালিকাভুক্ত মানুষগুলো সম্মানিত, কিন্তু বুদ্ধিজীবী নন।

বুদ্ধিজীবীর বিশাল সংজ্ঞা দেব না। বোঝার সক্ষমতা, সৃজনশীলতা, আত্মসচেতনতা, শিক্ষা, মানসিক জ্ঞান, পরিকল্পনা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা যার আছে, তিনি একজন বুদ্ধিমান মানুষ। সমাজের এই অগ্রগ্রামী মানুষগুলো আমাদের দিক নির্দেশক। কিন্তু কয়জন সত্যিকার অর্থে এতসব গুণের অধিকারী!

হয়তো আমি, আপনি, কেউ নন। তারপরেও কিছু মানুষকে আমরা অগ্রগামী ভাবি, চিন্তাশীল ভাবি এবং বুদ্ধিজীবী নামের একটি ব্র্যান্ডিং করি। কেউ করে স্বার্থে, কেউ করে অর্থে। ড. আহমদ শরীফ সাহেব বেঁচে নেই। তার মৃত্যুর পর লেংড়া বুদ্ধিজীবীগুলো সম্মানটুকু পর্যন্ত দেয়নি তাকে। কারণ, ওনার আয়নায় নিজেকে দেখলে তারা লজ্জা পেতেন।

এখন যারা বেঁচে বর্তে আছে, তাদের মধ্যে একসময় আমি মাত্র দুজনকে বুদ্ধিজীবী বলতাম। পছন্দও করি দুজনকে। ড. সলিমুল্লাহ খান ও ফরহাদ মজহার। কিন্তু ফরহাদ মজহারকে খারিজ করে দিয়েছি পরে। কারণ, উনি পোকা ধরা আম। বাইরে আমের মতোই রিষ্ট পুষ্ট, ভেতরে পোকা। এই আম তো খাওয়া যায় না, আবার না ছোলা পর্যন্ত বোঝাও যায় না।

সলিমুল্লাহ ও ফরহাদ মজহার সাহেবের মধ্যে সলিমুল্লাহ সাহেব পড়েন অনেক বেশি, কিন্তু এলোমেলো। ফরহাদ মজহার সাহেব একসময় পড়তেন অনেক, ক্রমশ উনি সিলেকটিভ পড়তে লাগলেন এবং কন্সট্রাক্টিভ। সলিমুল্লাহ সাহেবের ভালো লাগার মূল জায়গা সাইকোএনালাইসিস, ফরহাদ মজহার সাহেব পছন্দ করেন একাডেমিক ফিলোসফির আলোচনা।

সলিমুল্লাহ সাহেব লাঁকা ও গ্রামসিকে বেশি পছন্দ করেছেন অন্যদের চেয়ে। ফরহাদ মজহার মার্ক্স এবং হেগেলকে তুলনামূলক পছন্দ করেন বেশি। সলিমুল্লাহ সাহেবের দর্শনের বেসিক জানা আছে, কিন্তু উনি এরপর আর এসব বেশি ঘাঁটেন না। ফরহাদ মজহার সাহেব দর্শনের একাডেমিক বেসিকটা বিস্তৃত আকারে আত্মস্থ করতে করতে দিন পার করেছেন, নিজের চিন্তার কোনো দর্শন গড়ে তুলতে পারেননি।

তাই ওনার রাজনৈতিক দর্শন লাড্ডু হলে ধর্মীয় দর্শন সন্দেশ। উনি নিজেও জানেন না উনি সবসময় লুঙি পরেন কেন। যেহেতু কালচারটা ওনার ব্র্যান্ডিং হয়ে গেছে, না বুঝলেও সেটাই ধরে রাখেন। উনি মার্ক্সবাদ, ইসলামাবাদ এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অদ্ভুদ এক খিঁচুড়ি নিয়ে চলা মানুষ। ককটেলও নয়, গন্ধহীন-স্বাদহীন মকটেল!

আমার সংজ্ঞাতে ফিরে যান, দেখবেন, ফরহাদ মজহার সাহেবের অনেক কিছু নেই। তাই ওনাকে চিন্তাশীল মানুষের দলে রেখেছি, বুদ্ধিজীবী নন। উনি ভালো নাটকবাজও বটে। বাকি রইলো ড. সলিমুল্লাহ খান। সলিমুল্লাহ সাহেবের একটি জিনিস ভালো লাগে, যেটা উনি আহমেদ ছফা থেকে শিখেছেন হয়তো, যা চিন্তা করেন, তা বলতে চেষ্টা করেন। ওনাকে অনেকে মাপেন না, উনি সেটা ধারও ধারেন না। কারণ উনি জানেন যে, উনি কিছু জানেন।

ওনার পড়াশোনার পদ্ধতিটাই এমন। উনি সত্যটাকে ধরতে চেষ্টা করেন। এটা ওনাকে একটি স্ট্রং ইনসাইড ডেপ্থ দিয়েছে নিজের জন্যে সত্য, কিন্তু সেটা পরের জন্যে প্রকাশের সময় গোলমাল করে ফেলেন। এমন সমস্যার অনেকগুলো কারণের একটি হলো, অর্জনের গভীরতা যতটুকু হলে গর্জনের প্রাঞ্জলতা আসবে, ওনার সেটি নেই। আর নেই বলে ওনার বুদ্ধিজীবীর অনেকগুলো গুণ থাকার পরেও দুটো দুর্বলতা তৈরি হয়েছে।

প্রথমত উনি লেখার প্রকাশে ভালো নন। লেখার পারঙ্গমতা যতটুকু এলে নিজের সে গভীরতা তুলে আনা যায়, সেটিতে উনি ব্যর্থ। উনি নিজেও ওনার এই দুর্বলতা জানেন। পরিণত বয়সে তাই উনি কলমে সময় দেয়ার চেয়ে মাইকের সামনে বেশি সময় দেয়া বেছে নিয়েছেন। মাইকের সামনে উনি স্বতঃস্ফূর্ত। লেখার ব্যর্থতা যেখানে, মুখে তিনি সেখানে সফল। সচরাচর আমরা সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলাদের প্রতি আকৃষ্টি হই। কিন্তু সলিমুল্লা সাহেবের বলার ভাষা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক টানে হওয়ার পরেও ওনার বিশ্লেষণের গুণে ভাষার অসুন্দর পরিবেশনটাও উৎরে গেছে।

কিন্তু সলিমুল্লাহ সাহেব বেশি বলতে গিয়ে অসংখ্য বইয়ের নাম বলেন, লেখকের নামও ফর্দ আকারে বলেন, এতে পরিবেশনে ঝিলিক দেয়, কিন্তু সে বই থেকে, সে উদাহরণ থেকে সেই লেখক থেকে যে সারবত্তা টুকু পেলে অডিয়েন্স ওনার কথাকে আরো গভীরে নিয়ে যেতে পারতেন, উনি সেটি দিতে পারেন না। ওনার কন্টেন্টস অনেক থাকে, কন্টেন্টসে জাম্প করেন, এক কনটেন্স এর মূলটি ধরার আগেই আরেক কন্টেন্টসের ডাল ধরেন। ওনার কথা ও আলোচনা শোনার পর মনে হবে যে মেনুটা রাঁধবেন, তার কি কি সদাই পাতি লাগবে, তার বিশাল ফিরিস্তি টুকরো টুকরো করে দেবেন, মাঝে মধ্যে রান্নার মাঝের টিপ্স দেবেন, কি করে রাঁধবেন, এটা আর শেষে বলতে পারেন না।

উনি অনেক ঘোরেন। এলোমেলো ঘোরেন। উনি অনেক বলেন, এলোমেলো না হলেও কথা শেষে মনে হবে একগাদা ছেঁড়া ফুলের সমাবেশ কথায়। কোনো সুতো নেই, কোনো মালা নেই সামনে। ওনার এই সমস্যা ওনার লেখাতেও। সে কারণে নকশি কাঁথা সেলাইয়ের মতো লেখা জুড়ে অনেক সুতোর সেলাই থাকে, দেখতে সুন্দর কাঁথা, কিন্তু গায়ে দিলে আরাম লাগে না। ড. সলিমুল্লাহ খান এই কারণে বুদ্ধিজীবীর অনেকগুলো কোয়ালিটি থাকার পরেও পূর্ণ বুদ্ধিজীবী নন। তবে দেশের একমাত্র বালেগ বুদ্ধিজীবী।