সাদাত হোসাইন
সাদাতের চিন্তা না কইরা, ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি করেন
তুহিন খানপ্রকাশিত : নভেম্বর ১৮, ২০২০
সাদাত হোসাইনের বইপত্র নিয়া কয়দিন পরে পরে কী যেন গুজব টুজব রটে। একবার শুনি হুমায়ূন আহমেদের নকল, আবার শুনি কোনো বিদেশি উপন্যাসের কপি। তো, এইগুলা নিয়া আমার বিশেষ মাথাব্যথা নাই। সাদাত হোসাইন একজন লেখক, নির্মাতা। মানুশ তার বই কেনে। সমালোচক যে, সে সমালোচনা করে। সবাই যার যার জায়গায় ওকে। এগুলা নিয়া হাউকাউয়ের কিছু নাই।
তো রিসেন্ট হাউকাউয়ের সময়, পুরান একটা ঘটনা মনে পড়ল। এইটা সম্ভবত ২০১৭ বা ১৮-র বইমেলার ঘটনা। আমি মেলাশেষে একব্যাগ বই নিয়া কিছুটা দুলে দুলে টিএসসি আসতেছি। সাথে একগাদা ভাই-ব্রাদার, যেমন থাকে আরকি। তো এর মধ্যে নিরা বইলা উঠল— রামদা, আমারে একটা বই কিনা দ্যাও। তো, আমি ওরে কইলাম— কী বই? ও সাদাত হোসাইনের কী একটা বইয়ের নাম বলল, ওই মেলায় খুব চলতেছিল বইটা। নিরা তখন আমার পেছনে ছিল। তো আমি ওর দিকে ফিরা উলটা হাঁটতে হাঁটতে বলা শুরু করলাম— তোমাগো তো এইজন্যেই বই দিই না। কিনবা যতসব আউল ফাউল বই। ভালো বই তো পড়বা না। ওই মিয়া, সাদাত হোসাইনের এইটা পড়ার মতো বই? এই বই কিনা কী করবা তুমি?...
আমার কথা তখনও শ্যাষ হয় নাই। উলটা হাঁটতেছিলাম, পেছনে কে বা কী আছে, খেয়াল ছিল না। হঠাৎ একজনের সাথে ধাক্কা খাইলাম। ঘুইরা দেখি আর কেউ না, স্বয়ং সাদাত হোসাইন; একদম ওই `পড়বি পড় মালির ঘাড়ে` অবস্থা। আমাদের সুমিতদা, তারপর বইপোকাদের আড্ডাখানার আরো কে কে যেন ছিল, তাদের সাথে আড্ডা-আলাপে ছিলেন মনে হয়। তো, আমার মাশাল্লা ভয়েজের কথাবার্তাও তার কানে গেছে। ধাক্কা খাইয়া পেছনে ঘুরতেই উনি একটা হাসি দিয়া জিগেশ করলেন: কী ভাই, আমার নিন্দা করতেছেন নাকি?
আমার তো আর তেমন কিছু বলার নাই। উনি আমার পরিচিতও না, ওইদিন ফার্স্ট দেখা এবং আলাপ। তো যেহেতু কোনো সম্পর্ক নাই, আলাপ নাই, উনার ফার্মে আমার চাকরিও নাই, উনার সাথে আমার লাইফের কোনো লাভ বা লোকসানের যোগ নাই, এমনকি উনি আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টেও নাই— ফলে প্যারা খাইলাম না। আমিও হাইসা বললাম, হ্যাঁ ভাই, তেমনই কিছুটা।
তো এরপরে উনি সিরিয়াস হইলেন। ১০-১২ মিনিট ধইরা আমারে যা বললেন, তার সারকথা হইল: আমার প্রতি যদি আপনার অভিযোগ থাকে, সেটা লেইখা প্রকাশ করেন। আমারে বলেন। আমি শুধরে নেব। ভুল তো সবারই থাকে। কিন্তু আমার বেশিরভাগ সমালোচকই আসলে সৎ না। তাদের সমালোচনা স্পেসিফিক না। ইত্যাদি। আমি কোনো জবাব দিলাম না, উনার কথা মনোযোগ দিয়া শুনলাম। ওনার কথায় বেশ ইমোশন আর একটা চাপা কষ্ট টের পাইতেছিলাম। যাহোক, আলাপ একটু গম্ভীর পর্যায়ে যাওয়ার পর সুমিতদা তাড়াতাড়ি এই আলাপ থেকে আমাদের উদ্ধার করলেন, আমারে টান দিয়া আরেকদিকে নিয়া গেলেন। পরে চা খাইলাম একসাথে।
ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় যে, সাদাত হোসাইনের লেখালেখি টিকবে না। এখন সাদাত সাহেবের অলরেডি ৬-৭ টা উপন্যাস আছে। এরমধ্যে কীংবদন্তি দুই একটা চরিত্রের নাম কি আপনারা জানেন, যা মানুশের মুখে মুখে আছে? রাবেয়া বা আনিস বা মন্টুর মতো? তার বইয়ের কাহিনি কি আজকের উঠতি মধ্যবিত্তরে রিপ্রেজেন্ট করে? আজকের তরুণ সমাজ, স্পেশালি ভার্সিটিপড়ুয়া তরুণদের চিন্তা, চেতনা, আশা, হতাশা, ক্ষোভ, দ্রোহ— এগুলা তার লেখায় কতটা ইফেক্টিভভাবে আসতেছে? হুমায়ূনের হিমুর ব্যাপারে আমি বলি যে, এইটা ঢাকা শহরের মফস্বল থেকে ধীরে ধীরে মেগাসিটি বা রাজধানী শহর হইয়া ওঠার গল্প। সমাজ বা সংস্কৃতির তেমন কোনো ক্রমবিবর্তনের সাক্ষী হয়ে কি থাকতেছে তার বইগুলা? বাঙলাদেশ রাজনৈতিকভাবে যে আজব সময় পার করতেছে, নজিরবিহীন শত শত ঘটনা ঘটতেছে, অনলাইনে হাজার হাজার মিম হইতেছে, ফ্যাসিস্ট রেজিমের আন্ডারে তৈয়ার হইতেছে শত শত জোক্স আর পাঞ্চ, ওবায়দুল কাদেরের পোস্টে হাহা দিয়া স্কুলে যাইতেছে ক্লাশ টেনে পরা ছেলেমেয়েরা— আরো কতকিছু যে ঘটতেছে! এর ভেতর দিয়া যে কালেক্টিভ মেন্টালিটি বিল্ড হইতেছে সমাজে, তার হদিশ কি ওনার ফিকশনে আছে? দেশাত্মবোধ, লিবারালিজম, সেক্যুলার প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের মতো ব্যক্তিত্বগুলা যে একে একে শারীরিক বা আদর্শিকভাবে মইরা পইচা যাইতেছেন, দেশে যে পাওয়ারফুল কোনো সেক্যুলার প্রতিষ্ঠান আর দাঁড়াইতেছে না, টিকটক ও লাইকি গ্রাম-বাঙলার কালচার যেভাবে হুট করে বদলায়ে দিছে, সেগুলা নিয়া পুরান আরবান কালচার্ড বা ছায়ানট আর নতুন প্রজন্মের অ-ছায়ানট তরুণদের চিন্তার যে ক্ল্যাশ— এসবের কোনো ছাপ কি ওনার লেখায় থাকতেছে? মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট থিং ইজ, যেকোনো কিংবদন্তি বা মেধাবী লেখকের একটা গুণ থাকেই। সেটা হলো তার সাব্লাইম প্রকাশভঙ্গি। তার অতিন্দ্রীয় ভাষা। হুমায়ূনের আলাপেই আসেন না! এই লোকটার সব আপনি ফেলে দেন, কিন্তু যে অভিনব গল্পের ভাষা আর স্টাইল উনি তৈয়ার করছেন, সেই ভঙ্গিতে যে সিম্পলসিটি, পাওয়ার, ইমোশন— এগুলা বাঙলাসাহিত্যের নতুন ফেনোমেনা ছিল না? সেই `ফেনোমেনা`টা লাগে তো। সাদাত হোসাইনের ভাষা বা স্টাইলে কি সেইরকম `ফেনোমেনা` আছে? আমার মনে হয় না আছে।
ফিকশন কালের দর্পণ। এইটা ফিকশনের শক্তি না সীমাবদ্ধতা জানি না, কিন্তু এইটা সত্য কথা। ফলে, এইগুলা না থাকলে, তার লেখালেখি লংরানে টেকার কোনো কারণ নাই। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আমি তার বইয়ের ডিটেইলড রিভিউ খুব কম দেখছি। যেগুলা দেখছি, বেশিরভাগ পইড়াই মনে হইছে, তার বইতে এই ব্যাপারগুলা মিসিং, সামহাউ। ইচ্ছা আছে ওনার যেকোনো দুইটা বই ফুল পড়ার। তো এতসব সত্ত্বেও, ওইদিন একটা ব্যাপার আমার মনে হইল যে, সাদাত হোসাইন তো আর কাউরে জোর কইরা বই কেনায় না। পয়সার জোরে সে তার সাহিত্যিক প্রতিভার স্বীকৃতি আদায় করে না। কোনো বড় লেখকরে পয়সা দিয়া, তার হাতে বইয়ের ফ্ল্যাপ লেখায় না। তার উগ্র ভক্তশ্রেণি আছে, সবারই থাকে। তো, এই লোক লেখালেখি করতেছেন, লোকে এমনিতেই বইগুলা কিনতেছে। এতে দোষের কিছু নাই। এমনকি সাদাত তো `ইসলামি` বইও লেখতেছেন না যে, `লেখকের দ্বীনদার যিন্দেগি` দেইখাই লোকে বই কিনবে।
সাদাতের পুঁজি মূলত এদেশের আরবান মিডলক্লাশ ও উঠতি মিডলক্লাশের এস্থেটিক্স। কর্পোরেট মিডিয়ার কারসাজিও যে একেবারেই নাই তা না, আছে। কিন্তু মূল ঘটনাটা হইল ওই এস্থেটিক্স। বাঙালির বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনার যোগফল এই এস্থেটিক্স। আরবান মিডলক্লাশের এস্থেটিক্সও আবার সরল না মোটেই। হুমায়ূনের পাঠকেরাও আরবান মিডলক্লাশ, আবার ইলিয়াসের পাঠকেরাও তাই। মিডলক্লাশের আবেগ বা জীবনযাপনপদ্ধতি আর তার রুচি, যুক্তিবোধ ও সংস্কৃতির ফারাক বোঝা লাগবে, এইটা বিরাট বড় একটা ক্ল্যাশের জায়গা; এইখানেই মিডলক্লাশ রিয়েল হিপোক্রেট। তো, যে এস্থেটিক্সের কারণে লোকে ওনার বই পড়ে, আর যে এস্থেটিক্স থেকে ছায়ানটটাইপ্সরা ওনার সমালোচনা করে— দুই এস্থেটিক্সই আগামীর বাঙলাদেশে বাতিল হইতে পারবে বইলা আমার মনে হয়। তার লক্ষণ দেখা যায় কিন্তু। নতুন বাঙলাদেশে যে নতুন এস্থেটিক্স তৈরি হইতেছে এবং হবে, সাদাত কেন খালি, আর আর সব হোমড়াচোমড়া, পদক বা পাদুকাধারী, আমলা বা কামলা, পুঁজিপতি বা এন্টি-স্টাব্লিশমেন্ট— সবার লেখাই আগামীতে এই এস্থেটিক্সের নিক্তিতেই বিচার করা হবে। অনেকেই হয়ত `সাহিত্যের ধারাবাহিকতা` বা `অগ্রজ ঐতিহ্য` হিশাবে টিকা যাবেন, কিন্তু তা কেবল ওই শামসুর রাহমানের মতো টেকাই হবে বস...
ফলে সাদাতের চিন্তা না কইরা, ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি করেন। যে ঝড়ের পরে এই বাঙলায় আবার নতুন যুগের শুরু হবে, সবখানেই, সেই ঝড়ে আপনার পাণ্ডুলিপিগুলা বাঁচবে তো?
























