
২৬ কোটি বছর আগের তৃণভোজী প্রাণি
রেজা ঘটকপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৫
চীনের উত্তরাঞ্চলে বেগুনি সিল্টস্টোনের স্তর খুঁড়ে প্রায় ২৫ কোটি ৯০ লাখ বছর আগে পৃথিবীতে বিচরণ করা রহস্যময় এক প্রাণীর জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। চীনের গবেষকরা প্রাগৈতিহাসিক বিশাল আকৃতির এই তৃণভোজী প্রাণীটির নাম রেখেছেন ‘ইনশানোসরাস অ্যাঙ্গাস্টাস’। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রাণহানি ঘটানো পার্মিয়ান যুগের ঠিক আগমুহূর্তে এসব প্রাণি বসবাস করত।
চীনের একাডেমি অব সায়েন্সেসের অন্তর্ভুক্ত ইনস্টিটিউট অব ভার্টিব্রেট প্যালিওন্টোলজি অ্যান্ড প্যালিও অ্যান্থ্রোপলজির গবেষক ড. জিয়ান ই এবং ড. জুন লিউ দেশটির শানশি ও ইনার মঙ্গোলিয়া থেকে পাওয়া দুটি জীবাশ্ম পর্যালোচনা করেছেন। দুটি জীবাশ্মেই প্রায় সম্পূর্ণ খুলি থাকায় প্রাণীটির মাথার গঠন ও মেরুদণ্ডের বড় একটি অংশ স্পষ্টভাবে বোঝা সম্ভব হয়েছে। বিজ্ঞানীরা এগুলোকে দুর্লভ সম্পদ বলছেন।
এই প্রাণিটি প্যারেয়াইসাউরিয়া গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। যাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো: দেহ ছিল ভারি ও খাটো আকৃতির, ছোট লেজ ও হাড়ের গাঁটযুক্ত মাথা ছিল। অধিকাংশ প্যারিয়াসরের দৈর্ঘ্য হতো প্রায় ৮ ফুট। আর ওজন হতো মোটামুটি বড় সাইজের একটি মহিষের সমান। পার্মিয়ান যুগে এই প্রাণিরা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে রাশিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে উদ্ভিদভোজী খাদ্যচক্রের মূল স্তম্ভ।
চীনের নাওবাওগো ও সুনজিয়াগো অঞ্চল থেকে পাওয়া সিল্টস্টোন ও মাডস্টোনের স্তরে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগে বন্যায় চাপা পড়া মৃতদেহগুলো এত ভালোভাবে সংরক্ষিত ছিল যে, জীবাশ্মবিদরা এটির হাড়ের সূক্ষ্ম সংযোগস্থলগুলো পর্যন্ত বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। চীনের গবেষকরা প্রথমবারের মতো কোনো চীনা প্যারিয়াসরের সম্পূর্ণ মাথা ও শরীরের জীবাশ্ম বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হলেন।
ইনশানোসরাস অ্যাঙ্গাস্টাসের ফসিলের প্রতিটি হাড়ে হাড়ে রয়েছে নানা ধরনের সংকেত। গবেষকরা এই প্রাণিটির নাসারন্ধ্রের হাড়ে একটি দ্বিখণ্ডিত অংশ এবং খুলির পেছনের হাড়ে এক বিশেষ ধরনের খাঁজ খুঁজে পেয়েছেন। এমন বৈশিষ্ট্য আগে কখনও একসাথে দেখা যায়নি। বিজ্ঞানীরা ফসিলের সিটিস্ক্যান বিশ্লেষণে করে দেখেছেন, প্রজাতিটির চোয়ালের পুরোনো দাঁতের নিচে অপেক্ষমাণ নতুন দাঁতের কুঁড়ি রয়েছে। যা অনেকটা বর্তমানের টিকটিকির মতো সারাজীবন দাঁত পরিবর্তনের প্রমাণ।
পাশাপাশি মাথার হাড়ে থাকা শিং আকৃতির গাঁটগুলোর ভেতরের রক্তনালিও শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। যা সম্ভবত এসব প্রাণির প্রজননের মৌসুমে বা প্রজাতি শনাক্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। চীনের বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন, এই আবিষ্কার থেকে শুধু অতীত জানার জন্যই সীমিত নয়, বরং ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনাও এখান থেকে পাওয়া সম্ভব।
পার্মিয়ান যুগের শেষে সাইবেরিয়ান অঞ্চলে ভয়াবহ আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে সমুদ্রের উষ্ণতা ১৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত বেড়ে যায়। আর তখনই ঘটেছিল সেই মহাপ্রাণহানির ঘটনা। যাতে সেই সময়ের প্রায় ৯০ শতাংশ সামুদ্রিক এবং ৭০ শতাংশ স্থলচর প্রাণি বিলুপ্ত হয়েছিল।
সুপ্রাচীন এই ঘটনাগুলোর আদ্যোপান্ত ও জীববৈচিত্র্য পরিবর্তনের ধরন বুঝতে প্রতিটি নতুন আবিষ্কৃত প্রাণি এখন বিজ্ঞানীদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ইনশানোসরাস অ্যাঙ্গাস্টাসের মতো তৃণভোজী প্রাণিরা উদ্ভিদ উৎপাদনের স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত চাপ সম্পর্কে ভবিষ্যতে হয়তো বিজ্ঞানীদের অনেক ধারণা দিতে পারবে।
চলমান গবেষণার পরবর্তী ধাপে বিজ্ঞানীরা এই জীবাশ্ম স্তরের ওপরের অংশ নিয়ে গবেষণা করবেন। যেখানে হয়তো পার্মিয়ান যুগের শেষদিকে বিলুপ্ত প্রাণিদের চিহ্ন বা ট্রায়াসিক যুগের সূচনাপর্বে বেঁচে যাওয়া প্রাণিদের জীবাশ্মের সন্ধান মিলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গবেষকরা পরবর্তীকালে ড্রোন প্রযুক্তি দিয়ে ভূখণ্ডটির মানচিত্র তৈরি ও খননকাজের পরিকল্পনা করছেন।
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, যদি এসব কোনো ফসিলের হাড়ে এখনও সামান্য কোলাজেন টিকে থাকে, তাহলে তা দিয়ে এসব প্রাণির মৌসুমি খাদ্যাভ্যাস অথবা পানির সংকট-সংক্রান্ত অনেক তথ্য পাওয়াও সম্ভব হতে পারে। ইনশানোসরাস অ্যাঙ্গাস্টাসের মতো সদ্য পাওয়া এই ফসিল বা জীবাশ্ম আমাদের এক বিলুপ্তপ্রায় অজানা বিশ্বের গল্প জানায়। যেখানে সুপ্রাচীনকাল থেকেই প্রকৃতির প্রতিকূলতায় টিকে থাকার সংগ্রাম অত্যন্ত প্রবল ছিল।
আজকের বিশ্বে জলবায়ু সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই ইতিহাস যেন আমাদের নতুন করে বলতে চাইছে, ধ্বংসের কিনারায় পৌঁছানোর আগে প্রকৃতি আদতে বহুভাবে সংকেত পাঠায়। সেই সংকেত বুঝতে না পারলে আবারো প্রাণিকুল ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।