অপূর্ব চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘বিভ্রান্তি বনাম বৈচিত্র্য’

প্রকাশিত : নভেম্বর ২১, ২০২০

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মতামত প্রকাশের সবচেয়ে বড় মাধ্যম । একই সাথে আকর্ষণ, একই সাথে বিকর্ষণ । আকর্ষণ তার বৈচিত্র্যে, বিকর্ষণ তার বিভ্রান্তিতে।

জীবন চলার পথে মানুষ দেখে, পড়ে ও শোনে অনেক কিছুই। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কাছের লোকের কাছ থেকে মতামত শুনে। কখনো কাছের না হয়েও চিন্তা ও জ্ঞানের দিক থেকে যাকে সময়ের বিচারে পরীক্ষিত এবং সমৃদ্ধ মনে করে, তার মতামতকে বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যম গ্রহণ করে, বিবেচনা করে এবং ভ্যালু করে। আরেকটি করে জীবন অভিজ্ঞতার আলোকে। তবে সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়াটিও এত সহজে হয় না।

কাছের জনের সাথে আলাপ করতে গিয়ে মানুষ সেটাই শুনতে চায়, যা সে ভুক্তভুগি হয়েছে। যদি সমস্যাটি তাকে কোনোভাবে লাভ কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত না করে, সেক্ষেত্রে সিদ্ধান্তটি সে সহজে নেয় না, বিশ্বাস করে না, গুরুত্বও দেয় না।

সিদ্ধান্ত কিংবা প্রভাবিত হওয়ার এই প্রক্রিয়াটি সামাজিক মাধ্যমগুলো ভেঙে দিয়েছে। শুধু ভেঙে নয়, গুলিয়ে ফেলেছে। বিষাক্ত করে ফেলেছে। একসময় নিজে বিষ গিলতে গিলতে নিজেই বিষ যোগানের টুলস হয়ে উঠেছে। আবার অন্যকে যে বিষ দিয়েছে, কিংবা প্রতিনিয়ত দিচ্ছে, তা দ্বিতীয় জনের মধ্যে তৃতীয় জনের বিষ যুক্ত হয়ে চতুর্থ মতামত হয়ে তার কাছে আরেক নতুন বিষ হয়ে আসছে, আবার সেটা গিলছে এবং নিজেকে ভাবছে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে।

এখন লোকে শুধু বিভ্রান্ত নয়, কখনো কখনো উম্মাদ হয়ে উঠছে। প্রক্রিয়াটি তাকে তার চিন্তাসূত্র, অভিজ্ঞতা, ভালো মন্দের বিচার ক্ষমতা এবং সঠিক জ্ঞানের অনুসন্ধিৎসু মনকে নষ্ট করে ক্ষিপ্ত কিংবা খ্যাপাটে এক বিকৃতির পুকুর করে ফেলে। শুনতে শব্দটি খারাপ লাগলেও মনের অজান্তে তাই ঘটছে লোকজনের মন ও মস্তিষ্কে, আচরণে এবং বিচরণে।

এখনকার সময়কে বলা হয় ইনফরমেশন ওভারলোড পিরিয়ড। যখন প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত এবং যোগ্য অভিজ্ঞ লোকের চেয়ে অনভিজ্ঞ এবং অযোগ্যের হাত দিয়ে তত্ত্ব, ঘটনা, রটনা, সংবাদ কিংবা তথ্যের প্রকাশ, বিন্যাস এবং বিস্তার ঘটে, তখন ইনফরমেশনের নামে মিস ইনফরমেশন জায়গা ভর্তি হয়ে যায়। তথ্যের নামে ভুল পথ্য সর্বত্র দেখতে থাকে। তখন ভুলকেই ভেবে বসে মূল। তখন চুলকেই ভেবে বসে কূল।

কোয়ালিটির জায়গায় এখন কোয়ান্টিটি জায়গা করে নিয়েছে। আবার কোয়ান্টিটির সিংহভাগ আন্ডার কোয়ালিটি। বাঘের চেয়ে গাধার সংখ্যা বেশি হলে বেড়ালও বাঘ সাজে। দাম দিয়ে কিনলে বুঝেসুজে গেলে। বিনামূল্যে পেলে চুলকেও ভুল করে খেয়ে ফেলে।

মস্তিষ্কের ধরন ও বিকাশ হলে চিন্তার শক্তি গড়ে ওঠে শক্তিমান চিন্তার মুখোমুখি হতে হতে। দুর্বল, ফেইক, অতিরঞ্জিত, চিন্তার পথ্যের নামে অপ্রয়োজনীয় তথ্য নিজের ভেতরকেই নড়বড় করে ফেলে। বাইরে শক্ত কাঠামো দেখতে পেলেও ভিতরে তার কংকালসার। অনেক মুখোশের মাঝে নিজে মুখোশ পরে থাকলে কিছুদিন পর নিজের মুখোশকেই অভ্যস্ত চোখে এবং মনে আসল ভেবে বসে।

এখন শুধু পরিবেশ দূষণ নয়, বায়ু দূষণ নয়, এমনকি শব্দ দূষণও এত মারাত্মক নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দূষণ এখন তথ্য দূষণ। শরীরের অসুস্থতা ওষুধ দিয়ে সরানো যায়, মনের দূষণ কিংবা মনের অসুস্থতার জন্যে তার যেখানে উৎস, সেটা থামাতে হয়। অবাধ তথ্য মানে যা তা নয়। মূল্যবানের জায়গায় চালচুলোহীন যখন জায়গা করে নেয়, জানার পরিধি তখন চুলার ছাইয়ে ভরাট হয়ে যায়। ছাই দিয়ে দাঁতের মাজন ভালো, পাতিল মাজন ভালো, মনে এবং মস্তিষ্কে ঘষলে ময়লার দাগকে কয়লার ভাগ মনে করে বসে।

আড়ালে মূল তথ্য হারিয়ে ভুল তথ্য এক হাত থেকে আরেক হাতে ছড়িয়ে জায়গা ভরে ফেলে। আর সেই ভুলের আবর্জনা সে কখনো ফেসবুকের স্ট্যাটাসের মাধ্যমে, টুইটারের টুইটের মাধ্যমে, টিভি নেটওয়ার্কের নিউজ, ভিউজ, এবং একাধিক উন্মাদের গোলটেবিলের নামে আলোচনার শোরগোলে, ইউটিউবের ব্লগ থেকে লেখার ব্লগ, অনলাইন পত্রিকার টেক্সট গার্ভেজ থেকে প্রিন্ট পত্রিকার খবরের বমীকরণ, চারপাশের এক বিশাল বেড়াজালে তার মন, মস্তিষ্ক, চোখ, কান এসব প্রতিনিয়ত গিলছে।

দিনে দিনে বিষ গিলে একবিষে নিজে যেমন বিষাক্ত হচ্ছে, আবার একই বিষ নিজের পরিচিতজনদের বিলাচ্ছে। একই প্রক্রিয়ার শুরুতে যেটা বলেছিলাম, মানুষ সিন্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার কিভাবে কগনিটিভ বায়াসড হয়, তার প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে বিভ্রান্তির ভার্সনটিকে নিজের ভেতর পাকাপোক্ত করে। ফ্রি তথ্যের নামে মাশুল দিচ্ছে অতিরিক্ত ভুল তথ্যের দামে।

ধর্ম থেকে রাজনীতি, পরিবেশ থেকে স্বাস্থ, ভাইরাস থেকে ভ্যাকসিন— কোনোটাকেই সে বিষমুক্ত রাখতে পারে না। পারছে না। পারার ইচ্ছাও তার যেমন নেই, সে যে বিষযুক্ত, এটাই সে জানছে না, বুঝছে না এবং বুঝতেও চাইছে না। কখনো থমকে গিয়ে খানিক বুঝতে চেষ্টা করলেও পরক্ষণেই ভুলের মিছিল তাকে সরিয়ে দেয় সেখান থেকে। আবার মিশে যায় যেখানে ছিল সেখানে! একসময় ফরমালিন যুক্ত খাবার খেতে খেতে নিজেই ফরমালিনের ডিপো হয়ে ঘুরতে থাকে সমাজে।