আচ্ছা, মানুষগুলো কেন এমন হয়ে যায়

আশিকুজ্জামান টুলু

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ৩১, ২০১৯

আগে একটা ব্যাপার ছিল, বিদেশে আসলে মানুষ চেঞ্জ হয়ে যেত। এখন দেশে আসলে মানুষ চেঞ্জ হয়ে যায়। কথাটা বলার কারণ, এখানে এমন বায়ুচড়া অবস্থা, যা বলার মতো নয়। যারা এখানেই থাকে তারা সেটা ফিল করতে পারবে না, যেহেতু ওই অবস্থাটার মধ্যেই ওদের বিচরণ। কিন্তু যারা আমাদের মতো বাইরে থেকে আসবে, তারা একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবে, কী বায়ুচড়া অবস্থা! এইরকম অবস্থায় মধ্যে বসে লেখক বন্ধুরা কিভাবে লেখে জানি না, এবং কেমনে এই অবস্থায় প্রেমের কবিতা বাইরায়, আমি আসলেই জানি না।

কিসের যে এত হুড়াহুড়ি, সেটাও জানি না। তবে মানুষের মাথা গরম হওয়া খুবই স্বাভাবিক। গোপীবাগ ব্রাদার্স ক্লাবের সামনে থেকে বসুন্ধরা ৩ ঘণ্টায় আইসা ১১৭৩ টাকা উবারের ভাড়া দিয়া বুকে ব্যথা হইয়া গেছে, কোনও মানে হয়? শালা আর কয়টা টাকা দিলে একটা ওই কন্ডিশনের গাড়ি কেনা যায়!

বাসায় কাজ করে সোনালি। আগে ও কাজ করতো আরবে। বাংলা ভাষার সাথে দুই চাইরটা অ্যারাবিকও ঝাড়ে। আমি ওরে আলিফ বে তে ছে জিজ্ঞাসা করছিলাম। ও কইলো, এইটা নাকি আরবিতে নাই। আমি আশ্চর্য হইয়া গেলাম। আম্মা তাইলে ছোটকালে যে হুজুররে মাসের পর মাস এত টাকা দিয়া আমারে পড়াইলো আলিফ বে তে ছে, এইগুলি আরবি না? আমি কি তাইলে আরবি ভাইবা রাশিয়ান ভাষা শিখা ফালাইছি! আমি ইউনিভার্সিটি ওঠার পরও আম্মা জোর কইরা আমারে আরবি শিখাইতো মৌলবি রাইখা। আমি চামে পড়তাম, কাউরে দেখতে দিতাম না। ওনার সামনে আমারে টুপি পইরা বসতে হইতো। সেই আবার আলিফ বে তে ছে।

এই সিরিজের সব কয়টা হরফ ছাড়া আর কিছুই শিখতে পারি নাই, জীবনেও একটা সেন্টেন্স পড়তে পারি নাই। এই কারণে কারও সামনে আগে লজ্জায় বলতাম না যে, আমি কোরআন শরিফ পড়তে জানি না এবং সবসময় ভাইবা নিছি, আমি দোজখেই যামু। আসলে ওই সময় এমন একটা ইম্প্রেশন দেয়া হইত যে, আরবি না জানলে দোজখ কনফার্ম। কিন্তু এখন একটা ধারণা প্রচলিত হইছে, শুধু আরবি না, বরং বাংলাতে অর্থ বুইঝা পড়া আরও ভালো।

যাই হোক, ওই মৌলবি স্যার আমার বয়সে ছোট ছিলেন বিধায় পড়া হইতো না, সমানে আড্ডা চালাইয়া যাইতাম। স্যাররে অনেক রিকোয়েস্ট কইরা সিগারেটটা ধরাইয়া দিছিলাম। পরে উনি আসলে আমার ঘরের দরজা বন্ধ কইরা দুই ভাই মিলা চামে ভুর ভুর কইরা সিগারেট টানতাম আর মিডিল ইস্টের গল্প করতাম। কারণ আমি তখন খ্যাপ মারতে মাঝে মাঝে মিডিলিস্ট যাইতাম আর ওনার সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল একবার মিডিলিস্ট যাওয়া। ব্যাস, সব শেষ। জীবনটা আবারও আলিফ বে তে ছে’তে আটকাইয়া গেল, পড়া আর হইলো না। এত আড্ডা মারলে পড়াশোনা কেমনে হয়!

যা বলছিলাম, সোনালির গ্রামের বাড়ি থেইকা আইলো ফোন। ওগো চেয়ারম্যান কইলো, অরে পাঁচ হাজার টাকা রিলিফ দেয়া হইবো। হঠাৎ কিভাবে বা কি কারণে লোক ধইরা জোর কইরা পাঁচ হাজার টাকা দেয়া হইবো, বুঝতে পারলাম না। ও সবার কাছে তিন দিনের জন্য বিদায় নিয়া গেল। ও ফিরা আইবো দেইখা টাকা দেয়া হইলো, বিদায় সম্বর্ধনা দেয়া হইলো, ওর ফিরা আসাটা কনফার্ম করার জন্য ওর লগে এক্সট্রা ভার্জিন ভালো ব্যবহার করা হইলো, ওর বাচ্চার জন্য আমি একগাদা চক্লেট দিয়া দিলাম, ও সবার ছবি তুলল, ভিডিও করলো।

মাত্র তিন দিনের ব্যাপার, তবুও ওর চোখের কোনায় জল চলে এলো আবেগে– এরেই কয় আবেগে কাইন্দালসি। ওর কাপড় চোপড় রাইখা গেল, যেহেতু মাত্র তিনদিনের ব্যাপার। আইজকা দশদিন হইয়া গেছে, বারবার শুধু আজম খানের ‘আশি আশি একশো ষাইট’ গানটা মনে পড়তেছে। ওই যে, আসি আসি বলে তুমি আর এলে না, ওই গানটা। আমি ওই গানটারে একশো ষাট বলি।

সোনালি আজ আমাদের কাছে সোনালি অতীত হইয়া গেছে। হায়রে মানুষ! আগেই বুঝছিলাম, যখন আবেগে ছবি তোলা শুরু করছিল। এখন ওর কাপড়ের পোটলা খুইলা কয়টা ছেড়া ত্যানা পাওয়া গেল ঘর মুছার। আমাগো হাতে হারিকেন ধরাইয়া উনি কাকড়াইল গেছে গিয়া। ওই গ্রামের চেয়ারম্যান আর ফোন ধরে না। এহন কন, মাইনষের মাথা কেন গরম হইবো না? তার মইধ্যে এখন খবর পাইলাম, ওর আসল নাম আকিনুর, সোনালি ওর নিজের দেয়া নাম! বড় বড় লেখকের ধ্যান-ধারণা যে, আকিনুর বুইঝা ফালাইছিল, তা আমরা বুঝি নাই। যেমন যাযাবর কিংবা জটায়ু।

ঢাকার অধিবাসীরা বলে, প্রতিদিন কিসের ডিম খাই জানি না, তবুও কি করবো, খেতে তো হবে। তার মানে হচ্ছে, যারা ডিম বেচতেছে, শালারা নিজেরা পাইড়া ডিম বেচতেছে কিনা, আমরা জানি না। তার মইধ্যে আছে চাইল, কি মিহি চাইল কিন্তু এইটা প্লাস্টিকের কিনা, কেউ জানে না। তাই তো শুধু ইনপুট আছে, আউটপুট নাই কালেভদ্রে ছাড়া। আর খাওয়াও এত বাড়ছে যে, নিজেরই লজ্জা লাগে, সকালে উইঠা আলুভাজি দিয়া রুটি পাঁচটা খাইলে তো জনসমাজে মুখ দেখানো আসলেই লজ্জার ব্যাপার। আর এখানকার মানুষ পারেও, সকালে নাস্তা করে আলু ভাজি, কপি ভাজি, ডিম, সুজির হালুয়া, রাইতের মাংসের তরকারি, ভাপা পিঠা... বাপরে বাপ, এত খাইলে তো মেরিল প্রথম আলো পুরস্কারটা আমিই পাইয়া যামু। হা হা হা।

এমনি প্যান্টের কোমর ছিঁড়া শায়া পইরা থাকার সময় আইসা পড়ছে এই কয়দিনে। একবেলার খাবার শেষ না হইতে আরেক বেলার খাবার খাই। বুঝতেও পারি না খিদা লাগছে, না লাগে নাই। কী যে এক অস্থির অবস্থা! এরপর আবার আছে শত শত দাওয়াত। গতকাইল তো সারাদিনে তিনবার কাচ্চি খাইছি, উফ!

রাস্তায় বাইরাইলে এমন জ্যাম, হায়রে হায়! প্রথম দুই দিন জ্যামে বইসা থাকা অবস্থায় একজনকে শুদ্ধ ভাষায় কইছিলাম, তোমাদের এখানে যে জ্যাম হয়, তাতে কি তোমাদের অসহ্য লাগে? আমার কিন্তু এই জ্যামে বসে থেকে মোটেই অসহ্য লাগছে না। কারণ আমাদের ওখানকার জ্যামে বসে থাকি আমরা ধৈর্য নিয়ে এবং সেই প্র্যাক্টিস্টাই আমাদের হয়ে গেছে। ও আমার দিকে তাকাইয়া ছিল, কিছু কয় নাই। মনে মনে নিশ্চয়ই কইছিল, হালার পো, আর কয়দিন থাইকা ল, তারপর এই কথা কইস।

ওর প্রতি এখন আমার শ্রদ্ধা অনেক বাইড়া গেছে। তিন ঘণ্টা আর ১১৭৩ টাকা উবারের বিল দেয়ার পর থেইকা ওর সাথে আমি আর দেখা করি না। মনে মনে জ্যামের গুস্টি কিলাই। প্রতিদিন জ্যাম ঠেলতে ঠেলতে মনে কী যে কয়, জানি না। ঢাকা শহরে মানুষ এত বাড়ছে, যা বইলা শেষ করা যাবে না। এই কারণেই গতকাইল কবি বলেছেন, ঢাকায় আগে রাস্তায় বেশি লোকজন দেখলে ভাবতাম, কোথাও মারামারি লাগছে। এখন রাস্তায় কম লোকজন দেখলে মনে হয়, কোথাও মারামারি লাগছে।

লেখক: কণ্ঠশিল্পী ও কলামিস্ট