কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’

পর্ব ৩

প্রকাশিত : জুন ১৫, ২০২৫

প্রকৃতি শূন্যস্থান পূরণ করে দেয়। খুব দ্রুতই আমার একজন বন্ধু জুটে গেল এবং অবধারিতভাবেই তিনি আমার চেয়ে অন্তত দশ বছরের বড়। আমাদের বাড়ির মুখোমুখি স্কুলঘরের মতো লম্বা টিনের চৌচালা একটি ঘর ওঠে। ঘরের চারপাশে লাল ইটের দেয়াল। সেই ঘরের চতুর্থ পুত্র আব্দুল হক খোকন। খোকন সদ্য কুয়েত ফেরত গাড়িচালক। ভীষণ অমায়িক মানুষ। আমি তাকে খোকন মামা বলে ডাকি। খোকন মামা দুর্দান্ত ক্যারাম খেলেন। আমরা শাহজাদপুর বাজারে রোজ ক্যারাম খেলতে যাই। ক্যারামে আমার তো নামডাক আছেই, সঙ্গে খোকন মামা যুক্ত হওয়ায় ডাবলসে আমাদের আর কেউ হারাতে পারে না। কাজেই আমরা সারাদিন খেললেও পকেট থেকে একটি পয়সাও দিতে হয় না। এখন কোথাও এইরকম বাণিজ্যিক ক্যারাম-ক্লাব আছে কিনা জানি না, সেই সময়টাতে প্রায় সব পাড়া-মহল্লাতেই এই ব্যবস্থা ছিল। প্রতি গেইমের জন্য বোর্ড ভাড়া ছিল ১ টাকা, কোথাও কোথাও সর্বোচ্চ ২ টাকা পর্যন্ত। টাকাটা দিতে হতো পরাজিত খেলোয়াড়দের।

আমাদের পাড়ার একটু বর্ণনা দেই। খোকন মামাদের বাড়িটাই প্রথম ইটের দেয়াল দিয়ে নির্মিত বাড়ি। স্থানীয়দের ঘরগুলো ছিল মাটির দেয়াল দিয়ে তৈরি। আমরা যারা বাইরে থেকে এসে আড়াই/তিন কাঠা জমি কিনে ঘর তুলেছি তাদের সকলের বাড়ি ছিল টিন, কাঠ ও বাঁশ দিয়ে নির্মিত। খোকন মামারা তিন ভাই কুয়েতে ছিলেন, একজন ফিরে এলেও আরো দুই ভাই এখনও কুয়েতে আছেন, তারা সকলেই গাড়িচালক। বিশাল একান্নবর্তী পরিবার, অন্যদের চেয়ে তাদের সংসারের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য কিছুটা ভালো।

যারা বাইরে থেকে এসে এইসব এলাকায় বাড়ি করেছেন স্থানীয়রা তাদের বলেন বিদেশি এবং বিদেশি পরিবারগুলোর কর্তাকে তারা `সাহেব` বলে সম্বোধন করেন। পূর্ব দিকে ছোট্ট একটি দ্বীপের মতো জায়গায় বেশ কিছু সাহেব একসঙ্গে বাড়ি করাতে সেই জায়গাটার নাম হয়ে যায় সাহেবের টেক।

এইসব সাহেবদের অধিকাংশই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারী, অল্প ক`জন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন এবং দুয়েকজন আছেন ছোটো-খাটো ব্যবসায়ী। আমার আব্বা গুড়া চায়ের ব্যবসা করতেন। টিকাটুলির কেএমদাস লেনে ছিল তার গুড়া চায়ের দোকান `বাদল টি হাউস` এবং পরে লালবাগে আরো একটি দোকান নেন। দুটোতেই লাল বাতি জ্বলে। দোকানের বাইরেও তিনি শহরের বড়ো বড়ো রেস্টুরেন্টে চা পাতা সরবরাহ করতেন।

আব্বার বৈষয়িক বুদ্ধি খুব খারাপ ছিল, অতি মাত্রায় দয়ালু ছিলেন এবং হিসাবে কাঁচা ছিলেন। এই তিন গুণের কারণে তিনি একজন ব্যর্থ ব্যবসায়ী হিসেবে কর্মজীবন শেষ করেন। আব্বা যখন এই ব্যবসা শুরু করেন একই সঙ্গে শুরু করে কেউ কেউ কোটিপতি হয়েছেন কিন্তু আমার আব্বা নিঃস্ব হয়েছেন। তবে সেইসব কোটিপতিদের মধ্যে কাউকে কাউকে চিনি, তাদের পুত্র-কন্যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ না করে পিতার মতো ব্যবসায়ী হয়েছেন। আম্মার অফুরন্ত প্রাণশক্তি আর প্রাণপণ চেষ্টার কারণে আমরা পাঁচ ভাই-বোন শত অভাবের মধ্যেও পড়ালেখাটা চালিয়ে গেছি। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে ৩ জন মাস্টার্স করেছি, একজন মাস্টার্সের ফাইন্যাল পরীক্ষা দেয়নি, আর একজন, আমার পিঠাপিঠি ছোটো বোন শাহনাজ বিএ পর্যন্ত পড়েছে। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ওর বিয়ে হয়ে যায়, বিয়ের পরে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বিএ ক্লাসে ভর্তি হয়, কিছুদিনের মধ্যেই লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়ে পুরোদস্তুর সংসারী হয়ে যায়।

আমাদের পুরো এলাকায় একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন, সাইদুল হক সাহেব, তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সেকশন অফিসার ছিলেন, পরবর্তিতে আরো দুজন পদোন্নতি পেয়ে অফিসার হন। তবে আমার স্থির বিশ্বাস, এখনকার সরকারি চাকরিজীবীদের মতো তারা তখন অনৈতিক উপায়ে অর্থ উপার্জন করতেন না, প্রত্যেকের ঘরেই টানাটানি ছিল, স্বাচ্ছন্দ্যে পুরো মাস পার করতে পারছেন এমন কাউকেই দেখিনি।

এইরকম একটা পরিবেশে আমার কৈশোর বিকশিত হচ্ছিল। একটা বিকাশমান মধ্যবিত্ত সমাজের গভীরে প্রোথিত ছিল আমার শেকড়। আশপাশে অনুকরণীয় কেউ ছিলেন যা যাকে দেখে স্বপ্ন তৈরি হতে পারে। হঠাৎ করে ভাওয়ালিয়া বাড়ির সামনে, সাতারকুল রোডের ওপর ছাদ ঢালাই দেওয়া একটি বাড়ি উঠে গেল। বাড়ির মালিক জনতা ব্যাংকের এক জিএম সাহেব। জিএম সাহেবের নাম সিরাজুল ইসলাম হলেও তার নাম খুব কম মানুষই জানত। অন্যদের যেমন সবাই হক সাহেব, হামিদ সাহেব ইত্যাদি বলে ডাকত, তাকে কেউ সিরাজ সাহেব বলে ডাকত না। স্থানীয়রা তাকে ডাকত স্যার, অন্যরা জিএম সাহেব। দেয়ালঘেরা, ছাদ ঢালাই দেওয়া একটি একতলা বাড়ি, সিনেমায় দেখা বড়লোকদের বাড়ির মতো একটি গাড়ি-বারান্দাও ছিল। জিএম সাহেব যখন তার স্ত্রী, দুই পুত্র ও দুই কন্যাকে নিয়ে এই বাড়িতে ওঠেন তখন অবশ্য তিনি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর। আমি মনে করি, তিনিও একজন সৎ ব্যাংকার ছিলেন। একজন অসৎ ডিএমডির বাড়ি সাতারকুল রোডের অজপাড়াগাঁয়ে হবার কোনো কারণ ছিল না, তার বাড়ি গুলশানেও হতে পারত।

জিএম সাহেবের ছেলে-মেয়েরা শাদা গাড়িতে চড়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন, আবার গাড়িতে চড়ে ফিরতেন। লোহার গেইটের ভেতরে গাড়ি না ঢোকা পর্যন্ত তারা মাটিতে নামতেন না। তারা কখনোই আমাদের মত ছোটোলোকদের সাথে কথা বলতেন না। অনেক পরে, এই এলাকারই এক সাহেবের কন্যা, মুক্তির সঙ্গে যখন আমার প্রেম হয়, তখন জেনেছি তারা চার বোনও নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে এই এলাকার ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে মিশত না। যদিও প্রকৃতি এই নষ্ট সমাজের এক নষ্ট ছেলের সঙ্গেই তার জীবন বেঁধে দিল। জানি না তিনি এখন এজন্য আফসোস করেন কি-না।

একদিন আব্বা বলেন, জিএম সাহেব তো আমার তৌহিদ চাচার বন্ধু। আব্বার চাচা কাজী হেদায়েতুল ইসলাম (ডাক নাম তৌহিদ) ছিলেন জুট কর্পোরেশনের জেনারেল ম্যানেজার। জিয়ার আমলে কী একটা ঝামেলা হলে তিনি রাগ করে চাকরি ছেড়ে দেন। ছেড়ে দিয়ে নিজেই জুট রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেন। কলাবাগানে তার নিজের বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতে আমরা ২/৩ দিনের জন্য বেড়াতে যেতাম দাদার বাড়ি বেড়ানোর আনন্দ উপভোগ করার জন্য। কিন্তু ঢাকা শহরের কংক্রিটের ভেতরে তিনবেলা পোলাও মাংস খেয়ে আমরা দাদাবাড়ির কোনো স্বাদই পেতাম না।

আমার দাদা ছিলেন উচ্চশিক্ষিত, বিনয়ী, অমায়িক একজন মানুষ। দাদী ছিলেন খুব রসিক মানুষ। সারাক্ষণ আমাদের সঙ্গে নানান রকম রসিকতা করতেন। যৌন রসিকতাও বাদ যেত না, এইটুকুই দাদাবাড়ির প্রাপ্তি ছিল। দাদা হয়ত তার বন্ধু জিএম সাহেবকে নিজের ভাতিজা এবং নাতি-নাতনীদের কথা বলে থাকবেন। এরপরে দেখেছি তিনি আব্বাকে ডেকে কথা বলতেন, আমাদের খোঁজ নিতেন। আব্বা তাকেও চাচা বলে ডাকতেন এবং তিনি আব্বাকে নাম ধরে ভাতিজার মতোই ডাকতেন। জিএম সাহেবের ছোটো ছেলে শামীম সম্ভবত আমার চেয়ে এক ক্লাস ওপরে পড়তেন, এবং মাঝে-মধ্যে তার সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হত। ওর মধ্যে অহংকার মিশ্রিত একটা সারল্য ছিল। আসলে ওদের পুরো পরিবারের মধ্যেই একটা প্রি-কনসেপ্ট ছিল যে এই এলাকায় শিক্ষিত কোনো পরিবার নেই, মেধাবী, সম্ভাবনাময় কোনো ছেলেমেয়ে নেই।

এই জিএম সাহেবের কারণেই উত্তর বাড্ডার সাতারকুল রোড সংলগ্ন এই এলাকাটির নাম হয়ে যায় জিএম বাড়ি। শুরুটা হয় এভাবে, আমরা রিক্সাঅলাদের বোঝানোর জন্য বলতাম, এই রিক্সা যাবেন?
কই যাইবেন?
জিএমের বাড়ির কাছে।
জিএমের বাড়ির কাছে, বলতে বলতেই পুরো এলাকাটার নাম জিএম বাড়ি হয়ে যায়। এখন দূর দূরান্ত থেকে, যেমন গুলিস্তান, ধানমণ্ডি থেকেও, রিক্সা, সিনজির চালককে উত্তর বাড্ডা জিএম বাড়ি বললেই চিনে ফেলে, নামটি এতোটাই বিখ্যাত হয়ে গেছে।

খোকন মামা আমার মধ্যে আরেকটা নতুন নেশা ধরিয়ে দেন। কুয়েত ফেরত তার এক বন্ধু থাকেন মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায়। একদিন আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যান। সেই ভদ্রলোকের ছিল পুরনো হিন্দি সিনেমা দেখার নেশা। বিভিন্ন ভিডিও ক্লাব থেকে তিনি পুরনো সব হিন্দি সিনেমার ক্যাসেট জোগাড় করে আনতেন। বিদেশ থেকে আনা তার ভিসিআরে আমরা সারাদিন ধরে সেইসব সিনেমা দেখতাম। আনারকলি, বেইজু বাওরা, সঙ্গম, মুঘল ই আযম, বরসাত কি রাত, কোহিনূর, ঘুঙ্ঘাট, অনুরাধা, বাবর, হাম হিন্দুস্তানী, কানুন, মাসুম প্রভৃতি সিনেমা সেই সময় দেখে ফেলি। আমি মনে করি খোকন মামার সঙ্গে আমার যে নিবিড় সখ্য গড়ে উঠেছিল সেই সম্পর্কের মূল অর্জন এই সিনেমাগুলো দেখে ফেলতে পারা।

আমরা যদিও বন্ধু ছিলাম কিন্তু খোকন মামা কখনোই কোনো অশ্লীল কথা বা গল্প আমাকে বলতেন না। অনেক পরে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশি গাড়িচালকদের জীবন সম্পর্কে আমাকে কবি জাহিদ হায়দার খুব অদ্ভুত এক গল্প বলেন। তিনি বলেন তার এক বন্ধু মধ্যপ্রাচ্যে গাড়ি চালকের চাকরি করতেন এবং এক বছরের মাথায় তিনি পালিয়ে দেশে চলে আসেন। তার বর্ণনাটাই লিখছি এখানে।

একেকজন শেখের ৩০/৪০ টা স্ত্রী। তারা ও তাদের যৌবনবতী কন্যারা পর্দার আড়ালে যৌনযন্ত্রণায় ছটফট করে। বাংলাদেশি ড্রাইভারদের তারা, একই বাড়ির মা, মেয়ে, বোন, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে যৌন সঙ্গী হিসেবে ব্যবহার করে। রাজি না হলে চাকরিচ্যুতি, যৌন হয়রানির অভিযোগ করার ভয় দেখায়। আমার বন্ধুটি বছরখানেকের মধ্যেই তার ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে পালিয়ে আসে।

জাহিদ হায়দার অবশ্য আমাকে ঢাকা শহরে মেইল প্রোস্টিটিউশিনের উপস্থিতির কথাও বলেছিলেন আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে। চলবে