
কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’
পর্ব ২
প্রকাশিত : জুন ০৬, ২০২৫
বিকেল হলেই কী এক অমোঘ টানে বিশ্বরোডে চলে যেতাম। সাখাওয়াত সাহেবকে ঘিরে তৈরি হওয়া ভিড়ের একজন হয়ে শুনতাম তার রাজনীতি বিষয়ক বক্তৃতা। দেশের ক্ষমতা-কেন্দ্রিক রাজনীতি কিছুটা বোঝার চেষ্টা করতাম। কিছুটা হয়তো বুঝেও ছিলাম। সাখাওয়াত নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ায় আমার রাজনীতি-জ্ঞান চর্চাই কি শুধু ব্যহত হলো? না, সবচেয়ে বড় ক্ষতি যেটা হলো তা হচ্ছে, আমি বন্ধুহীন হয়ে পড়লাম।
সমবয়সীদের আমার কখনোই বন্ধু মনে হতো না। আসলে আমি হয়তো শিশুকাল থেকেই বন্ধুর ছদ্মাবরণে একজন শিক্ষককে খুঁজতাম, যার কাছ থেকে নতুন কিছু শেখা যায়। গৃহশিক্ষক শাহজাহান স্যার ছিলেন আমার শৈশবের প্রথম ও প্রধান বন্ধু। এরপরে বাড্ডায় এসে পাই রুবেল স্যারকে। কিছুদিন আগে তিনি বিমানবাহিনীতে চাকরি পেয়ে চলে যান। এখন আমি পুরোপুরি বন্ধুহীন।
আজ খুব কুয়াশা পড়েছে। অনেক বেলা হয়েছে, কিন্তু এখনও সূর্যের দেখা নেই। ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে আকাশ। আমার মনের আকাশও অন্ধকারাচ্ছন্ন। মিনিকেট চালের ভাত ও চিংড়ি মাছ দিয়ে লাউ তরকারি রান্না করেছেন আম্মা। এই হলো আমাদের সকালের নাশতা। আব্বা সকালে ভাত খেতে পছন্দ করেন, আম্মা পছন্দ করেন রুটি। এই নিয়ে দুজনের চিরবৈরীতা দেখে দেখে আমরা বড় হয়েছি।
আম্মা রুটি খেতে পছন্দ করলেও পুরো পরিবারের জন্য আব্বার পছন্দে ভাতই সকালের নাশতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। মাঝে মাঝে সকলের খাওয়া হয়ে গেলে আম্মা দুটো রুটি বানিয়ে বড় এক মগ চা নিয়ে একা একা খেতে বসেন। আমি আম্মার পাশে বসে দেখি, কী এক স্বর্গীয় তৃপ্তি আম্মার চোখে-মুখে। এই দৃশ্যটি আমার বড় প্রিয় ছিল।
আজ স্কুলে যাইনি। আসলে স্কুলে যেতে আমার আর ভালোও লাগছে না। অনেকগুলো নতুন কবিতা লিখেছি। রুবেল স্যার চলে যাওয়ায় সেইসব কবিতা কাউকে দেখাতেও পারছি না। কাজী নজরুল ইসলাম মেট্রিক পাশ করেননি, আমার পাশ করার কী দরকার, এই সর্বনেশে চিন্তাটা মাথার মধ্যে ঢুকে গেছে। আমি এখন মোটামুটি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, আমি যেহেতু কবিই হবো, কাজেই প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা করার আর কোনো দরকার নেই।
আমার সব কিছু ভালো লাগে, সব কিছু করতে ইচ্ছে করে, শুধু পাঠ্যবইয়ের পড়াটা একদমই ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে কৃষক হতে ইচ্ছে করে, কারখানার শ্রমিক হলেও কোনো ক্ষতি নেই। স্কুল, পরীক্ষা এই শব্দগুলো খুব যন্ত্রণাদায়ক। আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় আলাউদ্দিন ভীষণ পড়ুয়া। ও আমার চেয়ে বয়সে কিছুটা বড়। পরিষ্কার জামা-কাপড় পরে স্কুলে আসে। তেল দিয়ে পরিপাটি করে মাথা আঁচড়ায়। সব সময় ফার্স্ট বেঞ্চে বসে।
আলাউদ্দিন অঙ্কের লজিকগুলো বোঝে না। মাঝে মাঝে সে অংকেও সর্বোচ্চ নাম্বার পায়। কারণ বইয়ের সব অংক ওর মুখস্ত। কিন্তু সংখ্যাগুলো একটু ঘুরিয়ে দিলে বা লজিকটা বদলে দিলে ওর পক্ষে আর রেজাল্ট বের করা সম্ভব হয় নয়। যেহেতু পরীক্ষায় হুবহু বই থেকেই অংকটা আসে, কাজেই ও পুরো নম্বরই পেয়ে যায়। আমার মনে হয়, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের গণ্ডগোল আছে। আমি হলফ করে বলতে পারি, আলাউদ্দিন অংকে আমার চেয়ে অন্তত দশ ধাপ নিচে। কিন্তু প্রায়শই ও আমার চেয়ে বেশি নম্বর পায়।
শুনেছি, আলাউদ্দিন এখন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক হয়েছে। প্রচুর বিত্ত-বৈভব হয়েছে ওর। জীবনের অঙ্কটাও কি ও আগেভাগেই মুখস্ত করে নিয়েছিল? সেকেন্ড বয় এনামুল। এনামুল সর্বার্থেই ভালো ছাত্র। অংকের মাথাও ভালো। পরীক্ষা, প্রতিষ্ঠা এইসব বাস্তব জ্ঞানও ওর ভালো। তবে আলাউদ্দিনের মতো মুখস্ত বিদ্যায় ততটা পারদর্শী নয় বলে সবসময় দ্বিতীয় হয়। এনামুলও সব সময় পরিপাটি পোশাক পরে স্কুলে আসে এবং ফার্স্ট বেঞ্চে বসে। ক্লাসের ভালো ছাত্র বলতে সবাই এই দুজনকেই গোনে।
আমি সবসময় তৃতীয় হলেও নাইনের বার্ষিক পরীক্ষায় কোত্থেকে কামরুজ্জামান এসে তৃতীয় হয়ে যায় এবং সেও তার সুবোধ আচরণের কারণে ভালো ছাত্রের খাতায় নাম লেখায়। আমি এখন ফোর্থ বয়। পোশাকের কোনো ঠিক নেই, মাথা তো কখনোই আঁচড়াই না। পরীক্ষার আগের রাতে ছাড়া কখনোই বই ধরি না। কালে-ভদ্রে ক্লাসের পড়াটা দিতে পারি। কখনোই ফার্স্ট বেঞ্চে বসি না। কিন্তু অংকের ক্লাসে সবাই আমার দিকেই তাকিয়ে থাকে। কারণ যে কোনো জটিল অংকের উত্তর আমার চেয়ে দ্রুত আর কেউ দিতে পারে না।
তারপরেও আমাকে কেউ ভালো ছাত্র বলে না। আমার কথা কেউ মনেও রাখে না। এনামুল এখন অধ্যাপক, ক্যান্টনমেন্ট কলেজে পড়ায়। কামরুজ্জামান কোভিডের সময় মারা গেছে। আমার কথা যে কেউ মনে রাখে না তার একটা প্রমাণ দেই। আমাদের সঙ্গে পড়তো শামীম বিন সালাম ও শাহীন বিন সালাম। ওরা দুই ভাই-ই এখন আমেরিকায় থাকে। শাহীন বিজ্ঞান শাখায় পড়লেও শামীম আমার সঙ্গে বাণিজ্য শাখায়ই ছিল।
কয়েক বছর আগে শামীমের সঙ্গে নিউইয়র্কে দেখা। দেখাটা হয় আমাদের আরেক সহপাঠী কাজী ফৌজিয়ার মাধ্যমে। আমি ওকে দেখেই চিনে ফেলি কিন্তু ও আমাকে চিনতে পারল না। আমি ক্লাসের কত খুঁটিনাটি ঘটনা বলে ওকে মনে করাবার চেষ্টা করলাম। ও কিছুতেই আমার কথা মনে করতে পারল না। এখন স্কুলের বন্ধুদের অনেক সোশ্যাল মিডিয়া-গ্রুপ হয়েছে। এসএসসির ব্যাচ, এইচএসসির ব্যাচ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচ আরো কত কী! এইরকম আমাদেরও একটা এসএসসির ব্যাচ গ্রুপ আছে।
একেবারে খুব সুনির্দিষ্ট করে আমাদের বাড্ডা আলাতুন নেসা হাই স্কুলের গ্রুপও আছে। আমার প্রায়ই মনে হয়, সেই গ্রুপের বন্ধুরা কেউ আমার স্কুলের কোনো স্মৃতি মনে করতে পারেনি, আমার সেই সময়ের মুখশ্রীটিও ওদের কারো স্মৃতিতে নেই, শুধু সন, তারিখ, ব্যাচ জেনে আমাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে। আমি যখন ওদের মুখগুলো ফেইসবুকে দেখি চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগের কত কত স্মৃতি ভেসে ওঠে। কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস, আমাকে দেখে ওদের কারোরই সেই রকম কোনো স্মৃতি মনে পড়ে না।
তবে শিক্ষকরা কিন্তু আমাকে চিনতেন। আমি স্কুল ছাড়ার পর আমার ছোট বোন শাহনাজ স্কুলে ভর্তি হয়। কয়েক বছর পরে ছোট ভাই বিটন। শাহনাজ বেরিয়ে গেলে আরেক ছোট বোন বিউটি ভর্তি হয়, সবশেষে ছোটো ভাই লিমন। ওদেরকে প্রথম দিন স্কুলে দেখেই প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে অন্যান্য সকল শিক্ষক চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করেছেন, তুমি জহিরের বোন? তুই জহিরের ভাই? এগুলো অবশ্য অনেক দিন আগের কথা। তখন শিক্ষকদের এইসব কথা ভাই-বোনদের কাছে শুনে খুব ভালো লাগত।
আমার প্রিয় শিক্ষকদের অনেকেই এখন বেঁচে নেই। আমি যখন ভর্তি হই তখন আব্দুল খালেক সাহেব প্রধান শিক্ষক ছিলেন। এরপর তয়েবুর রহমান স্যার প্রথমে প্রধান শিক্ষক এবং পরে স্কুলটি কলেজ হলে প্রিন্সিপাল হন। দুজনই আজ প্রয়াত। প্রিয় শিক্ষকদের মধ্যে বাংলা পড়াতেন মান্নান স্যার, তিনিও বেঁচে নেই। রহিম স্যার অঙ্ক পড়াতেন, সম্ভবত তিনিও প্রয়াত। শিক্ষকদের প্রিয় হওয়া আর বন্ধুদের প্রিয় হওয়া হয়তো সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। হয়তো আমার মধ্যে এমন কিছু ছিল যা শিক্ষকদের আকৃষ্ট করতো কিন্তু বন্ধুদের আকৃষ্ট করত না।
একটা বিষয় তো আমি জানিই, আমি বন্ধুদের সান্নিধ্য কখনোই পছন্দ করতাম না। সমবয়সীদের তখনও এবং এখনও, মনে হয় অনেক দূরে ফেলে আসা পথ, সেই পথের প্রতিটি বাঁক আমার চেনা, ওখানে আর যাব কেন? আমাকে যেতে হবে সামনে, বড়রাই সামনের পথের খোঁজ দিতে পারেন। তাই বড়দের সঙ্গই আমার আজন্ম প্রিয়। চলবে