
আত্মপরিচয় খুঁজতে গিয়ে মধ্যবিত্তরা যেভাবে সেক্যুলার হয়ে ওঠে
ফার দীনপ্রকাশিত : মার্চ ২৯, ২০২২
মধ্যবিত্ত সেক্যুলারদের সেক্যুলার হয়ে ওঠার পেছনে সাধারণত কোনও তাত্ত্বিক কারণ থাকে না। এরা ধনী সেক্যুলারদের সামাজিক গ্ল্যামারে মোহিত হয়, এরপর জাতে ওঠার তাড়না থেকে সেক্যুলারদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রজেক্টে অংশ নেয়। এরপর ধীরে ধীরে সেও সেক্যুলার হয়ে ওঠে।
এটাই হলো Dominative শক্তির প্রতি Inferior জনসাধারণের মুগ্ধতা থেকে জন্ম নেয়া Inferiority Complex. মানুষ তখন এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে প্রভুর চাইতেও বড় প্রভু হবার আকাঙ্ক্ষা থেকে Dominative Culture কে অনুসরণ করা শুরু করে। এরপর এর দ্বারা অর্জিত বিভিন্ন সামাজিক গ্ল্যামারের মাধ্যমে সে Superiority Complex এ ভুগতে শুরু করে এবং নিজের জাতি, সংস্কৃতি ও ধর্ম যে কতটা নিচ ও অসভ্য, তা প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কারণ, সূর্যের চাইতে বালি গরম হয় বেশি।
একটা বিষয় কি খেয়াল করেছেন, চারদিকে হিন্দু বেষ্টিত হয়ে হিন্দুত্ববাদী সরকারের আমলে হিজাব নিষিদ্ধ হলে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমরা রাস্তায় নেমে পড়ে। ক্লাস বর্জন করে। কিন্তু বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, রাজনৈতিকভাবে মুসলিমরা শক্তিশালী হবার পরও যখন সরকারি কর্তৃত্বহীন টোটালি পাওয়ারলেস প্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছু ছ্যাঁচড়া লোক অঘোষিতভাবে বোরকা নিকাব নিষিদ্ধ করে, তখন আমাদের সন্তানেরা রাস্তায় নামা তো দূরের কথা সামান্য ক্লাস বর্জনের সৎসাহসও করতে পারে না। হলিক্রসে মেয়ের ফুলহাতা কেটে হাফহাতা বানিয়ে শরীর উন্মুক্ত করে দেয়ার পরও কিছু করিনি।
কারণ কি বলে আপনার মনে হয়? আমার যেটা মনে হয়, আমরা অতিমাত্রায় ক্যারিয়ার সচেতন। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান যে কোনো মূল্যে ঠিক রাখতে চাই। পর্দার চাইতে এখনো আমাদের কাছে নিজের ক্যারিয়ার, প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার (?) গুরুত্ব বেশি। এগুলার যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, সেই চিন্তা থেকেই প্রতিবাদী কোনো পদক্ষেপ নেয় না। দ্বীনদার মেয়েরা হয়তো নিজে ঠিক আছে, কিন্তু পরিবার তার অনড় অবস্থা মেনে নেবে না। তাই অতটা সাহস করতে পারে না। কিন্তু ভারতে সম্ভবত এসব মেয়েরা পারিবারিক সাপোর্টও পায়।
আমার নিজের অবস্থাও এমন ছিল। স্কুলগামী বাচ্চার গার্ডিয়ানরা সাধারণত পাগল লেভেলের ক্যারিয়ার সচেতন হয়, এরা জাস্ট ক্রেজি। পঙ্গপালের মতো ছুটে চলে। আমাকে এই বলে ধমকাতো যে, টিফিনের সময় সুন্নাত জোহরের নামাজ বাদ দিয়ে পোলাপান কেমনে কি করে আরও সামনে আগাবে সেই চিন্তা করে। কিন্তু আমার কাছে পড়ালেখার (?) গুরুত্ব নাই, তাই সুন্নাত নামাজে সময় নষ্ট করি।
এটা শুধু আমার পরিবারে না, রমজান মাসে পরীক্ষা পড়লে আমাদের হাইস্কুলের বাচ্চাদের বাপ-মা ওদেরকে রোজা রাখতে দিত না। কারণ রোজা রাখলে দুর্বল হয়ে পরীক্ষা প্রস্তুতি ভালোভাবে নিতে পারবে না।
এই যে বাচ্চাদেরকে ক্যারিয়ার ডেভলপমেন্টের আশায় ধর্ম থেকে দূরে রাখে, এরাই কিন্তু আবার হন্যে হয়ে সেক্যুলারদের আয়োজিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে বাচ্চাকে নিয়ে কুত্তার মতো দৌড়ায়। এদের কাছে ধর্মের চাইতে জাগতিক একেকটি এচিভমেন্ট মহামূল্যবান হয়ে ওঠে। এগুলা সাধারণত মধ্যবিত্তের ধনীদের প্রতি মোহ থেকে তৈরি হয়। আপনি কোনও সৎ মধ্যবিত্তের সাথে কথা বললে বিষয়টা সহজেই বুঝতে পারবেন।
আমি এমন দুজনকে পেয়েছি। একজনের সাথে সম্ভবত একবার শহরে বিয়ের অনুষ্ঠানের কিছু অযৌক্তিক বিষয় নিয়ে আলাপ করছিলাম। সে বলল, এগুলা করে শুধু ফকিন্নিরা। কোনও বড়লোককে এমন করতে দেখবা না।
আরেকজন আছে, মুসলিমরা যেরকম নবি-রাসূলদের উদাহরণ দিয়ে বাচ্চাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, উনারা এই এই করতেন (অর্থাৎ আমাদেরও উনাদের অনুসরণ করা উচিত), তো এই লোক ঠিক এইভাবে তার বাচ্চাদেরকে ইনফ্লুয়েন্স করার চেষ্টা করে ধনীদের উদাহরণ দিয়ে।
বড়লোকরা এই এই পরে, কোনও বড়লোককে এইসব কাজ করতে দেখবি না, বড়লোকরা এই এই করে, বড়লোকরা এইভাবে কথা বলে, বড়লোকরা এই এই এই এই... । বলা দরকার, বড়লোক মানে ধনী, টাকাঅলা।
যেহেতু শহুরে ধনীরা সেক্যূলার হয়, তাই এদের অনুসারী মধ্যবিত্তও সেক্যুলার হয়ে যায়। এই ট্রানজিশন পিরিয়ডটা আপনি খুব ভালোভাবে খেয়াল করতে পারবেন কনসারভেটিভ গ্রাম্য সমাজ থেকে মাইগ্রেট করে শহরে এসে আবাস করা মধ্যবিত্তদের মধ্যে। আপনার এলাকার এরকম একটা মধ্যবিত্তকে বেছে নিন, আর চার-পাঁচ বছর লক্ষ্য রাখুন। তারপর দেখেন কী হয়!
শহরে আমাদের পাশের বাসায় যারা ছিল, ওদের অবস্থা এরকম হয়ে গেছিল। তারা হয়েছিল তাদের আরেক আত্মীয়ের মাধ্যমে। ওই আত্মীয়রাও মধ্যবিত্ত বলা যায়, ওদের ট্রানজিশনটাও এভাবেই হয়েছিল। ওই ফ্যামিলিতে আবার একটা শাতিমও আছে। এরা কেউই কিন্তু প্রথমদিকে এমন ছিল না। গ্রাম থেকে আসা জাতে উঠতে গিয়ে পা পিছলানো লোক এরা। এদের জীবনে ধর্মের প্রভাব ছিল, কিন্তু আস্তে আস্তে সেসব ফিকে হয়ে যায়।
চট্টগ্রামে থাকতাম। চট্টগ্রামে সেক্যুলারদের আড্ডাখানা হলো ডিসি হিল। তো ওখানে তারা সাংস্কৃতিক বা এজাতীয় বিভিন্ন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ইনসিকিউরিটিতে ভোগা অভিভাবকদের আকৃষ্ট করতো। আর তারপর এদের সাথে থাকতে থাকতে বাচ্চা কাচ্চা ব্রেনওয়াশড হয়ে যায়।
এ ধরনেরর পরিবারগুলোর প্রথম প্রজন্ম (অর্থাৎ বাবা-মা) সেক্যুলারদের সাথে মেশা শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক স্ট্যাটাস গেইন করার জন্য। বাচ্চা প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার পেলে সমাজে বুক ফুলাতে পারবে, এই সিম্পল এচিভমেন্টের জন্য অভিভাবকরা পুরা স্কুল কলেজ লাইফে কুত্তার মতো দৌড়ায়। আর তখন মূলত টোপটা গেলে।