আলিমদের হাঁড়ি ভেঙে গেছে হাটে

ফারিহা আমাতুর রহমান

প্রকাশিত : এপ্রিল ১২, ২০২০

মুফতি কাজী ইব্রাহীম, তারিক মুনাওয়ার, মতিউর রহমান মাদানী, আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফসহ অন্যান্য বিতর্কিত বক্তার কিছু মুর্খ বক্তব্যের নমুনা পড়া যাক:

ক. যে কোনো ছাত্র আন্দোলন হারাম। ছাত্র আন্দোলন মানুষ করে না, পশু করে। খ. হানাফি ভাইয়েরা আল্লাহকে `আর রাহমান` বলে বিশ্বাস করে না। গ. করোনা ভাইরাস প্রসঙ্গে তাদের কথাবার্তা লিখতে গেলে উপন্যাস হয়ে যাবে। ঘ. মাস্ক পরা লাগবে না। তিন ক্বুল পড়ে মুখে ফুঁ দিয়ে বাইরে বের হয়ে গেলেই হবে।

এরকম আরো অসংখ্য নমুনা আছে যা আছে। যা খুবই হাস্যকর। উল্লেখিত ব্যক্তিরা যে আদৌ আলিম নন, একথা স্পষ্ট। সাধারণ মানুষের জ্ঞান এমনিই কম বলে সাধারণত আরবি জানা এবং ভালো কোনো প্রতিষ্ঠান যেমন মদিা বিশ্ববিদ্যালয়, আজহার, দারুল উলুম ইত্যাদিতে পড়াশোনা করা যে কাউকেই, বিশেষত তিনি যখন চটকদার কথা এবং কথায় কথায় আলিমদের উদ্ধৃতি প্রদান, কোরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি প্রদান এবং বিভিন্ন বইয়ের কথা উল্লেখ করেন (যার অনেকগুলো হয়তো কখনও মলাট খুলেও দেখেননি নিজে, কিন্তু বলার সময় সেটা গোপন রাখেন) তাদের চোখ বন্ধ করে আলিম ভেবে বসে। কিন্তু কোনও প্রতিষ্ঠানের অনার্স, মাস্টার্স বা পিএইচডি করা ব্যক্তি যে নিরেট মূর্খ হতে পারে, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাই হয়, এটা সাধারণ মানুষের বোঝার কথাও না। যদি না উপরোক্ত ব্যক্তিদের উদাহরণ চোখের সামনে না আসে। উল্লেখিত ব্যক্তিসহ আরো কিছু বিতর্কিত বক্তা সাধারণ মানুষকে বেশ কিছু প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।

প্রথম প্রশ্ন, বিভিন্ন ভালো প্রতিষ্ঠানে পড়ার পরও তাদের এরকম নিরেট মূর্খতার কারণ কী? উত্তর হচ্ছে, মদিনা বা আল আজহার বা দারুল উলুমসহ অন্যান্য বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের সিলেবাস সবার কথা চিন্তা করে তৈরি করা হয়। যাতে সবল দুর্বল সবাই `উতরে যেতে` পারে। এবং পরীক্ষায় দুর্নীতি, নিম্নমানের প্রশ্ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন কারণে অল্প কিছু গৎবাঁধা তথ্য বুঝে না বুঝে মুখস্ত করে এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেই খুব ভালো গ্রেড নিয়ে অনার্স, এমনকি মাস্টার্স করা সম্ভব। এবং এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবগুলোতেই পিএইচডি করার জন্যও আলিম হওয়া শর্ত না, কিছু বই পড়তে পারা আর ইনফর্মেশন একত্র করতে পারাই শর্ত। ইনফরমেশন ব্যবহার করে কোনো প্রডাক্টিভ কাজও করা লাগবে না।

আমাদের বাংলাদেশের পিএইচডি আলিমদের কয়জনের পিএইচডির গবেষণার বিষয় আমরা জানি? এমতাবস্থায় সবার মাঝেই নিজেদের প্রতিষ্ঠান ও ব্যাকগ্রাউন্ডকে উঁচু করে দেখানোর যে প্রতিযোগিতা কাজ করে তার কারণে আমরা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাজুয়েশনকে বিরাট কিছু ভেবে বসি। কিন্তু আদতে কোনো আলিম প্রতিষ্ঠানের কারণে আলিম হন না, সিলেবাসের তোয়াক্কা না করে নিজের তীব্র পিপাসা নিয়ে জ্ঞান সমুদ্রে অবগাহন না করলে কেউই কখনও আলিম হননি, হন না। আমাদের তথাকথিত আলিমদের প্রায় কেউই সেই অর্থে নিছক গ্রাজুয়েট ছাড়া আর কিচ্ছু না। ইলমকে নিজের সবটুকু দিয়ে না দিলে ইলমের কণাও কারো কাছে ধরা দেয় না। একারণেই আলিম ভেবে যাদের উপরে তোলা হয়েছিল, তাদের অনেকেরই হাটে হাঁড়ি ভেঙে গেছে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন, উনাদের আপত্তিকর ও ভুল বক্তব্যে আমাদের প্রতিক্রয়া কী হওয়া উচিত? জবাব হচ্ছে, স্পেডকে স্পেড বলার সৎসাহস থাকতে হবে। মুসলিম হিসেবে সুধারণা পাওয়ার অধিকার সবারই আছে। আমরা ধারণা করবো যে, তারা আল্লাহওয়ালা লোক, ধার্মিক। কিন্তু যারা আলিম না তাদের জোর করে আলিম প্রমাণ করা মানে প্রকৃত আলিমদের খাটো করা। পুরো পৃথিবীতেই প্রকৃত আলিমের সংখ্যা খুব হাতেগোণা। এই এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার পাঁচশো সত্তর বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে আদৌ কোনও আলিম নাইবা থাকতে পারে, না থাকলে অবাক হবার কিছুই নেই। কিন্তু যারা বলে যে আলিমরাও মানুষ, তাদেরও ভুল হতে পারে (অর্থাৎ উল্লেখিত ব্যক্তিরা তাদের হাজারটা আপত্তিকর কথার পরেও এগুলো নিছক মানবিক ভুল, তারা আলিম ছিলেন, আলিমই থাকবেন) তাদের বোঝা উচিত, ভুল আর মূর্খতার মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে।

হাদিস কোটেশনে ভুল করতে পারেন, হুকুম ডিরাইভ করার ক্ষেত্রেও ছোট পরিসরে ভুল হয়ে যেতে পারে, কিন্তু করোনার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মসজিদ বন্ধের মতো সিম্পল বিষয় যাদের মাথায় ঢোকে না বা বহু চেষ্টাতেও একটা যথাযথ ফতোয়া বের হয় না, তাদের ব্যাপারটা ভুলের চেয়ে অনেক উপরে। তাদের ইসলামের বুঝের ভয়াবহ ঘাটতি স্পষ্ট দিনের আলোর মতোই।

প্রথম কাজ হলো, তাদের আলিম বলা ছাড়তে হবে। আমি শুধু উপরের ব্যক্তিদের কথা বলছি না, সাধারণভাবে আরো অনেকেই এর মধ্যে পড়ে। তাদের প্রতি সুধারণা রাখতে হবে যে, তারা ধার্মিক, আর এ কারণেই না জেনে, ইলম ছাড়া ইসলামের ব্যাপারে কথা বলার কারণে তাদের প্রতি কঠোর হতে হবে। হাসাহাসি, উপহাস ও তিরস্কার পাওয়ার তারাই সবচেয়ে বেশি যোগ্য। মূর্খতার কারণে নয়, কেননা আমরা কেউই তাদের চেয়ে অনেক বড় কিছু হয়ে যাইনি, বরং এই কারণে যে, উনারা যে কারণেই হোক নিজেদের কিছু একটা মনে করছে, এবং ইসলামের ব্যাপারে নিজেদের মুখটা বন্ধ রাখতে পারছে না। ইসলামকে অপমান করছে।

আমাদের বাংলাদেশে কোনো গ্রহণযোগ্য আলিম পাওয়া না গেলে হায় হায় করার কিছু নাই। যেখানে আছে, সেখান থেকেই জ্ঞান নিতে হবে। ইলম নিয়ে আত্মসমালোচনার পরিবর্তে আত্মতৃপ্তি আর আত্মগরিমাই আমাদের জাতিগত ধ্বংসের মূল কারণ।