আসাদুজ্জামান সবুজের গল্প ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ১৪, ২০২১

আজ ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। আমার কাছে দিনটি খুবই আনন্দের। এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম। শুধু আমি নই, আমার সহপাঠী, বিদ্যালয় শিক্ষক ও অভিভাবকসহ সবাই। অবশ্য বিশেষ এক কারণ আছে। সেকথা পরে বলি। আমার নাম আলামিন নেওয়াজি। আমার বন্ধু-বান্ধবদের নাম তাদের বাবা-মার রাখা। সেদিক থেকে আমার বাবা-মা সত্যি হতভাগা। নিজেদের একমাত্র সন্তানের নাম ইচ্ছে অনুযায়ী রাখতে পারেনি। আমার নাম রেখেছেন আমার বাবার বাবা সাইদ নেওয়াজি। নেওয়াজি পরিবারের সবকিছু তার কথায় চলে। শুধু নেওয়াজি পরিবার নয়, রহিতপুরের সকল ভালো-মন্দ সিদ্ধান্ত তিনি নিয়ে থাকেন। তার ওপরে কেউ কথাও বলে না। সাইদ নেওয়াজির পোষা কিছু লোক ছাড়া বাকিরা তাকে পছন্দ করে না। তবে জোর গলায় তা কেউ কিছু বলেও না।

নেওয়াজিকে সবাই ভয় পায়। নেওয়াজির অনেক ক্ষমতা। কেউ তার বিরুদ্ধে বললে তার নিস্তার নেই। রেগে গেলে প্রচণ্ড বদমেজাজি ও ভয়ানক তার চেহারা। আমাদের গ্রামের একমাত্র হাই স্কুলের নাম রহিতপুর উচ্চ বিদ্যালয়। আমি এই বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। আমাদের বিদ্যালয় অন্য আট-দশটা বিদ্যালয় থেকে অন্যরকম। অন্যরকম বলার কারণ এই বিদ্যালয় শুরু থেকে আজ অব্দি কোনো বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়নি। বিদ্যালয়ের সবার ইচ্ছে ও আগ্রহ থাকলেও কোনো এক অজানা কারণে তা হয়নি। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চারও যে গুরুত্ব আছে, তা এখানে মূল্যহীন। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা হাজার হবে। প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না, অন্ধকারের পর আলো আসেই।

এই বছর আমাদের বিদ্যালয়ে একজন গণিত শিক্ষক আসেন। নাম তার আনিসুর রহমান। বাংলার শিক্ষিকা মুনমুন আরা ম্যাডামের সাথে প্রথম প্রথম না মিললেও এখন বেশ বন্ধুত্ব। আনিস স্যার ও মুনমুন ম্যাডাম দুজনেই আমাদের প্রিয় ও পছন্দের। আনিস স্যার আসার পর আমাদের বেশ পরির্তন হয়। তিনি আমাদের ভেতরকার কথা বুঝে যান। আনিস স্যার আর মুনমুন ম্যাডামের সহযোগিতায় পুরো স্কুলের চিত্র পাল্টে যায়। আমাদের এখন পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা, গল্প, কবিতা, নাচ-গান চর্চা সব হয়। আমাদের সবাইকে নিয়ে আনিস স্যার ও মুনমুন ম্যাডাম হেড স্যারের কাছে এই বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু আমাদের স্কুলের হেড স্যার জামাল উদ্দিন স্যার আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

তিনি বলেন,এই প্রস্তাব কোনোভাবেই গ্রহণ যোগ্য নয়। আমাদের স্কুলের গভানিং বোর্ডের সম্মানিত সভাপতি সাইদ নেওয়াজি সাহেব। তিনি এসব একদম পছন্দ করেন না। আমার বিশ্বাস তিনি রাজি হবেন না। কাজেই এই প্রস্তাব উনার কাছে নিয়ে যাওয়া হবে বোকামি। এতে তিনি রেগে যেতে পারেন, যা আমাদের জন্য শুভকর হবে না।

সবাই চুপ মেরে যান।
স্যার, আমি উনাকে রাজি করাবো।
সবাই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে।
আমি রাজি করবো স্যার।
হেড স্যার আমার কথায় হাসতে থাকেন। আর বলেন, ঠিক আছে, তুমি রাজি করালে হবে, না হলে হবে না। এবার তোমরা ক্লাসে যাও, আপনারা দুজন বসুন।

হেড স্যারের ধারণা, আমি রাজি করাতে পারবো না। স্যারের কথার যুক্তি আছে। কারণ সাইদ নেওয়াজি কারও কথা শোনেও না, বোঝেও না। সময় ও কাল ভেদে মানুষ বদলায়। আজ অনেকদিন পর সাইদ নেওয়াজির বৈঠকখানায় যাই। সালাম দেই, তিনি সালাম গ্রহণ করে বলেন, তুমি!
সচরাচর আমি উনার সামনে আসি না। আজ যেহেতু এসেছি তার মানে কোনো বিশেষ কাজেই এসেছি, এটা তিনি বুঝে ফেলেছেন।
আমাদের স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। আর আমি সেখানে অংশগ্রহণ করবো। আমার করার কথা ছিল না। আমার সহপাঠীরা বলেছে আমি অংশগ্রহণ করলে হেরে যাব। আমি তাদের দেখিয়ে দিতে চাই, আমি সাইদ নেওয়াজির নাতি আলামিন নেওয়াজি। কখনোও হারে না। কিন্তু হেড স্যার না করে দিয়েছেন। স্যার বলেছেন, আপনি এসব পছন্দ করেন না। তাই অনুষ্ঠান হবে না, আর আমারও প্রথমবারের মতো হেরে যেতে হবে। ঠিক আছে আসি।

দাঁড়াও, অনুষ্ঠান হবে। আর তুমি অংশগ্রহণ করবে ও বিজয়ী হবে। একটা কথা সব সময় মনে রাখবে, সাইদ নেওয়াজির নাতি হারে না, হারায়।
ধন্যবাদ, আমি অবশ্যই বিজয়ী হবো। আসসালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুমা সালাম।

মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি আমি। টেলিভিশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ দেখেছি। স্বাধীন বাংলা বেতারের কালজয়ী গানগুলো শুনেছি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক জাফর ইকবাল স্যারের আমার বন্ধু রাশেদ উপন্যাস পড়েছি যতবার ততবার কেঁদে উঠেছি। বীরাঙ্গনাদের আত্মকথা, হুমায়ূন আহমেদ স্যারের ছবি `আগুনের পরশমণি’ দেখেছি। এতকিছুর পরও মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার ও আলবদরদের অত্যাচারের কথা ভুলতে পারি না। স্বাধীনতার পরাধীনতা শক্তি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারসহ হত্যা করে স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছে।

রাজাকার ও আলবদরদের গাড়িতে লাল-সবুজ পতাকা উড়েছে। বুদ্ধি জ্ঞান হবার পর আরোও ছোট থাকতে সাইদ নেওয়াজি সাহেবকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম রাজাকার কি? কারা ছিলেন? তিনি আমাকে এমন বকা দিয়েছিলেন তা আজও ভুলিনি। আরোও বলেছিলেন, দিন দিন তুমি বেয়াদব হয়ে যাচ্ছ। আর কখনো যেন এসব বাজে কথা তোমার মুখে না শুনি। মন দিয়ে লেখাপড়া করো। সেদিন থেকে মনের ভিতর জিদ ঢুকে যায়। কারণ মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস আমার কাছে ভুলবার নয়। মুক্তিযুদ্ধে সকল শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

বিজয় দিবসের প্রথম পর্বের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে দুপুরের সময়। বিকেলে দ্বিতীয় পর্ব ও পুরষ্কার বিতরণী। পুরস্কার প্রদান করবেন স্কুলের গভানিং বোর্ডের সম্মানিত সভাপতি জনাব সাইদ নেওয়াজি। সাইদ নেওয়াজি আগেই বলে রেখেছেন উনার নাতি যেন বিজয়ী হয়। যদিও তিনি জানেন না, উনার নাতি কোন বিভাগে অংশগ্রহণ করেছে। করতে চানও না। উনার এক কথা আলামিন নেওয়াজি বিজয়ী হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি জনাব সাইদ নেওয়াজি আসেন। বেলুন ও সাদা পায়রা উড়ান। নিজ হাতে স্কুলে নতুন লাল-সবুজ জাতীয় পতাকা টানিয়ে দেন। সবাই সেদিকে তাকিয়ে থাকে। হাতে তালি দেয়। আমি মাটিতে থুথু ফেলি।

প্রধান অতিথি আসন গ্রহণ করেন, মঞ্চে উনার ডাক আসলে তিনি শুভেচ্ছা বক্তৃতা দেন। এখন তিনি পুরষ্কার বিতরণ করবেন। একে একে সবার হাতে পুরস্কার তুলে দেন। শেষ বিভাগের পুরস্কার বিতরণী `যেমন খুশি তেমন সাজো’ বিজয়ীর হাতে সম্মানিত সভাপতি জনাব সাইদ নেওয়াজি পুরষ্কার তুলে দিবেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালক `যেমন খুশি তেমন সাজো’ বিভাগের বিজয়ীর নাম ঘোষণা করে। আমাদের আজকের `যেমন খুশি তেমন সাজো’ রাজাকার সেজে বিজয়ী হয়েছেন আলামিন নেওয়াজি। সবাই হাততালি দেয়, তবে রাজাকার কথাটা শুনে সাইদ নেওয়াজি অবাক হয়। তিনিও হাততালি দিয়ে সায় দিলেও তার চোখেমুখে রাগ।

তিনি আলামিন নেওয়াজির হাতে পুরস্কার তুলে দিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে যায়। মাইক্রোফোনে, জনাব সাইদ নেওয়াজি সাহেব এত তারা কিসের? দাঁড়ান! আপনাকে কিছু বলার ছিল। যা কখনো বলিনি, আজ সবার সামনে বলবো। উপস্থিত সবাই আপনাদের বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা। `যেমন খুশি তেমন সাজো’ আমি রাজাকার সেজেছি। যার পুরস্কার আমার হাতে। আমি জানি এই পুরস্কার আমি পায়নি। এটা আপনাদের গভানিং বোর্ডের সম্মানিত সভাপতি সাইদ নেওয়াজি সাহেব জোর করে আদায় করিয়েছেন। যেমন তিনি সবকিছু করেন। যাই হোক, আমি বলছি যা সেজে আমি পুরস্কার পেলাম সেই রাজাকারকে আমি ঘৃণা করি।

৭১ সালে যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকাররা যে অপরাধ করেছে তা ভুলবার নয়। এবার একটু অন্য কথা বলি, আমি আলামিন নেওয়াজি একজন রাজাকের নাতি। হ্যাঁ। আপনাদের সবার গভানিং বোর্ডের সম্মানিত সভাপতি জনাব সাইদ নেওয়াজি একজন রাজাকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীনতার বিরোধী ছিলেন। আর একজন রাজাকারের নাতি হিসেবে তা আমাকে প্রতিনিয়ত ব্যথিত করে। আর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই অপমান আর লজ্জা আমাকে বহন করতে হবে। বলতে বলতে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। শেষে একটা কথা বলি, আমি সকল রাজাকারকে ঘৃণা করি এবং দেশের সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবি করি। জয় বাংলা।