ইফতেখার সিফাতের কলাম ‘ইসলাম ও সেকুলারিজমের দ্বন্দ্ব’

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৫, ২০২০

মুসলমানদের জন্য পার্থিব ও ধর্মীয় জীবন বলে কোনো বিভাজন নেই। কুরআন ও সুন্নাহতে পার্থিব জীবনের সাথে যে বিভাজন এসেছে, সেটা হলো পরকালীন জীবন। পার্থিব জীবন পুরোটাই দ্বীনের জন্য। আর পরকালের জীবন হলো সেটার হিসেবের জন্য। আল্লাহর শরিয়তের বিধানগত বিন্যাসের জন্য মানবজীবনে বিভাজন আসতে পারে। কিন্তু দ্বীনের বিধান থেকে মুক্তি লাভের জন্য মানবজীবনের যেকোনো বিভাজনই সেকুলারিজমের অংশ।

আমাদের মুসলিম সমাজে এমন বহুল প্রচলিত একটি বিভাজন হলো, পেশাগত জীবন। অনেক মুসলিমই তার পেশাগত জীবনকে দ্বীনের প্রভাব থেকে মুক্ত বলে বিশ্বাস করে। ফলে দেখা যায়, কোনো কাজকে ব্যক্তিগতভাবে কিংবা সত্তাগতভাবে হারাম মনে করলেও পেশা হিসেবে বৈধ মনে করছে। এটা মুসলিম জীবনে সেকুলারিজমেরই প্রভাব। মিডিয়া ও বিনোদন জগতের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই বিভাজন অধিক দেখা যায়।

অনেক সাধারণ মুসলিমের মুখেও এমন কথাবার্তা শোনা যায়। তবে মিডিয়া ও বিনোদন জগতে এর চর্চা অধিক সুস্পষ্ট এবং ভয়ংকর। অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী ও ক্রিকেটারসহ হারাম ক্যারিয়ারিস্ট মুসলিম ব্যক্তিগতভাবে নামাজ-রোজা পালন করে। কিন্তু পেশা হিসেবে সুস্পষ্ট হারাম কাজগুলোকেও বৈধ মনে করছে। এমনকি অনেকে রোজা রেখে শুটিং করার মতো নজিরও স্থাপন করেছে। এজন্যই দেখা যায়, নিজেদের হারাম ক্যারিয়ারে অগ্রগতি লাভের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছে, দর্শকদের থেকে দোয়া চাচ্ছে। সুস্পষ্ট হারাম কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রেও আলহামদুলিল্লাহ, ইনশাআল্লাহ বলছে। এমন আচরণ সেকুলারিজমেরই প্রভাব।

ভয়াবহ ব্যাপার হলো, কোনো হারাম কাজকে হারাম হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে সম্পাদন করলে এতে কবিরা গোনাহ হয়। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে হারামকৃত বিষয়কে বৈধ বলে বিশ্বাস করলে সেটা আল্লাহর সাথে বিদ্রোহের শামিল। তখন এই হারাম কাজটা কুফুরে পৌঁছে যায়। এরকম ব্যক্তি কাফেরে পরিণত হয়ে যায় অনেক সময়। আমাদের সমাজে এমন আরো অনেক কর্ম আছে যেগুলো সুস্পষ্ট হারাম এবং মুসলিমরা সেগুলোকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করছে সেই একই সেকুলারীয় যুক্তিতে যে, এটা আমার ধর্মীয় জীবন নয়; বরং পেশাগত জীবন। আমাদের ভালো করে বুঝে নিতে হবে, জীবনের যেকোনো অংশে দ্বীনের প্রভাবকে অস্বীকার করা কুফুর। দ্বীনের কর্তৃত্বকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করা বান্দার তাওহিদুল উলূহিয়্যাতকে বাতিল করে দেয়। ইসলামের সাথে সেকুলারিজমের মূল সংঘর্ষটা এখানেই।

সেকুলারিজমে আল্লাহর রুবুবিয়্যাতের অস্বীকৃতিটা গৌণ বিষয়। কোনো সেকুলার এটা করতেও পারে, আবার নাও করতে পারে। কিন্তু সকল সেকুলারই আল্লাহর উলুহিয়্যাতকে অস্বীকার করে। মক্কার কাফেররাও আল্লাহর রুবুবিয়্যাতকে স্বীকার করত। অস্বীকার করত তাঁর উলুহিয়্যাতকে। তারা বিশ্বাস করত আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা, তিনিই জগতের সব কিছুর পরিচালনাকারী। তাদের সমস্যা ছিল আল্লাহর ইবাদাত নিয়ে। তাঁর বিধানের কর্তৃত্ব নিয়ে। সুতরাং সেকুলারিজম মানে ধর্ম কিংবা আল্লাহকে অস্বীকার করা না, ধর্ম ও আল্লাহর কর্তৃত্বকে অস্বীকার করা। যেটা মূলতে ধর্মকে ত্যাগ করারই নামান্তর।

সুতরাং যেসব মুসলিম ভাইবোনেরা পেশাগত জীবনকে ধর্মীয় জীবন থেকে পৃথক করে দেখেন এবং পেশাগত জীবনকে দ্বীনের কর্তৃত্বশূন্য মনে করেন, তাদের জন্য বিষয়টা ভাবার অনুরোধ রইল। ফলাফলের দিক থেকে বিষয়টা অত্যন্ত ভয়াবহ। এই পৃথকীকরণের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি কুফুরিতে লিপ্ত হয়ে যায়। আল্লাহর সাথে বিদ্রোহ করে সুস্পষ্ট হারামকে হালাল বিশ্বাস করে বসে। যেটা নিশ্চিতভাবেই একজন মুমিনের ঈমানকে ভঙ্গ করে দেয়। আমাদের উচিত নিজেদের দ্বীনের ব্যাপারে সিরিয়াস হওয়া। আল্লাহর দেয়া শরীয়ত সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞান লাভ করা। এমন সেকুলারীয় যুক্তির আলোকে যারা নিজেদের জীবনকে অন্ধকারে ফেলে রেখেছেন তাদের সকলেই প্রায় দ্বীনের ব্যাপারে উদাসীন এবং অজ্ঞ। জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন জটিল ইস্যুর পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে দ্বীনের ব্যাপারে উদাসীনতা ও অজ্ঞতাই এর জন্য দায়ী।

আপনার পেশা যদি সরাসরি কোনো হারাম কর্ম কিংবা হারাম কর্মের সহযোগী কোনো বিষয় হয়, ইসলাম আপনাকে এমন পেশা অবলম্বনের অনুমোদন দেয় না। হালাল পেশা গ্রহণ করা একজন মুমিনের জন্য ফরজ বিধান। চাই সেই পেশা যত ছোটই হোক না কেন। একটা হারাম পেশা এমনিতেই মুমিনের পুরো জীবনকে হারামে ভরপুর করে দেয়। তার খাবার-দাবার, বাসস্থান, স্ত্রী, সন্তানাদি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে হারামের বিষবাষ্প। তার উপর যদি থাকে আলোচিত সেকুলারীয় যুক্তি, তাহলে তো সে কুফুরের সীমায় পদার্পণ করে ফেলে। আল্লাহর পানাহ!