
উইলিয়াম শেক্সপিয়রের একটি প্রেমের চিঠি
ভাষান্তর: হৃদ্য আবদুহুপ্রকাশিত : নভেম্বর ০৯, ২০২২
১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২৩ এপ্রিল স্ট্র্যাটফোর্ড অন-অ্যাভনে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের জন্ম। পিতা জন শেক্সপিয়র ছিলেন পেইন্টার। মা মেরি আরডেন ধনী কৃষক পরিবারের সন্তান। শেক্সপিয়রকে ইংরেজি ভাষার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক এবং বিশ্বের প্রধান নাট্যকারদের একজন বলা হয়। তিনি ইংল্যান্ডের জাতীয় কবি। তার লেখা যেসব রচনা পাওয়া গেছে সেগুলো হচ্ছে: ৩৯টি নাটক, ১৫৪টি সনেট, তিনটি দীর্ঘ আখ্যানকবিতা এবং কয়েকটি কবিতা। ১৮ বছর বয়সে শেক্সপিয়র বিয়ে করেন ২৬ বছর বয়সী অ্যানি হ্যাথাওয়েকে। বিয়ের পরপরই তিনি স্ট্র্যাটফোর্ড ত্যাগ করেন। স্ত্রীর ভালোবাসা সেভাবে কখনো তিনি পাননি। তাই কয়েক বছর পর তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। দাম্পত্যজীবনের অশান্তি সারা জীবন বহন করে বেড়িয়েছেন তিনি। সুন্দরের প্রতি তার হৃদয় ছিল তৃষ্ণাকাতর। তাই কবিতার ভেতর তিনি যতবার প্রেমিকার সাথে মিলিত হতে চেয়েছেন ততবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন। ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি নাট্যজগৎ ছেড়ে স্ট্র্যাটফোর্ডে ফিরে যান। তিন বছর পর সেখানেই তিনি মারা যান। অ্যানি হ্যাথাওয়েকে লেখা শেক্সপিয়রের একটি চিঠি:
প্রিয়তমেসু,
তোমাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাই। আশা করি, ভালোই আছ। হতভাগ্য কারো কথা ভেবে মনখারাপ করার মতো দুর্ভাগ্য তোমার হয়নি তো? তোমাকে পাবার অধিকার আমার আছে কিনা, জানি না। শুধু এটুকু ভেবেই আমার আনন্দ যে, একদিন তোমাকে আমার বলে ভেবেছিলাম। সেদিন হয়তো তুমি আমাকে আত্মদান করেছিলে। অন্তত আমি সে রকমই ভেবেছিলাম। এতেই আমার পূর্ণতা।
আমার ছন্নছাড়া জীবনে তোমার স্মৃতিই আমার একমাত্র সম্বল। বিচিত্র পরিবেশ, বিচিত্র নরনারী, নটনটি, নাটক ও অভিনয় নিয়ে জীবনের এই যে অনুভূতি, এ তো অভিনব। জানি না, সংসারজীবন এরচেয়ে আনন্দের কিনা। ঘর আমি বাঁধতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ঘর আমাকে বাঁধতে পারল না। বেশ আছি। তবে মাঝে মাঝে মন ভারি হয়ে ওঠে। অভিনয় দেখতে দেখতে গোটা জীবনটাকেই অভিনয় বলে মনে হয়। নায়ক-নায়িকার প্রেমের অভিনয় দেখে জীবনকে মধুময় মনে হয়। কিন্তু পরমুহূর্তে আড়ালের নগ্নতা আমার সব স্বপ্ন ভেঙেচুরে দিয়ে যায়। আমার মনের আড়ালে সব অভিনয় আজ শেষ হয়েছে। তাতে কোনো মাধুর্য নেই। মাদকতা নেই।
উইলিয়াম আজ আর নাট্যসম্প্রদায়ের বালক পরিচালক নয়, সে আজ সম্প্রদায়ের পরিচালক। মনে আশা আছে, একদিন সে হবে নাট্যকার। তার নাটক অভিনীত হবে, দেশে দেশে দিগদিগন্তে ছড়িয়ে পড়বে তার খ্যাতি। প্রেমের অভিনয় ও প্রেমিক-প্রেমিকার চরিত্র চিত্রণ করেই কাটবে তার জীবন। বাস্তবের সঙ্গে তার কোনো মিল থাকবে না। অ্যানি হ্যাথাওয়ে থাকবে অনেক দূরে।
বাইরের দৈন্য আজ আমার নেই। কিন্তু অন্তরে আমি বড়ই কাঙাল। অন্তরের সকল ঐশ^র্য তুমি কেড়ে নিয়েছো। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, তোমাকে অভিশাপ দিই। পারি না। কারণ, শুধু একদিন তুমি আমার হতে চেয়েছিলে। যা পেতে চেয়েছিলাম, তা পাইনি। কেন পাইনি, জানি না। কে যে দায়ী, তা বলি ক্যামনে! দায়ী নিয়তি। আমার ‘চাওয়া’ তোমার হৃদয়ে জায়গা পায়নি। আর তোমার ‘পাওয়া’ও তোমার মনকে অভিভূত করেনি। চাওয়া-পাওয়ার এই যে বিরুদ্ধ অবস্থান, এর নামই নিয়তি। ভাবি, দুঃখ করব না। কিন্তু পেরে উঠি না। দুঃখ আমাকে করতেই হয়, এও আমার ভাগ্য। দুঃখ পাওয়া মানুষের একান্ত নিজস্ব অধিকার। আর সেজন্য আরেকজনকে দোষ দেয়াও তার স্বভাব।
কী যে লিখছি, নিজেই বুঝতে পারছি না। তুমিও বুঝবে কিনা, জানি না। তবুও লিখছি। কারণ, মনের তৃপ্তি। সব ভুলে যেও। কোনো দিন কোনো কিশোর তোমার ওপর কর্তৃত্ব করতে চেয়েছিল, এ কথা মনে ঠাঁই দিও না। ডাক পড়েছে, এবার থিয়েটারে যেতে হবে। আজ বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হোক। আর কোনোদিন তোমার কাছে কোনো কিছু আমি আশা করব না। কোথায় কিভাবে থাকব তা বলতে পারি না। স্ট্র্যাটফোর্টে ফিরব কিনা, কে জানে! মিলন আমাদের হয়নি। কিন্তু তোমার সঙ্গে যে একদিন আমার বাইরের মিলনের অনুষ্ঠান হয়েছিল, তা লোকজন মনে রাখবে। মানুষের ইতিহাসে হয়তো আমার নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে তোমার নাম। একথা ভাবতে যেন কী রকম মনে হয়। তবু মনকে সান্ত¡না দিই।