কাজী জহিরুল ইসলাম

কাজী জহিরুল ইসলাম

কাজী জহিরুল ইসলামের আত্মগদ্য ‘আমার বিচিত্র জীবন’

পর্ব ৩১

প্রকাশিত : আগস্ট ১৪, ২০২৫

বছর দুয়েক আগের একটি ঘটনা বলি। গল্পকার সাইদুর রহমান কামরুজ শুধু জসীম উদদীন পরিষদের একজনই নন, তিনি নিজ গুণেই হয়ে উঠেছেন আমার অতি প্রিয় একজন বড় ভাই।

একদিন আমার খুব মন খারাপ। কারণ শামসুদ্দিনকে প্রতি মাসে যে ৫০০ টাকা করে দেই, সেই তারিখ পার হয়ে গেছে। যে কোনো দিন তিনি বাসায় এসে হানা দিতে পারেন। শুধু মন খারাপই নয়, খুব ভয়ে ভয়ে আছি। পাওনাদার বাসায় আসবে এটা খুব অপমানজনক একটা ব্যাপার।

টিউশনির টাকা পেতে মাঝে-মধ্যেই বিলম্ব হয়। এ-মাসে অস্বাভাবিক বিলম্ব হচ্ছে। আমি হাঁটতে হাঁটতে কামরুজ ভাইয়ের বাসায় যাই। বুলবুলি ভাবী একজন অসাধারণ নারী। কামরুজ ভাই সারাদিন ঘরে বসে রাজ্যের লোকজন নিয়ে তাশ খেলেন, ভাবী হাসিমুখে সবাইকে দফায় দফায় চা বানিয়ে খাওয়ান।

আমরা মাঝে-মধ্যে কামরুজ ভাইয়ের ওপর বিরক্ত হয়ে বলি, ভাবী, কিছু কন না ক্যা? সারাদিন খালি তাশ খেলে, লেখালেখিও তো প্রায় ছেড়ে দিয়েছে।

ভাবী একটা হাসি দিয়ে বলেন, কিছু কৈলে তো ক্লাবে গিয়া খেলবে, এর চেয়ে হেইয়াই ভালো যা করার বাসায় বৈয়া করে।

দফায় দফায় লোক আসছে, ভাবীর চুলো জ্বলছে, কাপের পর কাপ চা উড়ে যাচ্ছে, দোকান থেকে পুরি আসছে, সিঙ্গারা, সমুচা আসছে। জাগরণী সংসদের হাবীব ভাই, সাচ্চা ভাই, কাজিম কামাল, তিতাসের ফজলুল হক এরা মোটামুটি নিয়মিত, বিকেলে গেলে এই ক`জনকে পাওয়া যাবেই। এছাড়া আরো নানান রকমের অনিয়মিত অতিথি আসছে, যাচ্ছে। বাড্ডা আলাতুন নেসা স্কুলের শিক্ষকরা আসেন। ঘরটি ছোটো কিন্তু সেই ঘরে অফুরন্ত প্রাণ-প্রাচুর্য, ফলে, ঘরে জায়গা না পেলেও দরোজায়, উঠোনে লোক বসে থাকে, দাঁড়িয়ে থাকে।

সেদিন বিকেলে আমি গিয়ে দেখি দুই তরুণ সেখানে বসা। একজন বুলবুলি ভাবীর ছোটো ভাই রাব্বানী, অন্যজন রাব্বানীর বন্ধু রাইসুদ্দিন। আমি চুপচাপ বসে আছি। কামরুজ ভাই বলেন, জহির চুপচাপ ক্যান, কি হইছে?

আমি তখন বিষয়টা খুলে বলি। তিনি খুব সিরিয়াসলি আমার দিকে তাকান। কপালে একটা ভাঁজ ফেলে বলেন, টাকা দেওয়ার ডেট কবে?

আমি বলি, সেটা আরো দুদিন আগেই পার হয়ে গেছে।
এখন কি তোমার হাতে টাকাটা আছে?
কিছু কম আছে।
কত কম আছে?
দুইশো।
ঠিক আছে, ধরো, দুইশো টাকা তুমি পেয়ে গেছ। এখন অন্য কথা বলো। নতুন কোনো কবিতা লেখছো?
জি লেখছি।
শোনাও।
সঙ্গে নাই তো। অনেক বড় একটা কবিতা লেখছি।
তখন দুই তরুণের একজন, রাইসুদ্দিন, আগ্রহী হয়।
তুমি কবিতা লেখো?
প্রশ্নটা শুনে আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।

বুলবুলি ভাবী হয়ত অনুমান করেছেন, রাইসুর প্রশ্ন করার ধরণে আমি কিছুটা  বিরক্ত হয়েছি। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ওকে একটা ধমক দিয়ে বলেন, এই রাইসু, বাদল তোমাগো সিনিয়র, কলেজে পড়ে, তোমরা এইবার মেট্রিক দিবা, ওরে বাদল ভাই ক`বা।

রাইসু একটা মন ভোলানো হাসি দিয়ে বলে, `তুমি` চলতে পারে।
ওর এই হাসি দেখে আমারও মনে হলো, হ্যাঁ,  নিশ্চয়ই, ওর সঙ্গে `তুমি` চলতে পারে।

কিছুক্ষণের মধ্যে সাচ্চা ভাই আসেন। কামরুজ ভাই সাচ্চা ভাইকে বলেন, সাচ্চা ভাই, দুইশো টেকা দেন তো।

সাচ্চা ভাই অবাক দৃষ্টিতে কামরুজ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি মিষ্টি করে হাসছেন। সাচ্চা ভাইয়ের এই হাসিটা চোখ বন্ধ করলে আমি এখনও দেখতে পাই। হাসার সময় তিনি নাকটাকে ফোলান। তখন বোঝা যায় না তিনি রাগ করছেন না কী দুষ্টুমি করছেন। সাচ্চা ভাই কোনো কথা না বলে পকেট থেকে দুটো ১০০ টাকার নোট বের করে কামরুজ ভাইয়ের দিকে বাড়ালে কামরুজ ভাই আমাকে বলেন, জহির, টাকাটা নেও তো।

আমি নোট দুটো নিয়ে কামরুজ ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে ধরি। তিনি বলেন, এই দুইশো টাকা তোমার। ধার দিলাম। যখন পারো ফেরত দিও।

রাইসুর সঙ্গে আমার একটা সখ্য গড়ে ওঠে। বেশ কয়েক দিন আমরা নিয়মিত দেখা করি। রামপুরা ব্রিজের রেলিঙের ওপর বসে পুরো বিকেল পার করে দেই। ও জসীম উদদীন পরিষদে আসতে শুরু করে। একদিন রাইসু আর আমি আবদুল মান্নান সৈয়দকে খুঁজতে বের হই। এইসব গল্প অন্য লেখায় লিখেছি।

রাইসু আমাকে বলে, অক্ষরবৃত্ত ছন্দ কী, আমারে শিখাও।

ওর মধ্যে শেখার একটা অদম্য আগ্রহ ছিল। তবে কারো সঙ্গেই ও খুব বেশিদিন সম্পর্ক রাখত না। হয়ত অল্প সময়েই ওর যেটুকু নেবার তা নিয়ে নিতে পারত, তারপর খুঁজত নতুন গন্তব্য। ছোটোবেলা থেকেই রাইসু অকপট ছিল। ওর মধ্যে জড়তা জিনিসটা একেবারেই ছিল না।

আমি যে দীর্ঘ কবিতাটা লিখেছিলাম তার কিছু অংশ ওকে পড়ে শোনাই। কবিতার একটা লাইন, "খেলা করে বিশ্রামরত মস্তিস্কটা নিয়ে" ওর খুব ভালো লাগে। পুরো কবিতাটা ওর ভালো লাগেনি। যেটুকু ভালো লেগেছে তা যেমন অকপটে বলেছে, আবার যেটুকু ভালো লাগেনি তা বলতেও ওর মধ্যে কোনো দ্বিধা ছিল না। এই যে আমি কবিতা নিয়ে অকপটে মুখের ওপর ভালো-মন্দ বলে দিই, হয়ত এই বিষয়টি রাইসুর কাছ থেকেই শিখেছি।

মে মাসের এক শুক্রবার নজরুল জয়ন্তীর অনুষ্ঠান হবে অনু আপার বাসায়। বাড্ডা থেকে আমিনুল হক আনওয়ার, ডাক্তার জিয়াউদ্দিন, হেলাল মাহমুদ এবং আমি যাই। অনু আপার ড্রয়িংরুমে কার্পেটের ওপর চাদর বিছিয়ে মিলাদের মতো আয়োজন। নজরুলের ওপর কথা বলবেন অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম। আমি যতদূর মনে করতে পারি, সেটিই ছিল অনুপ্রাসের প্রথম কোনো আনুষ্ঠানিক আয়োজন এবং তাও পুরোপুরি ঘরোয়া।

একজন তরুণ খুব খাটাখাটি করছে। মার্কার দিয়ে কাগজে লেখা `অনুপ্রাস`, এইরকম একটি ব্যানার দেয়ালে লাগাচ্ছে, নজরুলের ছবি লাগাচ্ছে। ঘরটিকে অনুষ্ঠানের উপযোগী করে সাজাবার জন্য দারুণ খাটছে। তিনি বয়সে আমার চেয়ে কিছুটা বড় হলেও উচ্চতা কম থাকায় এবং শীর্ণ দেহের অধিকারী হওয়ায় আমার চেয়ে ছোটো কিংবা সমবয়সী লাগছে। তরুণের নাম অনিমেষ বড়াল। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, সম্ভবত তখন এম এ ক্লাসে পড়ছেন। তার সঙ্গে দারুণ একটা সখ্য গড়ে ওঠে। অনু আপার আম্মা জোবাইদা খানম থাকতেন মহাখালীতে, তিনিও কবিতা লিখতেন, অনিমেষ বড়ালও মহাখালীতে থাকতেন, সেই সুবাদে তাদের পরিচয়।

এরপর আমাদের আমন্ত্রণে অনিমেষ বড়াল নিয়মিত জসীম উদদীন পরিষদে আসতে শুরু করেন, এক পর্যায়ে তিনি পরিষদের সাহিত্য সচিবের পদও গ্রহণ করেন এবং তার সম্পাদনায় আমাদের সাহিত্য পত্রিকা ‘অথচ’র অনেকগুলো সংখ্যা বের হয়। অথচ ছিল জসীম উদদীন পরিষদের মাসিক সাহিত্য পত্রিকা।

অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে খুব গোছানো একটি বক্তৃতা করেন। তার সেই বক্তব্য নজরুলকে জানার এবং বোঝার একটি নতুন দরোজা খুলে দেয়। তিনি নজরুলের গান নিয়েও অনেক সারগর্ভ বক্তব্য দেন। সেদিন আরো দু`জন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়, একজন শেখ শামসুল হক, অন্যজন জাহাঙ্গীর হাবীব উল্লাহ। চলবে