কাজী বর্ণাঢ্যর গদ্য ‘ত্রাণকথা’

পর্ব ১

প্রকাশিত : জুন ২৬, ২০২২

তিন দিন ধরে দেখছি, ত্রাণ নিয়ে বিভিন্ন শিল্পপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা, বিভিন্ন এনজিও সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবীসহ সমাজের নানা শ্রেণির মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। আমার বাড়ির পাশেই নৌকোর ঘাট। ফলে এ দৃশ্যটি আমার চোখ-কানকে এড়াতে পারে না কোনোভাবেই।

এসব নিয়ে আমার মনে কিছু কথা একা একাই আউড়ে যাই। আমার ভিতরে ঘুরপাক খাচ্ছে নানাবিধ প্রশ্ন এবং এসব সময়োপযোগী জটিল প্রশ্নগুলোর সহজ উত্তরও।

প্রথম কথা হলো, ট্রাক বোঝাই করা এই ত্রাণ আপনারা কার জন্য নিয়ে আসছেন? যার জন্য আপনার বাণিজ্যিক মন মানবিক হয়ে উঠলো তার হাতে কি ঠিকঠাক আপনার সহায়তা পৌঁছে দিতে পারছেন?

দ্বিতীয় কথা, এই ত্রাণ তৎপরতায় আপনার উদ্দেশ্য কি? কোনো চাওয়া-পাওয়ার বাইরে একদমই হৃদয় নিঙড়ানো আবেগ ধরে রাখতে না পারায় সবকিছু ছেড়েছুড়ে বানভাসি মানুষের জন্য আপনার মানবিক সহায়তা? নাকি ভিতরে ভিতরে আরো কোনো গভীর উদ্দেশ্য আছে যা আপনি মুখে প্রকাশ করছেন না, চোখে প্রকাশ করছেন।

আমি যেখানে থাকি সেখানে আর বন্যা নেই। একদমই স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে মানুষ। কিন্তু বন্যার্তদের জন্য ট্রাক বোঝাই করে যে সাহায্য আসছে তা বন্যার্তদের মাঝে পৌঁছুবার আগেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। আপনারা ত্রাণদাতারা তৃপ্ত মনে ট্রাক নিয়ে চলে যাচ্ছেন যার যার ঠিকানায়। অথচ আপনার দেওয়া ত্রাণ তার ঠিকানা মতো পৌঁছতে পারেনি। কী নির্মম গোপন অবিচার!

প্রতিটি অঞ্চলেই কিছু না কিছু আলগা মাতব্বর থাকে। আপনার বিশুদ্ধ মনকে তারা আবেগাস্ত্র দিয়ে হত্যা করছে। আপনি টেরই পাচ্ছেন না। তারা নানান অযুহাত দিয়ে সুকৌশলে আপনার মহৎ উদ্যোগকে মুহূর্তেই রাজনৈতিক বানিয়ে ফেলছে। তারা বানভাসি মানুষের রিজিক বণ্টন করছে নিজের আয়ত্তের ভিতরে। অনেকেরই ধারণা, তারা সামনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। কিছুসংখ্যক লোক আছে যারা অযথাই প্রসংশা কুড়িয়ে এলাকায় নিজেদের প্রভাব বিস্তার করছে।

আমি যতদূর বুঝি, আপনার উদ্দেশ্য মহৎ, আপনি এক মহৎপ্রাণ। কিন্তু একবার কি ভেবে দেখবেন, আপনি যেখানে ত্রাণ দিচ্ছেন সেখানে বানের জোয়ারে ঘরবাড়ি ভাসতেছে কিনা! হ্যাঁ, মানুষের দারিদ্র্যতা আছে ঠিক। বানভাসি আর দরিদ্র দুটোকে যখন এক করে ফেলা হয় তখনই আসলে নানাবিধ বিপত্তির সৃষ্টি হয়।

আমি যেখানে আছি দু’চারদিন ধরে বানভাসি মানুষের তুলনায় তারা অনেক ভালো আছেন। ঘরে ঘরে ত্রাণের রমরমা অবস্থা। কেউ কেউ দু-চার পাঁচ বস্তা ত্রাণসামগ্রী সঞ্চয় করে রাখছেন। অথচ ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করে যারা দিন-রাত লড়াই করছেন তারা একবেলা খাবারের জন্য হাহাকার করছে, সন্তানকে একটা বিস্কিটের প্যাকেট কিনে দেওয়ার সামর্থ হারিয়ে নীরবে কাঁদে। আপনার ত্রাণ কি সেখানে পৌঁছাতে পারছেন?

না, পারছেন না। আর কখনো পারবেনও না। কারণ আপনাকে আবার ফিরতে হবে নিজ গৃহে, আপনার সময় সংক্ষিপ্ত তাই উদ্দেশ্যর সাথে, পরিকল্পনার সমন্বয় রাখতে আপনি ব্যার্থ। চলবে

লেখক: কবি