কোয়ারেন্টাইন থেকে ফ্যান চুরি এবং বাঙালির নীতিজ্ঞান

শিমুল বাশার

প্রকাশিত : মার্চ ২৩, ২০২০

আপনারা রাজধানীবাসী দেখেছেন, করোনার কথা শুনেই কিছু লোক আতঙ্কিত হয়ে কেমন স্বার্থপরের মতো কেনাকাটা করছে আর দোকানিরাও কেমন দফায় দফায় দাম বাড়াচ্ছে। এত স্যানিটাইজার, মাস্ক, সাবান বিক্রি হচ্ছে! কেউ কেউ তিন মাসের বাজারও একসাথে করে রাখছে। আমরা বাঙালিরাতো এত স্যানিটাইজার আগে কখনো কিনিনি। এত এত বাজারের পেছনে যে টাকাটা খরচ হচ্ছে তা নিশ্চয়ই মার্কেট থেকেই এসেছে। এ টাকার টানটা নিশ্চয়ই আজ বাদে কাল আপনার পকেটেই পড়বে। বেতনওতো বাড়েনি, তাই না? এমন অনেক কিছুরই উদাহরণ দেয়া সম্ভব। সরকারি ব্যবস্থা কি নেয়া হচ্ছে? গতানুগতিক সেই একই অভিযান! যেখানে কয়েকজন আমলা স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে দোকানদারের সাথে তর্কবিতর্কের মাধ্যমে নীতিজ্ঞান ফলাচ্ছে এরপর একটা জরিমানার অঙ্ক করবে। হাস্যকর! এরই নাম বাজার মনিটরিং। যে দেশে কোয়ারেন্টাইনের অবকাঠামো থেকে ফ্যান চুরি হয়, সেদেশে নীতিজ্ঞানের বেইজ নিয়ে করা এসব অভিযানে কতটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব, বলেন?

শহরের খেটে খাওয়া বা যারা দিন আনে দিন খায়, সেসব মানুষের দিকে এখনই তাকানো যাচ্ছে না। এ সংখ্যাটা কিন্তু নেহায়েতই কম নয়। মনে রাখতে হবে, এ রাজধানীতে শুধু রিকশা চালকই রয়েছে প্রায় ২০ লাখ। আর আমরা যারা মিডিয়া বা দালাল গোষ্ঠি যারা অন্যের মুনাফায় ভাগ বসাই, আমাদের কথা না-হয় বাদই দিলাম। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই, রাজধানীর কমিউনিটি সেন্টারগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। তাতে আপনার বিয়ে বন্ধ করার যদিও দরকার হচ্ছে না তবে বড় আয়োজন কিন্তু রাখতে পারছেন না। এতে ক্ষতিটা কী? ক্ষতি হচ্ছে, ফটোগ্রাফার মরছে, শাড়ি, গয়নার দোকানদার মরছে, ডেকোরেটররা মরছে, ভ্যানওয়ালা মরছে, গাড়ি যারা ভাড়া দেন তারা মরছে। হিসাব করে দেখেন, অনেক কিছু পেয়ে যাবেন। মোট কথা, সচল অর্থনীতির চেইন কিন্তু ছিঁড়ে যাচ্ছে।

চীনের একটি প্রতিবেদনে পড়লাম। সেখানে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের পরিকল্পনায় থাকা কম্পানিগুলো বড়জোড় ছয় মাস চলতে পারবে আর মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজগুলো তিন মাস। এমন চলতে থাকলে এক মাস পর থেকেই প্রডাকশন অফ হয়ে যাবে স্মল এন্টারপ্রাইজগুলোর। বিশ্বের জিডিপির ১৬ ভাগ যোগান দেয় এই চীন। অন্যদিকে চায়নিজরা যে পরিমান ভ্রমণ করে সেই টাকাইতো সারা বিশ্বের ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রির মূল ক্যাপিটাল, অন্যসব বাদ দিলাম। একের পর এক বিশ্বব্যাপী ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পর্যটন ও আকাশপথ বাণিজ্য কতটা নাজুক অবস্থায় আছে, তা নিশ্চয়ই অনুমান করা যায়। এছাড়া পৃথিবীব্যাপী লাখ লাখ কারখানার কাঁচামাল আসে ওই চীন থেকেই। প্রথমে ধারণা করা হচ্ছিল, চীনের ভাইরাস আমাদের দেশর জন্য আশীর্বাদ। কারণ তাদের অর্ডার বাতিল হলে সেখান থেকে কিছু কিছু আমরা ম্যানেজ করতে পারবো। বোঝেন অবস্থা!

রেমিটেন্স বাদ দিলে আমাদের দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় খাত আরএমজি, যেখান থেকে ৮৬ ভাগ রপ্তানি আয় হয়। সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের ক্রয়াদেশ এরই মধ্যে বাতিল কিংবা স্থগিত হয়েছে, এমন তথ্য পাচ্ছি। ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হওয়া এসব কারখানাতে শ্রমিক রয়েছে ১২ লাখেরও বেশি। প্রাইমার্কের মতো বড় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানও আছে এ তালিকায়। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো একের পর এক লকডাউন ঘোষণা করছে। বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করছে নামিদামি পোশাকের ব্র্যান্ডগুলোও। এ পরিস্থিতিতে ভোক্তা চাহিদায় ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বাজার চাহিদার এ পরিস্থিতিতে নতুন ক্রয়াদেশ দিচ্ছে না তারা শুধু তা-ই নয়, বাতিল ও স্থগিত করছে আগের দেয়া ক্রয়াদেশও।

করোনার প্রভাবে প্রথমে কাঁচামাল সরবরাহ সংকটে পড়তে হয়েছে আমাদের পোশাক খাতকে। কারণ দেশের তৈরি পোশাক খাতের ওভেন পণ্য তৈরির আনুমানিক ৬০ শতাংশ কাপড় চীন থেকে আমদানি হয়। আর নিট পণ্য তৈরির আনুমানিক ১৫-২০ শতাংশ কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি হয়। করোনা ভাইরাস হানা দেয়া চীন থেকে কাঁচামাল আসতে পারছিল না।

জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করলে COVID-19 এর প্রভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সঠিক প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্র হলো, সামাজিক দূরত্ব। যদিও বৈশ্বিক অর্থনীতির সুরক্ষার ক্ষেত্রে এটির ঠিক বিপরীতটাই বেশি প্রয়োজন। ভাইরাসে আক্রান্তের বেদনা আমাদের হয়তো খুব দ্রুত কেটে যাবে, কিন্তু বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বেদনা কাটাতে একটি দেশের পাশে আরেকটি দেশের ঘনিষ্ঠ হওয়াটাই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। যেমন হাতে টাকা না থাকলে কাছের মানুষটার কাছ থেকে ধার নেয়া যায় কিংবা সাহায্য চাওয়া যায়। সুতরাং নিবিড় যোগাযোগটাই দেশের জন্য বড় ঔষধ।

বেশিরভাগ আক্রান্ত দেশই তাদের অর্থনীতির সুরক্ষায় যে যার মতো পদক্ষেপ নিয়েছে। এমনকি দৈনিক ভিত্তিতেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কিছু দেশে। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) তাদের মার্চ মাসের প্রতিবেদনে চলতি বছরের জন্য বিশ্বের প্রায় সব অর্থনীতিতেই জিডিপির প্রকৃত প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস সবচেয়ে বেশি কমেছে চীনের। আগের পূর্বাভাসে ধারণা করা হচ্ছিল, এশিয়ার অর্থনৈতিক পরাশক্তির জিডিপিতে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। তবে নতুন পূর্বাভাসে ওইসিডি বলছে, এ হার ৪ দশমিক ৯ শতাংশের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। শুধু চীন নয়, ওইসিডির নতুন পূর্বাভাসে চলতি বছর গ্লোবাল ইকোনোমিতে প্রবৃদ্ধির পুর্বাভাস অনেক নেমে গেছে। করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন এবং একের পর এক ইউরোপসহ বিশ্বের বড় শহরগুলো লকডাউন হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেই পূর্বাভাস পরিষ্কার করে কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।

বিশ্ব অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ধরা হয় ম্যানুফ্যাকচারিং খাতকে। করোনা ভাইরাসের কারণে চীনে এ খাত এরই মধ্যে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ম্যানুফ্যাকচারিং পারচেজিং ইনডেক্স (পিএমআই) এতটাই কমেছে যা থেকে বোঝা যায়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিশীলতা ভয়াবহ রকম কমে গেছে। বেইজিংভিত্তিক ও লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ফেব্রুয়ারি মাসে চীনের পিএমআই রেকর্ড সর্বনিম্ন। চীনের ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের এ সংকোচনের কারণে দেশটির সঙ্গে গভীর বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, এমন দেশগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর সঙ্গে অন্যান্য দেশে দ্রুত করোনা ছড়িয়ে পড়ার কারণে বৈশ্বিক ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে দীর্ঘস্থায়ী স্থবিরতা দেখা যেতে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।

ওয়াল স্ট্রীটসহ বিশ্বের সব শীর্ষ সূচকের দর পতনের মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক শেয়ার বাজার আরেকটি ব্ল্যাক মানডে দেখে ফেলেছে এই যে গেল ৯ মার্চ তারিখে। আমাদের দেশের শেয়ারবাজারও করোনার প্রভাবে বিনিয়োগকারী সঙ্কটে পড়েছে। এদেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে শেয়ার বাজারের দর পতনের লিমিট টেনে দেয়া ছাড়া এবং ব্যাংক লোন ছাড় না করার সিদ্ধান্ত নেয়া ছাড়া বড় কোনো উদ্যোগ এখনো চোখে পড়েনি। বরং ভাইরাসে আক্রান্তের তীব্রতা নিয়েও ঝাপসা ধারণা আমাদের। অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক যোগাযোগ বা অর্থনৈতিক সমন্বয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনায় যেতে হলে তথ্য উপাত্তকে সুনির্দিষ্ট করে আনতে হবে। এ কাজটা কতটা দূরদৃষ্টি নিয়ে করা হচ্ছে এ নিয়ে আমার ব্যাপক সন্দেহ আছে।

আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান বলছে, যেহেতু জঙ্গি নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপত্র আছে সেহেতু করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাইরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের বিশেষ ফান্ড জরুরি। এ অবস্থায় সবশেষ ঘোষিত আইএমএফের ১ ট্রিলিয়ন ডলার খুব কি বেশি? বিশ্বব্যাপী লক ডাউন পরিস্থিতিতে আমদানি-রপ্তানি চেইন রানিং রাখার ব্যাবস্থাপত্র কী? আইএমএফের সাথে বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি সমন্বয় করার কাজটা নিয়ে এখনই ভাবা দরকার বলে মনে করছি।

সবশেষে বলি, তথ্য পাচ্ছি বিশ্বের বৃহৎ অনলাইন শপ অ্যামজনেরও নাকি মজুদ কমে আসছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, আমাদের অর্থনীতির একটা বড় শক্তি ব্ল্যাক মানি তাছাড়া চীনও পরিস্থিতি সামলে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। যতই বলা হোক, আমাদের দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণ, আমদানি নির্ভরতা কিন্তু আছেই। আমদানি কমে গেলে পেয়াঁজ যে দুইশো টাকায় খেতে হয় এটাতো এখনো আমাদের তাজা অনুভূতি। ভয় হচ্ছে পৃথিবীব্যাপী স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা বা ডিসট্যান্সিং যেখানে প্রেসক্রাইব করা হচ্ছে সেখানে কিন্তু এ প্রেক্রিপশন অর্থনৈতিক সুরক্ষায় কাজে আসবে না। কারণ আমদানি রপ্তানি চেইনের বিচ্ছিন্নতা ভয়াবহ খাদ্য সঙ্কটের দিকে ঠেলে দেবে গোটা দেশকেই। এখন দীর্ঘমেয়াদী সঙ্কট উত্তরণের পরিকল্পনা না থাকলে আমাদের বাছাই করে নিতে হবে আমরা কোন মৃত্যুকে বরণ করবো— না খেয়ে মরা নাকি করোনা ভাইরাস?

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী