
মাহবুব মোর্শেদ
ক্ষমতার পালাবদল বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
মাহবুব মোর্শেদপ্রকাশিত : মার্চ ১১, ২০২২
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন করে আমরা তখন মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতিও তলানিতে। মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে গেছে, ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ফিরে এলে উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল বায়েস আমাদের কয়েকজনকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করবেন। একাডেমিক আইন-কানুন প্রয়োগ করে না পারলেও ছাত্রলীগ যে আমাদের মারধর করে তাড়াবে, তা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু আমাদের জায়গা নেই। ক্যাম্পাস থেকে পালাবার প্রস্তুতিও নেই। আমরা বরং জনমানবশূন্য ক্যাম্পাসেই আছি। ক্যাম্পাস তখন ভূতের শহর। কয়েকজন মিলে হাঁটতেও ভয় লাগে।
পয়লা অক্টোবর রাতে নির্বাচনের ফল আসতে শুরু করলে আমরা প্রথমে মাওলানা ভাসানী হলের কমন রুমে গেলাম। দেখলাম, ছাত্রলীগের কয়েকজন সামনের সারিতে বসে টিভি দেখছে। একটু অসন্তোষজনক ফল আসতে শুরু করায় ওরা দেখলাম, একে একে উঠে যেতে শুরু করলো। আমরা বেশ খানিকটা সময় ফল দেখে ছাত্রলীগের লোকজন খুঁজতে শুরু করলাম। হল থেকে বেরিয়ে কামালউদ্দিন, সালাম-রবকত হয়ে এগুতে এগুতে দেখলাম, ওরা আল বেরুনী মেইন বিল্ডিংয়ের দিকে যাচ্ছে। আমরাও আস্তে ধীরে ওইদিকেই যেতে থাকলাম। কিন্তু হলে ঢুকলাম না। বাইরে আর্কিওলজি বিভাগের সামনে বসে থাকলাম। রাত তখন তিনটা হবে মনে হয়।
দেখলাম, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ব্যাগপত্র গুছিয়ে আল বেরুনী থেকে বেরিয়ে আসছে। ওদের বিদায় দেবার মতো ক্যাম্পাসে আমরা কয়েকজন ছাড়া আর কেউ নেই। তারা আমাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে গেল। নির্বাচনের ফল ইতিবাচক হলে যে হাতের লাঠির আঘাত সহ্য করতে হতো, সেই হাতই আমাদের হাতে মিললো গভীর রাতে।
ওদের বিদায় জানিয়ে আমরা আবার ভাসানী হলে ফিরলাম। ভোররাতের ঘুম একটু পর ভেঙে গেল। ভাঙচুর, চিৎকার, চেঁচামেচি। হলের গেস্ট রুমে গিয়ে দেখলাম, ছাত্রদলের চার পাঁচজন নেতানেত্রী হাজার বছর পর হাজির হয়েছে। তারা আওয়ামী লীগ নেতানেত্রীদের ছবি ভাঙচুর করছে। বুঝলাম, অন্য হলগুলোর ছবি ভেঙে ভাসানীতে এসেছে। ছাত্রদলের দুজন এগিয়ে এসে আমাকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলো। বললো, অবশেষে আমাদের জয় হয়েছে। আমি তাদের নিয়ে কামালউদ্দিনের সামনের দোকানে চা খেতে গেলাম।
আমরা অপেক্ষায় আছি, বিতর্কিত ভিসি আবদুল বায়েসকে সরানো হবে। কিন্তু বাতাসে নানা কানাঘুষা। আবদুল বায়েস মেয়াদ পূর্ণ করে যাবেন তাই নয়, আরও এক মেয়াদে দায়িত্ব পালন করবেন। আওয়ামী লীগের মতো তার বিএনপি লিঙ্কও নাকি খুব শক্তিশালী। এজন্য আমরা কর্মসূচি ঘোষণা করলাম। নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পেশ। শাহবাগ থেকে একটা পুলিশের গাড়ি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিয়ে গেল। সিকিউরিটি পার করে আমরা অফিসে ঢুকলাম। সেখানে দেখলাম ড. মঈন খান অফিসের ভেতরের নির্মাণকাজ তদারক করছেন। আমরা তার হাতে স্মারকলিপি দিয়ে আসলাম। সম্ভবত সেই বিএনপি সরকারের উদ্দেশে প্রথম স্মারকলিপিটি ছিল আমাদের।
এসব ঘটনার দুই সপ্তাহ পরের ঘটনা। আল বেরুনী এক্সটেনশনের সামনে ছাত্রদল সভাপতি পারভেজ সাহেবের সঙ্গে দেখা। সুন্দর পাঞ্জাবি পরে তিনি তখন ক্যাম্পাসের নতুন জামাই হয়ে ঘুরছেন। আমাকে দেখে বললেন, ছাত্রলীগ আসলে তোমাদের কেমনে সাইজ করতে হবে বোঝেনি। এবার বুঝবা মজা।
আমি বুঝলাম, পারভেজ সাহেব নতুন ইস্যু বের করবেন।
দেখা গেল, পরেরদিন ছাত্রদল মিছিল বের করেছে। ক্যাম্পাসের অডিটরিয়ামের নাম আমরা দিয়েছিলাম জহির রায়হান মিলনায়তন। বিশ্ববিবিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগপন্থী প্রশাসন তাতে রাজি হয়নি। কারণ, জহির রায়হান আওয়ামী লীগের ব্যাপারে ক্রিটিকাল ছিলেন। এখন ছাত্রদল দাবি তুললো, অডিটরিয়ামের নাম শহীদ জিয়াউর রহমানের নামে করতে হবে।
পারভেজ সাহেবকে আমি বললাম, আপনারা কেবল ক্ষমতায় আসলেন। কতকিছু বানাবেন। নিজেদের নামে সেইগুলার নাম দিয়েন।
উনি বলেন, না। তোমাদের দেখে নেব।
যাই হোক, পালাবদলের মাস না যেতেই নতুন আন্দোলন শুরু করতে হলো। যারা ১ অক্টোবর ভোরে আলিঙ্গনে জড়িয়ে বলেছিল, আমাদের জয় হলো তারাই তখন আমাদের সাইজ করার জন্য খোঁজে।
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী