
চন্দনকৃষ্ণ পাল ও তার কবিতার ভুবন
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : জুলাই ২২, ২০২০
চন্দনকৃষ্ণ পাল সাহিত্য অন্তপ্রাণ মানুষ। নিয়মিত লিখছেন। অসংখ্য বই মোড়কবদ্ধ হয়েছে তার নান্দনিক লেখা নিয়ে। শুধু তাই নয়, তিনি সংস্কৃতিমনস্ক মুক্ত মনের মানুষও। গুণী শিশুসাহিত্যিক ও কবি চন্দনকৃষ্ণ পাল জন্মগ্রহণ করেন পহেলা মে।
তিনি `আমাদের রাতদিন` নাম ভূমিকায় লিখেছেন এই কবিতাটি। প্রেম, প্রকৃতি ও মানুষ নিয়ে কবিতা রচনা করতে তিনি পছন্দ করেন। তার কবিতা পড়লে একটা মিষ্টি অনুভূতিতে হৃদয় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। একটা ভালোলাগার আবেশ তৈরি হয়। আধুনিক পরিচ্ছন্ন কবিতা লেখায় তিনি সিদ্ধহস্ত।
টুকরো টুকরো মেঘ জুড়ে করি এক দীর্ঘ সামিয়ানা
তার নিচে আমাদের জীবন যাপন
রংধনুর সব কটা রং মেখে বানিয়েছি আজ এক
অনিন্দ্য ক্যানভাস
তার গায়ে আরো রং যোগ করি
সকাল দুপুর আর সন্ধ্যের সূর্য থেকে এনে।
কী যে এক ভালোলাগা ছুঁয়ে থাকে আপাদমস্তক,
ভাবি এই তো জীবন
অনেকেই জ্বলে পুড়ে খাক হয় আমাদের দিনরাত দেখে
আর হতাশায় নিমজ্জিত হয় প্রতিদিন।
আমরা নিয়মিত নতুনের আবাহনে
সুসজ্জিত করি দিনরাত
নতুন পাঠের আলো ছড়িয়ে দিতে থাকি সবুজের গায়ে।
এই দিন আমাদের, এই রাতও তারাজ্বলা
দূরে ঐ চন্দ্রের উঁকি মারা দেখে দেখে নিদ্রায় ঢলে পড়ি,
স্বপ্নের চাদরে জড়িয়ে থাকি আরো এক রাত।
চন্দনকৃষ্ণ পাল লিখেছেন `রোদন: অরণ্যে, অতঃপর` কবিতা। কবিতাটি হয়ে উঠেছে আধুনিক কবিতার জলন্ত প্রদীপ।
এইসব আবরণ ভেদ করা স্পন্দন
ক্রমশ বাড়ছে আর ক্ষয় তার বাড়াচ্ছে প্রভাব
এভাবে অন্ধকার আপ্লুত আলোর গন্ধ পেলে
ছায়ার পেখম নৃত্য নিবিড় হয় অনায়াসে ।
পরিচালন ব্যয় গতি পেলে
পতন গোগ্রাসে গিলে মাংস ও হাড়
নীল ও সবুজ কাৎরায়
ফিকে হয় লালের প্রবাহ
তরুণ মৎস্যের লেজ ক্ষত নিয়ে নড়াচড়া করে।
ওসব জেনেছিলে সেই কবে, যখন বেগুনি ফুল
নেড়েছিল ঝুঁটি পালকের স্পর্শ মেখে
উড়েছিলে শীর্ষ সবুজে,
জেনেছিল ঘাই মানে ঢেউয়ের ছড়ানো পালক
বিস্তারিত জলের প্রবাহে দোলাচল,
সমস্ত নূতন মেঘ ঝরে গেলে
শূন্যতায় শুধুই রোদন।
রোদন পূর্ণ যদি সবুজ চত্বর
ফুলের বিমর্ষ মুখ উঁকি মারে যদি,
আবরণভেদী ঐ অণুজীবে প্রয়োজন নেই।
`চলতে চলতে` তার গদ্য কবিতা। কবিতাটি যেমন সাহিত্যগুণ সম্পন্ন তেমনি শ্রুতিমধুর।
এরকম দুপুর পর্যন্ত ঘুমুনো
এক আজলা জল চোখে মুখে দিয়ে
শুকনো রুটিতে কামড় আর তখনও ঘুমের
লিপ্সা চোখ জুড়ে।
খনেখনে গলায় ফিরিস্তি
চাল-ডাল-সবজি-মাছ ইত্যাদি ইত্যাদি
শূন্য হাড়ি-কুড়ি সব, তারপরও ঘুমের বেড়াজালে।
চলতে চলতে দিনের শেষে
সান্ধ্য পৃথিবীতে
মন মনে আওয়াজের ফের উত্থানে
উত্থিত হলেন তিনিও
চুলহীন মস্তকধারী অনন্য যুবক।
তার পৃথিবীতে দিন রাত একাকার
তিনি স্মিত হেসে
স্বাগত ভাষণ রাখেন ইট কাঠ আর
গ্রিলের সান্নিধ্যে নীরবে নিঃশব্দে।
হাস্য সম্বরণে ব্যর্থ হলো সান্ধ্য পৃথিবী।
`জলদানব` একটি উত্তর আধুনিক যুগের কাব্যগুণসম্পন্ন কবিতা:
লুকোচুরি, মেঘ খেলে তার মতো আর
আকাশ বুকে ধরে তারার ঝিলিক
সুর্য্য দানব হাসে খরতাপ ঢেলে
কল্পলোকে ফাঁদ পেতে কি লাভ কুমারী?
অনন্ত স্বপ্ন যদি মেলে পাঁচ আঙ্গুল
বৃত্তাবদ্ধ হয়ে যায় আগামী প্রভাত
সবুজ বিনম্র ঠোঁটে চুম্বন রাখে
মৃৎ পাত্রে মৃত মৎস্য ভাসে নিরুদ্বেগ।
আন্দোলিত স্কুইডের পঞ্চম শুঁড়ে
লালা ঝরে প্রাকৃতিক উন্মত্ত সময়ে
আদিম প্রবৃত্তি ভেদ করে জলরাশি
মিলন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পদক্ষেপ রাখে।
প্রাচীর দাড়ায় যদি নিজস্ব নিয়মে
দ্রুত রং বদলায় জলের দানব
তীক্ষ্ণ দাঁতে স্ফুলিঙ্গের দৃঢ় উত্থান
টালমাটাল আদিগন্ত, মাতাল সময়।
জলে ভাসে প্রযুক্তি ভাসে প্রাণ আরও
ঢেউয়ের তুমুল চাল বালিয়াড়ি ভাঙ্গে।
`হচ্ছেটা কি?` চন্দনকৃষ্ণ পালের একটি শিশুতোষ ছড়া। শিশুরা তার কাছেই যায়, যার কাছে গেলে আদর পায়। আদরে আহ্লাদে থাকতে পছন্দ করে তারা।
হচ্ছেটা কি?
বুঝতে পারছি না তো,
বাইরে থেকে
বাবা এসে
ধরছে না আর হাতও!
আদর দেয়া দূরে থাকুক,
এগিয়ে গেলে মাকে বলে, `সরাও`
`কিচ্ছু আমি বুঝি না তো
বাবা তুমি কেন আমায় ডরাও!`
বাবার আদর পাই না,
আমিও কাছে যাই না।
`প্রিয় মাছ, দেশি মাছ` চন্দনকৃষ্ণ পালের স্বাদু পানির মাছ নিয়ে লেখা একটি সমৃদ্ধ ছড়া। আমাদের প্রাণ প্রকৃতি নানা বিচিত্র কারণে বিপন্ন হচ্ছে। কবি সেই বিপন্ন প্রাণের আর্তনাদ মানস চক্ষে দেখেছেন। তাদের বিপন্ন হওয়ার করুণ দৃশ্য এঁকেছেন কবিতার ক্যানভাসে। ছড়া আকারে।
প্রিয় সিলেটের হাওরগুলিতে
দেশি মাছ বেশি মেলে না
হারিয়ে গিয়েছে নানা প্রজাতি
তাই জলে তারা খেলে না।
কীটনাশকের বেশি ব্যবহারে
হয়েছে সর্বনাশ তো
দেশিটা হারিয়ে আমরা এখন
করছি বিদেশি চাষ তো।
কতো দেশি মাছ ছিলো আমাদের
কতো নাম গেছি ভুলে
যে কটা আছে মনের গভীরে
সেগুলি দিচ্ছি তুলে।
মহাবিপন্ন ‘টাটকিনি’ আজ
‘বাঘাড়’‘ঘারুয়া’‘চাকা’
‘রিটা’ ‘পাঙাস’‘রানী’ও ‘বামোশ’
মনেতে ছবি যে আঁকা।
‘নাফতানী’আর ‘মহাশোল’মাছ
‘চিতল’ আর ‘সরপুটি’
হারিয়ে যাচ্ছে ‘ছিপচেলা’‘বাচা’
‘ঢেলা’ আর ‘একথুটি’।
‘বাশপাতা’ ‘কুচে’ ‘নাপতে কই’
‘রায়েক’ ‘টেংরা’ ‘ফলি’
‘গুজি আইড়’মাছ ‘দাড়কিনা’ আর
‘পাবদা’ লোভের বলি।
‘গোলসা’ ‘ঘনিয়া’‘আইড়’ ও ‘গজার’
‘তিতপুটি’ ‘তারা বাইম’
‘নামাচান্দা’ ‘কালিবাউশ’ আর
‘নান্দিনা’ ‘বড় বাইম’।
‘মধু পাবদা’ ‘খাস খাইরা’
‘এলং’ ও ‘গাঙ মাগুর’
‘ঘোড়া’ ‘তিলা শোল’ ‘খলিসা’ ‘মেনি’ও
আজকে অনেক দূর।
‘বোয়াল’ ‘বেলে’ ‘শিং’ ও ‘মাগুর’
‘বাংলা’ ‘চিংড়ি’ ‘কই’
‘রিটা’ ‘কাচকি’ ‘গোলসা’ ‘টাকি’র
জন্য মুখিয়ে রই।
‘শোল’ ‘গুতুম’ আর‘নানিদ’ ‘শিলন’
‘মহাশোল’‘ঢেলা’ ‘মলা’
‘বাটা’ ‘পুটি’ ‘বাইন’ ‘টেংরা’ ও ‘পোয়া’
কমছে দেশিয় জলা।
কমছে মিষ্টি পানির এ মাছ
পাইনা ‘খলিসা’ ‘কাজলী’
হারিয়ে যাচ্ছে ‘চেনুয়া’ ‘বাতাসী’
‘কুচিয়া’ ‘রিটা’ ও ‘ফলি’।
‘ভেদা’ নামের ‘মেনি’ মাছটাও
কমে গেছে ধীরে ধীরে
বিষন্ন মুখে জাল নিয়ে জেলে
বসে থাকে নদী তীরে।
মাছের অভয়ারণ্য আজকে
হাওরকে করা হোক
না হলে বেশি বাকি নাই
হবে মাছের জন্য শোক।
সময় থাকতে সচেতন হই
সোচ্চার হই ভাই
দেশীয় মাছরা জলেতে থাকুক
মনে প্রাণে এটা চাই।
`সারি নদীর জলে` ছড়াটি চন্দনকৃষ্ণ পালের লেখা একটি জীবন্ত প্রামান্যচিত্র। লেখাটি পড়লে মানস চক্ষে সারি নদী দেখা যায়। সারি নদীর টলটলে জল অনুভব করা যায়।
কে যেন আজ নীল ঢেলেছে সারি নদীর জলে
হাতে নিলেই সে জল আবার স্বচ্ছ ও টলটলে
এই এতো নীল পেলি কোথায় বল না সারি তুই
অবাক হয়ে আমরা সবাই টলটলে জল ছুঁই
জলের সাথে আকাশ মিশে, মিশে পাহাড় সারি
সারি নদীর রূপ থেকে কি চোখ সরাতে পারি?
বেলে পাথর অবাক তাকায় নতুন মানুষ দেখে
আমরা শুধু ধরে রাখি সারির এ রূপ এঁকে
ক্যামেরা আর মোবাইল ফোনে সে রূপ ধরা যায়?
লালাখালের সারির কাছে যাই ছুটে পায় পায়।
বৃহত্তর সিলেটের হাওর নিয়ে তিনি লিখেছেন ছড়া। নামটিও দিয়েছেন `হাওর নিয়ে`। এটি ছড়াকার চন্দনকৃষ্ণ পালের একটি গবেষণাধর্মী ছড়াকর্ম।
‘সাগর’ থেকে ‘সায়র’ হয়ে
‘হাওর’ এ জল খেলা
দুইশতের অধিক বিল আর
হাওরের চার জেলা।
বৃহত্তর এ সিলেটে বিল
সতের,দুইশত
ঝরনা,ছড়া,নদী আরো
মিলছে এসে কত।
সবচে’ বড় হাওর হলো
‘হাওর হাকালুকি’
এক পাশে তার মেঘালয়ে
দিচ্ছে দেখুন উঁকি।
‘টাঙ্গুয়া` ও `শনির হাওর’
‘দেখার হাওর’ আরো
‘ঘুঙিয়া জুড়ি’ ‘মকার হাওর’
দেখতে তুমি পারো।
‘হাইল হাওরে’র বিশাল দৈর্ঘ্য
প্রস্ত নয় কমও
হিসাবে সে আছে বোধহয়
হয়ে তৃতীয়তম।
‘নলুয়ার হাওর’ আছে
জগন্নাথপুরে
এ হাওরকে রাধারমন
ভরিয়ে রাখেন সুরে।
‘পচাশোল’ ‘মইয়ার হাওর’
‘রায়ের হাওর’ আছে
‘কাউয়া দিঘি হাওর’ আছে
রাজনগরের কাছে।
লক্ষ মানুষ জড়িয়ে আছেন
এই হাওরের সাথে
জীবন আছে জীবিকাও
সকাল সন্ধ্যা রাতে।
পরিবেশে অবদান তার
আছে তো বিশাল
মৎস্যসহ কত সম্পদ
ব্যস্ত জেলের জাল।
আসুন সবাই হাওর-জলা
বাঁচিয়ে রাখি আজ
সুস্থভাবে বাঁচার জন্য
এটাও বড় কাজ।
`এই হাসিটা` চন্দনকৃষ্ণ পালের হাসি বিষয়ক ছড়া। দেখার চোখ থাকলে প্রকৃতির সকল কিছুর হাসিই দেখা যায়। কবিও দেখেছেন সেই অনঘ হাসি।
সোনালি রং আলো নিয়ে
সকালগুলো আসে
পাখ-পাখালীর সাথে সাথে
নীল আকাশও হাসে।
মেঘের গায়ে আলো মেখে
হাসে মেঘের পরী
হাসি তো নয় হাসি তো নয়
ঝরছে যেন জরি।
জরির গায়ে আলপনা হয়
আলপনা হয় ঘাসে
অপূর্ব আলপনা দেখে
খোকন সোনাও হাসে।
খোকন হাসে সাথে হাসে
মিতুর বিড়াল ছানা
তোমরাও হাসো এই সকালে
হাসতে তো নেই মানা।
হাসতে হাসতে অপূর্ব হোক
সোনায় মাখা দেশ
এই হাসিটা জড়িয়ে থাকুক
হয় না যেন শেষ।
`এই ঈদে শহরে একা` চন্দনকৃষ্ণ পালের লেখা একজন অসহায় পিতার আর্তনাদ। ঢাকা শহরে এমন অনেকেই থাকেন যারা অসহায় জীবনযাপন করেন। তাদের নিয়ে লেখা ছড়াটি হৃদয় ব্যাথিত করে।
এই ঈদে শহরে, একা
স্টেশন লিভ যায় না করা
চাকরিজীবী বাবার
বড় স্যারের নির্দেশ এই
উপায় তো নেই যাবার।
স্ত্রী সন্তান গ্রামের বাড়ি
বাবা মেসে একা
প্রায় তিন মাস সন্তানদের
হয়নি যে তার দেখা!
স্মার্টফোন নেই নেট তো দূরে
বাটন ফোনই সার
স্ত্রী পুত্রের কণ্ঠ শুনেই
দিনটা করেন পার।
মেসের বুয়া নেই তিন মাস
নিজেই করেন সব
নিরিবিলি এ শহর এখন
নেই তো কলরব।
রমজান এসে চলেও গেল
ঈদের আমেজ হারা
বুকের ভেতর বয় হাহাকার
স্ত্রী সন্তান ছাড়া।
আসবে কবে সন্তানদের
জড়িয়ে ধরার দিন
সবার মুখে ফুটবে হাসি
বাজবে সুখের বীণ?
`চোরে চোরে মাসতুতো ভাই` চন্দনকৃষ্ণ পালের একটি সমাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার ছড়া। চোর নিয়ে বিষদ বিবরণ পেশ করেছেন তিনি। কত রকমের চোর, আর তাদের কত রকমের চুরি, সেটা ছড়ায় ছন্দে জানতে পারব আমরা। শিখতে পারব চুরিকে ঘৃণা করার শিক্ষা।
চোরে চোরে মাসতুতো
ভাই হয় জানি
চোরদের হাড্ডিও
হার্ড হয় মানি।
শক্ত হাড্ডি নিয়ে
তবু চুরি করে
এখানে ওখানে আর
গ্রামে কাঁচা ঘরে।
কাঁচা ঘরে চুরি করে
কেটে বড় সিঁধ
অনেকেরই রাতে তাই
হয় না তো নিদ।
সিঁধ কাটা চোরদের
সাহস হয় কম
দুঃসাহসী লোকজন
এ চোরের যম।
ধরতে পারলে দেখি
মার ধমাধম
আজকাল সিঁধেলরা
আছে খুব কম।
ফল চোর ফুল চোর
এসবও আছে
ওরা থাকে আশেপাশে
আমাদের কাছে।
বই চোরদের কথা
না বললে নয়
এই চোর অনেকের
মধ্যেই রয়।
বই চোর ভালো চোর
স্বীকৃতি আছে
ভালো বই দেখলেই
তার মন নাচে।
মন চোরও আছে
এই সমাজে প্রচুর
একটা বয়সে এরা
করে ঘুরঘুর।
কার মন কখন যে
চুরি করে বসে
এই চোর থাকে জেনো
রসে আর বশে।
গরু চোর চুরি করে
গরু মোষ খাসি
ভয়ানক বিপদেই
পড়ে যায় চাষি।
ভয়ানক চোর আছে
অদৃশ্য হয়ে
এদের যায় না ধরা
থাকে রয়ে সয়ে।
শিক্ষিত লোক এরা
উপর তলার
এরা শুধু জিতে যায়
মানে না তো হার।
আইন ও কানুন কিছু
মানে না তো তারা
বড় বড় পদে থাকে
এই চোর খাড়া।
ব্যাংক বীমা নানা ফান্ড
গিলে এরা খায়,
নিউজ ভিউজ হলে
নামও কামায়।
হাসি মুখে থাকে ওরা
কিছুই না হয়,
অনন্ত কাল এরা
ক্ষমতায় রয়।
এসেছে নতুন চোর
ত্রাণ খায় জোসে
’নৈতিক দল দেখি
এদেরকে পোষে!
চোরের ফিরিস্তি করি
আজ তবে শেষ
আবার সুযোগ পেলে
করব তা পেশ।
বাবা মানুষের জীবনের এক অনিবার্য নাম। যার শুধু জন্মদাতা আছে, কিন্তু বাবা নেই, তার দুঃখের শেষ নেই। তার জীবন রঙচটা। তার জীবন বিবর্ণ। অনুভূতির, আবেগের এক জীবন্ত নাম বাবা। চন্দনকৃষ্ণ পাল লিখেছেন, `বাবা, দূর আকাশের তারা` কবিতাটি।
রাত পোহালেই পূব আকাশের লাল
উজান বেয়ে এগিয়ে যাওয়া পানসী নায়ের পাল
কিংবা ধরো পুরোন দীঘির
টলটলে কালো জলে
তাকাই কৌতুহলে
তখন দেখি বাবার প্রিয় মুখ
সত্যি তখন হৃদয় ভরা কি যে দারুন সুখ।
আলনায় রাখা বাবার শার্টে
বাবার গন্ধ পাই,
বাবার ছোঁয়া পাবার জন্য
আলনার কাছে যাই।
ব্যস্ত বাবা, ইচ্ছে হলেই যায় না তাকে পাওয়া
চোখটি মেলার আগেই তার বাইরে চলে যাওয়া
সারাটি দিন অপেক্ষাতে থাকা,
বুকের ভেতর বাবার ছবি আঁকা
রাতের বেলা ফিরে এলেই
ঝাঁপিয়ে পড়া বুকে
বুকের ভেতর লেপ্টে থাকা
সময়টা যায় সুখে।
আজতো সে সুখ নেই
বুক ভারি হয় তাঁর কথা ভাবলেই।
করোনা কালের বন্দিদশা নিয়ে লিখেছেন `চাওয়া`। চন্দনকৃষ্ণ পাল মানুষের জীবনের সমস্ত অনুভূতি নিয়ে, সমাজ বাস্তবতা নিয়ে, জীবনের বাক পরিবর্তন নিয়ে একের পর এক লিখে চলেছেন। দু`হাতে লিখেছেন তিনি। নিজের ভূবনে নিজে মহারাজ তিনি। নিবিষ্ট সাধক তিনি।
বাদ্য বাজে
সকাল সাঁঝে
বুকের ভেতর সই,
ঢাক নয় তো
ঢোল হয় তো
ভয়ে কাতর রই।
সব ছেড়েছি
তাও হেরেছি
রাতেও ঘুম নাই,
ঠান্ডা তেলে
খেলা খেলে
ঘুমকে কোথায় পাই?
ভোরের বেলা
ঘুমের খেলা
একটু খেলে চোখে,
মাসের পরে
মাস যে ঘরে
আছি দারুন শোকে।
শোক কাটে না
সুখ হাঁটে না
বিষন্নতায় দিন,
আর কতো কাল
থাকবে এ হাল
শোধবো কবে ঋণ?
মুক্ত করো
হাতটি ধরো
পথে রাখি পা,
বসে ঘরে
শুনে, পড়ে
আর তো পারি না।
খোলা হাওয়া
এটাই চাওয়া
মুক্তি দাও হে নাথ,
সূর্য আসুক
চন্দ্র হাসুক
কাটুক কালো রাত।
তিনি সময় নিয়ে লিখেছেন কবিতা। তার কবিতায় বাধাহীন সময়ের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠেছে। চন্দনকৃষ্ণ পাল একজন সময়ের শক্তিমান কবি।
ওখানে হাওয়া ছিলো উদ্দাম চঞ্চল
জলস্রোত বাধাহীন সময় কাটাতো
আকাশের ওপারেও ছিলো যে আকাশ
নীল চিঠি নীল খামে সেই তো পাঠাতো।
পাহাড়ের হাতছানি সকাল বিকেল
নীল জলে সাদা ঢেউ চুমু রাখে তার
ঝিনুকের হেঁটে চলা সৈকত জুড়ে
বুক থেকে নেমে যেতো কষ্ট পাহাড়।
স্বপ্ন ও স্মৃতিতে সে দিনের ছবি
প্রিয় মুখ লুকোচুরি খেলে অমারাতে
প্রিয়তার প্রিয় ডাক হারালো কোথায়
নিত্য যাত্রার পথ হারালো প্রভাতে।
এ রকম কেনো হলো? কি এমন ভুল
সব সূত্র ছিড়ে যায়, নৃত্যে মগ্ন রাত
তার মতো গেয়ে যায় রাগ চন্দ্রকোষ
চিহ্নহীন আকাশ এক জলের প্রপাত।
`ভূমিকম্প` ছড়ায় চন্দনকৃষ্ণ পাল অন্তমিলের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। অন্তমিলের অভিনবত্বে অপূর্ব হয়ে উঠেছে এই ছোট্ট লেখাটি।
ভূমিকম্পের ভয়ে তার দিন-রাত্তির কাটে না
হাইরাইজ-এর পাশ দিয়ে সে ভুলেও আর হাঁটে না
এখন থেকেই সাবধানী সে,
নজর রাখে সব জিনিসে,
লোককে বলে, ভূমিকম্প, আমার ক্ষেত্রে খাটে না ৷
কত রকমের কলম আছে? আমরা ক`টা কলমের নাম জানি? `কলম কথা` ছড়ায় চন্দনকৃষ্ণ পাল লেখালেখির বৃত্তান্ত তুলে এনেছেন। লেখালেখির ইতিহাসে মানুষ লেখার জন্য অনেক কিছু ব্যবহার করেছেন। সেই তাল পাতা থেকে ঝকঝকে কাগজ। কিংবা কবুতরের পালক থেকে বলপয়েন্ট। `কলম কথা` লেখায় ছড়ায় ছড়ায় ইতিহাসের মতো করে সে কথাই জানতে পারব আমরা।
খাগের কলম, কেরাইয়া কষ
কলা পাতায় লেখা
লেখা শুরুর দিনে তখন
এসব দিয়েই শেখা।
শ্লেট পেন্সিল এটাও ছিলো
শুরুর দিনের কাছে
লেখা এবং মুছার স্মৃতি
মনের ভেতর আছে।
কাঠ পেন্সিলে লিখে লিখে
লেখাটা হাতে আনা
কাঠ পেন্সিল কামড়ানো তো
ছিলো কঠিন মানা।
‘টিপ কলম’টা এলো হাতে
দিনভর টিপাটিপি
অত্যাচারে পালিয়ে যেতো
এই কলমের ছিপি!
রিফিল দিয়ে চেষ্ঠা করে
চলতো লেখার কাজ
বকাঝকাও খুব খেয়েছি
ভাবলে দেখি আজ।
কালির বড়ি গুলে গুলে
দোয়াত পূর্ণ করে
বাঁশের কলম খাগের কলম
চলতো ঘরে ঘরে।
তারপর এলো ঝরনা কলম
ফাউনটেন পেন বলি
সুশ্রী লেখার যাদু এ পেন
যেনো ফুলের কলি।
কী লীলাতে নিবে কালি
জীহ্বা বেয়ে আসে
সাদা কাগজ বুকের উপর
বর্ণ নিয়ে হাসে।
কী বাহারী নাম কলমের
‘পাইলট’‘পার্কার’
‘সুলেখা’ ‘ইয়ুথ’ ‘পেলিক্যান’
পছন্দ যার যার।
আরো ছিলো ‘উইংসন’
হালকা মনে ভাসে
এসব পেনের চেহারাটা
আজও মনে আসে।
সাথে তরল কালির দোয়াত
কলমের নামে নাম
কালি ছিলো লাল কালো নীল
সবুজও জানালাম।
রয়েল ব্লু, ব্লু-ব্ল্যাক আর
ব্ল্যাক চলতো বেশি
বিদেশী ‘পেলিক্যান’ ছিলো
‘সুলেখা’‘সীমা’ দেশি।
আরো আধুনিক কলম এলো
কালি উঠে নিজে নিজে
দোয়াতে কলম ডুবিয়ে দিয়ে
অবাক হতাম কি যে।
কলমের পেট পূর্ণ কালিতে
‘ইয়ুথ’ যে তার নাম
সুশ্রী চেহারা সে কলমের
বেশী ছিলো তার দাম।
ঝরনা কলম ইতিহাস আজ
বলপেনই সব হাতে
গতি বেড়েছে বলছে সবাই
লেখা দ্রুত হয় তাতে।
আভিজাত্যের প্রমাণ হিসাবে
আছে ফাউন্টেন পেন
পেন নিয়ে আজ শেষ করলাম
এবার বিদায় দেন।
করোনা কালের লকডাউন নিয়ে তিনি লিখেছেন `কারফিউ চাই` ছড়াটি। চন্দনকৃষ্ণ পাল একজন সমাজ সচেতন ছড়াকার। তিনি করোনা কালে কিছু মানুষের অপ্রয়োজনে বাইরে বের হওয়াকে ভালো চোখে দেখেননি। ভালো চোখে দেখার কথাও নয়। একজন কলম যোদ্ধা সমাজের সমস্ত অসঙ্গতিতেই কলম ধরেন। তিনিও ধরেছেন।
তোমার সোনার ছেলেরা ঘুমায়
যতোই বলো না জাগো
যতো চিল্লাও শুনবে না তারা
বুঝলে না তুমি মাগো।
রেডিও টিভিতে ঘোষণা দিচ্ছো
ঘরে থাকো ঘরে থাকো
যতোই বলো না করো আনন্দ
মুভি দেখো ছবি আঁকো
শুনবে না তারা করিয়াছে পণ
দল বেধে যাবে বাইরে
চা পান করিবে দোকানে দোকানে
এ ছাড়া উপায় নাইরে!
বিড়ি সিগারটে সুখটান দেয়া
এটা যে তাদের ধর্ম
কিসের করোনা? বলো না এসব
তাদের আছে তো বর্ম।
নিকোটিনে কালো ফুসফুস নিয়ে
দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে
আরো কত কিছু ভিতরে নিয়েই
মদ ভাং তাড়ি খাচ্ছে।
নিজেরা মরবে পরিবারও যাবে
নেই কোন তার চিন্তা
ছুটি পেয়ে গেছে, আহা আনন্দ
নাচে মন ধিন ধিনতা।
চিবুকের নীচে মাস্ক লাগিয়েই
দিব্যি ঘুরছে বাইরে
ওরা সাহসী বীর সন্তান
তাদের তো ভয় নাই রে।
ডান্ডা ছাড়া তো ঠান্ডা হবে না
থাকবে না তারা ঘরে
আবালেরা নিজে নিজেরে ডুবায়
মারে আর নিজে মরে।
কারফিউ দিন না হলে এ দেশে
মৃত্যু মিছিল বাড়বে।
ঘরে ঘরে যাবে এই করোনা
নিয়মিত প্রাণ কাড়বে।
`অন্তর্গত অনুভব` চন্দনকৃষ্ণ পাল এক চিরসত্য তুলে এনেছেন তার কবিতায়। `সব কিছু মুছে যায় সময়ের স্রোতে`। হ্যাঁ, অবশ্যই সব ক্ষত মুছে যায়, সব ব্যথা মুছে যায়,সব দেনা মুছে যায় সময়ের স্রোতে।
মুখ থেকে সব হাসি মুছে গেলে
কিযে এক ধূসরতা মেঘের আদল নিয়ে
স্তম্ভিত দাঁড়ায় একাকী, আমি হই বোধ শক্তিহীন-
কোন করুণ বাক্য রচিত হয় না ক্রান্তিকালে
অসহায় ঠোঁট জোড়া নিশ্চুপ থেকে যায় অনন্তকাল...
অনন্তকাল কি ধরে রাখে বনানীর বিষন্ন মুখ?
এ প্রশ্ন রাখার আগেই
সব কিছু মুছে যায় সময়ের স্রোতে...।
ঢাকা শহরে বসবাসের নিদারুণ যন্ত্রণা নিয়ে তিনি রচনা করেছেন `তোমরা থাকো ঘিঞ্জি শহর নিয়ে` ছড়াটি। চন্দনকৃষ্ণ পাল দাদির চরিত্রে গ্রামে ফিরে যাওয়ার যে আকুতি জানিয়েছেন, তা আসলে তার নিজেরও চাওয়া। তিনি নিজেও সশরীরে গ্রামে ফিরে যেতে চেয়েছেন। শ্রীমঙ্গলের সবুজের মাঝে মিশে যেতে চেয়েছেন। হাওরের ধারে, চাই বাগানের পাশে তার আবাস গড়তে চেয়েছেন।
তীব্র গরম, ঘাম ঝরানো শেষে
উঠলো আকাশ হেসে
দাঁতের ঝিলিক দেখিয়ে দিয়ে
ধুলোর ঝড়ে ভাসিয়ে নিয়ে
তারপর তার কান্না অবিরল
ঝরতে থাকে জল
সাথে শীতল বাতাস আসে
দাঁত দেখিয়ে মুচকি হাসে
মুটকি দাদির মুখেও ফুটে হাসি
গত দুদিন দাদির ছিলো কষ্ট রাশি রাশি
মোটা মানুষ, ঝরতে থাকে ঘাম,
রাগের চোটে বলতে থাকেন-
‘কোথায় যে আসলাম,
আমার গ্রামে কী যে শান্তি
কাজে থাকি, নেই তো ক্লান্তি
এই শহরে শান্তি লাগে না যে
শহরের এই ভ্যাপসা গরম
বিশ্রি এবং বাজে।’
‘আমি বাপু থাকবো না এই শহরে
মানুষ জন আর রিকশা গাড়ির বহরে
ফিরে যাবো আমার গ্রামের মায়ায়
বাতাস খাবো, ঘুরবো ফিরবো
গাছ-গাছালির ছায়ায়।’
‘তোমরা থাকো ঘিঞ্জি শহর নিয়ে
আমায় তোমরা গ্রামেই আসো দিয়ে।’
`এক বিকেলে, জানালাতে দাঁড়িয়ে থেকে` চন্দনকৃষ্ণ পালের একটি অন্তমিল সমৃদ্ধ অনন্য কবিতা। তিনি কল্পনায় মেঘের পিঠে চড়তে চেয়েছেন। মেঘ হতে চেয়েছেন। কবিতাটি কিশোর থেকে বৃদ্ধ। সব বয়সী পাঠকের ভালো লাগবে।
মেঘের মতো ভাসতে ভাসতে
হাসতে হাসতে
পার হতে চাই খাল বিল বন সবুজ পাহাড়,
তারপর এক নীল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে
চাই হতে এক সবুজ টিয়ে
হাজার পাখির আলপনা চাই আকাশ ছোঁয়া
নীলের গায়ে-
পাল তোলা এক প্রাচীন নায়ে
হ্যাট পরা এক নাবিক দেখে একটু হেসে
ভালোবেসে
তাঁকে ছুঁয়ে আবার উড়াল মেঘের কাছে
সাগর ছোঁয়া সবুজ বনের গাছে যতো
পাখ-পাখালি বাঁদর আছে
সব্বাইকে জানিয়ে আদর
মেঘের চাদর
জড়িয়ে গায়ে আবার উড়াল দূরের দেশে
লাগিয়ে কাজল আবার হেসে
গড়িয়ে পড়া
মেঘের গায়ে কল্পনাতে হাতি গড়া
সাদা মেঘের বিশাল হাতি
তার ওপর এক মাহুত বসে ধরবে ছাতি
রোদ বৃষ্টি যতোই ঝরুক আর নাই ভয়
আকাশকে জয়
করে আমি এগিয়ে যাবো অনেক দূরে
তোমরা সবাই বাজিয়ে বাঁশি প্রিয় সুরে
জানান দেবে তোমরা আছো আমার সাথেই...
এসব কথা ভাবতে ভাবতে রোদ পড়ে যায়
এই জানালায়
একা আমি দাঁড়িয়ে থাকি এক বিকেলে
সন্ধ্যে এলো এইতো দূরে লেক সিটিটার
মাথার ওপর
আলোর টোপর
পরবে এবার, বিদায় বলি
বন্ধু আমার, ঘরে চলি।
আমরা লঘু চাপ, নিন্মচাপ, সাইক্লোন, সুপার সাইক্লোনের নাম শুনে থাকি। আমরা জানি কী কোন ধরণের আবহাওয়ায় বাতাসের বেগ কত থাকে?না জানলে পড়তে পারি চন্দনকৃষ্ণ পালের `লঘু চাপ থেকে সুপার সাইক্লোন` ছড়াটি।
সতেরো থেকে ত্রিশ বেগ যদি হয়
এই চাপকেই সবে ‘লঘু চাপ’ কয়।
একত্রিশ থেকে বেগ চল্লিশ হলে
‘সুস্পষ্ট লঘুচাপ’ এটাকেই বলে।
একচল্লিশ থেকে বেগ পঞ্চাশ
‘নিম্নচাপে’র জেনো এখানেই বাস।
‘গভীর নিম্নচাপ’ কিভাবে যে হয়?
একান্ন থেকে চাপ একষট্টিতে রয়।
বাষট্টি থেকে বেগ আটাশিতে হলে
এটাই ‘ঘূর্ণিঝড়’ সব্বাই বলে।
ঊননব্বই থেকে একশ সতেরো
‘প্রবল ঘূণিঝড়’ গতিবেগ আরো।
‘ঘূর্ণিঝড় হারিকেন’ কেন্দ্রতে রেখে
একশ আঠারো থেকে দুইশ উনিশে।
‘সুপার সাইক্লোন’ গতি দুইশত বিশ
বাতাসের গতিবেগ মনে রেখে দিস।
`টাকলু কানাই পেটলু কানাই` চন্দনকৃষ্ণ পালের হাস্য-পরিহাসে পরিপূর্ণ একটি ছড়া। ছড়া লিখে হাসানো সাধারণ লেখকের কাজ নয়?
টাকলু ভাইয়ের টাকের সাথে
ইঞ্চি কয়েক পেট বেড়েছে
এসব দেখে ফিঙে এসে
সাবাস দিয়ে লেজ নেড়েছে।
টাকলু ভাইতো ভীষণ খুশি
পাখ-পাখালীর সাড়া পেয়ে
কঠিন একটি কাওয়ালী গান
হেঁড়ে গলায় উঠেন গেয়ে।
সে গান শুনে ভিমড়ি খেলো
এঁড়ে বাছুর, কালীর মায়ের
গ্রাম সরদার ফতোয়া দেন
‘করো তুমি মামলা দায়ের।’
‘গ্রামে কি আর আইন কানুন
রাখবে না এই টাকলু বাদর
সবার চোখের মণি ছিলো
সবাই দিতো অনেক আদর।’
‘আদর পেয়ে বাদর হলো
পেটলু এবং টাকলু কানাই
হেঁড়ে গলায় গাইছে সে গান
তার জায়গা এখন থানাই।’
কান্ড শুনে মুর্চ্ছা গেলেন
টাকলু ভাইয়ের ছোট মাসী
সারা গ্রামে কান্নার রোল
ঘটনা তো সর্বনাশী।
মুক্তির উপায় যায় না পাওয়া
বিজ্ঞ জনের ঘাম ছুটে যায়
টাকলু-পেটলু কানাই এবার
নিরুদ্দেশে তার পা বাড়ায়।
ভোরের বেলা খবর ছড়ায়
মা-মাসীমা পাগল পারা
বিষন্নতা গ্রামটি জুড়ে
আমরা পেটলু-টাকলু হারা।
`পেরেক দিলাম ঠুকে` একটি প্রতিবাদী ছড়া। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ। চন্দনকৃষ্ণ পাল বুঝিয়ে দিয়েছেন কীভাবে গর্জে উঠতে হয়।
ধরেন তক্তা
মারেন পেরেক
ঠিক
আপনি কি মাল!
হয়েই গেলো
লিক।
এরে ধরেন
তারে ধরেন
খপ
তুলসি পাতা
হয়ে করেন
গপ।
আমরা বেকুব,
পুরোপুরি
আন্ধা
বুঝে গেছি
আপনি কেমন
বান্দা।
শেষ পেরেকটা
আমরা দিচ্ছি
ঠুকে
লাগবে জানি
আপনার এই
বুকে।
`বাঁশ বিষয়ক কথামালা` চন্দনকৃষ্ণ পালের বাঁশ নিয়ে এক অনবদ্য ছড়া। কত রকমের যে বাঁশ আছে, জানতে পড়তে হবে এই লেখাটি।
কৃষ্ণের হাতে বাঁশি ছিলো
তৈরি ওটা বাঁশে
বাঁশি শুনে মন উতলা
রাধা আসেন পাশে।
বাঁশের বাঁশির আওয়াজ শুনে
কাটলো কতক্ষণ?
সে বাঁশ নিয়েই আজকে বলি
শুনেন দিয়া মন।
চির হরিৎ উদ্ভিদের আজ
কথা বলে যাই
ঘাস প্রজাতির মধ্যে এই
বাঁশকে আমরা পাই।
ফুল ফোটানোর পরেই তারা
মৃত্যুকে নেয় বেছে
নতুন বীজে নতুন চারা
গজায় নেচে নেচে।
বহুল ব্যবহৃত এ বাঁশ
গ্রাম শহরের কাজে
গৃহ নির্মাণ,হস্তশিল্প
আর মঞ্চের সাজে।
নিত্য দিনের কতো কিছু
তৈরি হয় বাঁশে
কচি বাঁশে ‘কেরোল’ আছে
খাবার নিয়ে পাশে।
বাঁশের চুঙে বিরই চালের
দারুণ পিঠে হয়
ছোট্ট বেলার ’চুঙা পিঠা’
আজও মনে রয়।
এক সময় তো কাগজ তৈরি
হতো এই বাঁশে
প্রধান শিক্ষা উপকরণ
নিয়ে ছিলো পাশে।
বাংলাদেশে জংলী এবং
আবাদিতেও আছে
ছাব্বিশটা প্রজাতি তার
এই মাটিতে বাঁচে।
সারাদেশেই বাঁশ জন্মায়
চাটগাঁ সিলেট বেশি,
জঙ্গলেতে জংলি আর
আবাদীতে দেশি।
বাস্তবে বাঁশ হয় ব্যবহার
কথায়ও দেয় বাঁশ,
বাঁশ দিয়ে কে কখন যে কার
করছে সর্বনাশ!
কেউ দিচ্ছে ছিলে আবার
কেউ আছিলা দেয়
কেউ খুশি হয় বাঁশটা দিয়ে
কেউ কষ্ট নেয়।
সবশেষে ভাই বলি এবার
বাঁশ দিবেন না বাঁশ,
মুখ সামলান হাত সামলান
টানেন বাঁশের রাশ।
`ও বৈশাখী, কেমন আছো ?` অনিন্দ্যসুন্দর একটি কবিতা। বৈশাখ নিয়ে কবি চন্দনকৃষ্ণ পালের এক অনবদ্য লেখা।
তোমার চোখে সবুজ দেখি সাথে দেখি কৃষ্ণচ’ড়া
কুহু তানে মাত করে যে কোকিল হলো হৃদয় হরা
বুকের ভেতর হু হু হাওয়া বইতে থাকে সকাল দুপুর
নূপুর বাজে, বাজতে থাকে গুলমোহরের পাপড়ি ঝরা-
থামে না আর, থামে না তো বৈশাখী ঝড় না আসাতেও
অযুত নিযুত মেঘের ময়ূর মেলতে থাকে তাদের পেখম
কৃষ্ণচূড়া নিজকে মিলায় তোমার শাড়ির আঁচল নিয়ে
ঝড় আসবে ঝড় আসবে, আসবে বৃষ্টি ঝমঝমাঝম।
অপেক্ষাতে কাল বোশেখীর, দেখবো কবে মেঘ চাদোয়া
তোমার দাঁতে ঝিলিক দেখে লজ্জা পাবে ঈশানী মেঘ
মুখ লুকোবে কার আঁচলে কার হৃদয়ে দাগ রেখেছে
উড়ছে ঘুরছে পাগল পারা শরীরে তার দুরন্ত বেগ।
সবুজ চারা চোখ মেলে চায় পদ্ম গোড়ায় সবুজ উঁকি
নবজলে মাথা নাড়ায় সবুজ ঘাসের কচি পাতা
রঙিন শাড়ির মৎসকন্যা নৃত্যে মাতে ঘাসের পাশে
শিকারী তার দুচোখ পাতে মৎসের আজ কোথায় ত্রাতা?
বিষন্নতা ছড়িয়ে থাকে মাঠের পাশে মাটির পথে
সোঁদা গন্ধ হারিয়ে গেছে কিন্তু মায়ার বাঁধন আছে
ও বৈশাখী কেমন আছো, সাদা লালে সেজে আসো
তুমি এলেই ছুটে যাবো, ছুটে যাবো তোমার কাছে।
শৈশব মানুষের জীবনের অমূল্য উপহার। শৈশব হারিয়ে গেলে টের পাওয়া যায় জীবন থেকে কী হারিয়ে গেল। মানুষ জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় পার করে শৈশবে। চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, শুধু খুশি আর খুশি, শুধু আনন্দ আর আনন্দ, শুধু ডানা মেলে ওড়া। জীবনের প্রয়োজনে আমাদের বড় হয়ে অনেক কিছুই করতেরহয়, শুধু করা হয় না শৈশবে ফেলে বাসা নিষ্পাপ কাজগুলো। শৈশবকে হৃদয়ে ধারণ করে চন্দনকৃষ্ণ পাল লিখেছেন, `শৈশব`
চৈত্র মাসের নিরব আদুরে চাঁদ জাগা সন্ধ্যায়,
গাছের পাতায় বাতাস যখন আদর দিয়ে যায়।
বড়দি আমি মন্টি সোনা শীতল পাটি পেতে,
চাঁদের বুড়ির সূতো কাটার গল্পে যেতাম মেতে।
উঠোন জুড়ে কামিনী ফুল ঘ্রাণ ছড়াতো তার,
রান্না ঘরে ব্যস্ত সময় কাটাতো তখন মা’র।
ঝাকড়া বকুল গাছের ডালে আওয়াজ করে পাখি,
বড়দি বলতো দুষ্টু পাখি ঝগড়া করছে নাকি?
পাতার ফাঁকে দূর আকাশে চাঁদের নিরব থাকা
একটা দুটো তারার মাঝে অনেক ছবি আঁকা।
আকাশ পানে দুচোখ মেলে অবাক হতাম আমি,
কখন জানি দুচোখ জুড়ে আসতো যে ঘুম নামি।
বড়দা বাবা ফিরতো বাড়ি তাদের কাজের শেষে,
আমরা তখন ক্লান্ত হয়ে গভীর ঘুমের দেশে।
খেতে যেতাম রান্না ঘরে বাবার কোলে চড়ে
ঘুম পরীরা তখনো ঠিক থাকতো দুচোখ ভরে।
ঘুমের ঘোরেই খাওয়া হতো তারপর বিছানায়
ঘুম ও স্বপ্নে দীর্ঘ সে রাত কেটে যেত নিরালায়।
ছেলেবেলার দিনরাতগুলো আজকে শুধুই স্মৃতি,
শৈশব থেকে দূরে চলে আসা এই পৃথিবীর রীতি।
বইমেলা নিয়ে বাঙালির নষ্টালজিয়ার শেষ নেই। আর বাঙালি লেখকদের কাছে বইমেলা তো একটা উৎসব। বইমেলা নিয়ে স্মৃতির মণিকোঠায় লুকিয় থাকে হাজারো গল্প। `বই মেলার স্মৃতি` চন্দনকৃষ্ণ পালের তেমনি একটি গল্প সমৃদ্ধ ছড়া।
দুপুর থেকে সন্ধ্যে হয়ে রাত
বই পোকাদের হয় না হজম ভাত।
কেনাকাটার চাইতে বেশী দেখা
মেলা নিয়ে ফিচার টিচার লেখা।
বর্ধমানের বিশাল সিঁড়ি জুড়ে
আড্ডা চলে কথা এবং সুরে।
লেখক কুঞ্জে নেই লেখকের দেখা
ব্যস্ত লেখক নিয়ে নূতন লেখা?
পত্রিকাতে বিজ্ঞাপনের সারি
বই বিষয়ক প্যাঁচাল ভারি ভারি।
প্রেমের চটি বিকোয় বেশী দামে
প্রেমের লেখক কথা বলেন চামে।
লিটল নিয়ে চাপা যারা মারেন
তারাই আবার বিগ ও হতে পারেন।
একশ ভাগ মেলার মাঠে হাঁটেন
বিশ ভাগ তার বই পত্র ঘাটেন।
পনেরো ভাগ মূল্য দেখেই সারা
বই কেনাতে নেই দশ ভাগ ছাড়া।
নতুন পুরোন বই নিয়ে হয় খেলা
এসব নিয়েই একাডেমির মেলা।
`নগরকীর্তণের সম্প্রচারে` চন্দনকৃষ্ণ পালের একটি পরিচ্ছন্ন কবিতা। কবিতায় প্রেমের ঝংকার আছে, আছে বুকের উষ্ণতা।
সরাসরি তোমায় দেখি তমাল তলায়
তোমার কণ্ঠে ঝরে কৃষ্ণ সংগীত
নগর কীর্তণেও দেখি মধ্যমনি তুমি
আমি শুধু পরবাসে দিনগুনি একা।
বাতাসে তোমার চুল গোবিন্দায় নমো
পাশ ঘেষে হেঁটে যায় স্নিগ্ধা বাউল
অরুন্ধতী হাসে তার ব্র্যান্ড সেই হাসি
পরিচ্ছন্ন পর্দাটাও ঝাপসা হয়ে আসে।
জীবনই কুয়াশামাখা কি করার আছে
সূর্যদেব লুকোচুরি খেলা নিয়ে থাকে
সবাই তো তার দলে আমি আজ একা
তোমার কণ্ঠেও আজ তারই সুর বাজে !
কবিগুরু আমাদের হৃদয়ে মিশে রয়েছে। মানুষের চিন্তায়, চেতনায়, মানুষের স্বয়নে-স্বপনে কবিগুরু দিবারাত্রি উঁকি দেয়। কবিগুরুর প্রেমে সবচেয়ে বেশি পড়েছে বাঙালি। `তুমি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর` বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে নিয়ে লেখা চন্দনকৃষ্ণ পালের এক দূর্দান্ত কবিতা।
আকাশ যখন দৃপ্ত তুমুল মেঘমালাতে সাজে
মেঘের গায়ে অযুত নিযুত ডমরু ধ্বনি বাজে
আমার বুকের ভেতর তখন তোমার গানের সুর
ঠাকুর তুমি আজকে কোথায়? আজকে কতো দূর?
কাশের বনে বাতাস যখন উড়ায় আঁচল তার
রঙ্গিন পালে পানসী যখন হয় এ নদী পার
আমার বুকের ভেতর তখন তোমার সুরধ্বনি
হাত পাতলেই দুহাত ভরে পদ্য গাঁথার খনি।
সূর্য যখন একটু নরম আলোয় ওঠে হেসে
আদুল গায়ের ছোট্ট শিশু দাঁড়ায় পথিক বেশে
আমার বুকের ভেতর ঠাকুর তোমার কাব্য ধারা
সকাল দুপুর রাত্রি আমি হই যে দিশেহারা।
সবুজ পাতার ফাঁকে যখন ফুলের তুমুল হাসি
বুকের ভেতর কে যে তখন বাঁজিয়ে যায় বাঁশি
আমার বুকের ভেতর ঠাকুর গেয়ে ওঠো তুমি
ধন্য হই আমি সাথে আমার জন্মভূমি।
দূর আকাশের কোনায় কোনায় যখন বজ্রপাত
বুকের ভেতর মিছিল নামে উর্ধ্বে লক্ষ হাত
প্রতিবাদে উথাল পাথাল ঠাকুর তোমার সাথে
দীপ্ত সূর্য দুহাত বাড়ায় উজ্জল এক প্রাতে।
`ঢাকার মানুষ` আসলে টাকার মানুষ। কথাটা মোটেও মিথ্যা নয়। সে কারণেই চন্দনকৃষ্ণ পাল লিখেছেন `আমরা মানুষ চাই`। `ঢাকার মানুষ` ছড়াটি বড় বাস্তব। নিগূঢ় সত্য উপলব্ধির কথামালা।
বিশাল শহর ঢাকা,
কিন্তু কোথাও মানুষ তো নেই
এক্কেবারে ফাঁকা।
বিশাল শহর ঢাকা।
আবাক হচ্ছো জানি,
অবাক হয়ে সবাই মিলে
করছো কানাকানি
অবাক হচ্ছো জানি।
কিন্তু এটাই সত্যি,
এই শহরের সকল মানুষ
গিলেছে এক দত্যি
সত্যি এটাই সত্যি।
সে দত্যি তো টাকা,
টাকার জন্য ধান্দা সবার
টাকাই ঘুরায় চাকা
সে দত্যি তো টাকা।
দৌড়টা টাকার জন্য,
দিনরাত্রি হারিয়ে গেছে
মানুষ যেনো পন্য
দৌড়টা টাকার জন্য।
সব মানুষের ছায়া,
আসল মানুষ হারিয়ে গেছে
যা আছে সব মায়া
সব মানুষের ছায়া।
দেখো যাচাই করে,
ছুটছে যারা সকাল দুপুর
বাইরে কিংবা ঘরে
দেখো যাচাই করে।
আমরা মানুষ চাই,
ছায়াগুলো মানুষ করার
কেউ কি কোথাও নাই?
আমরা মানুষ চাই।
বাঙলা ভাষার একটি জনপ্রিয় শিশু-কিশোর মাসিক পত্রিকা টইটম্বুর। টইটম্বুর শব্দটি শুনতে যেমন মধুর, বলতেও তেমন ভালো লাগে। টইটম্বুর নিয়ে এমন চমৎকার ছড়া লেখা যেতে পারে, এ ছড়াটি না পড়লে হয়তো আমি বিশ্বাসই করতে পারতাম না। চন্দনকৃষ্ণ পালের হাতে জাদু আছে। তিনি যেকোন শব্দ নিয়ে চমৎকার ছড়া রচনা করতে পারেন। ছড়া রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত।
১
ঘন ঘোর বর্ষা
ঝরছে অঝোরে,
দিন কাটে রাত কাটে
বৃষ্টির ঘোরে।
দিন রাত একটানা
বৃষ্টির সুর,
খাল বিল নদী নালা
টই-টম্বুর।
২
রাগ ও খেয়ালের
বসেছে আসর
সংগীত প্রেমীতে
ভরা এই ঘর।
বাতাসেতে ভাসছে
কি মধুর সুর,
সুরে সুরে সারা ঘর
টই-টম্বুর।
৩
চৈত্রের শেষ দিন
বসেছে মেলা,
হৈ হৈ রৈ রৈ
কতো যে খেলা।
লোকে লোকারণ্য
মেলা ভরপুর
লোকজনে ঘেরা যেনো
টই-টম্বুর।
৪
খেজুরের গাছে গাছে
রসের হাড়ি,
শীতের খেজুর রস
মিষ্টি ভারি।
সকালের সোনা রোদে
গ্রাম ভরপুর,
খেজুরের রসে হাড়ি
টই-টম্বুর।
`তিনি` একটি চমৎকার ছড়া। দুষ্ট, চাটুকার, দুর্বৃত্ত পরিবেষ্টিত তিনিদের জন্য এ এক বড় ছবক।
কাজের চেয়ে দৌড়ে তিনি পাকা,
তার
মাথাতে চুল নেইতো মোটে
চকচকে টাক রাখা।
তিনি গোল পেতে চান গোল,
এই
গোলের জন্য যায় হয়ে যায়
ভীষণ হুলোস্থুল।
গোলের চেয়ে হট্টগোল হয় বেশী,
তিনি
আস্ত একটা ম্যারাডোনা
ফোলানো তার পেশী।
তিনি লালটু রহমান
তার
কাজের চেয়ে কথা বেশী
দূষিত হয় কান।
`তেলের তেলেসমাতি` চন্দনকৃষ্ণ পালের এক অসামান্য ছড়া। চাটুকারদের নিয়ে লেখা এক অনন্য সৃষ্টি।
সবাই কি আর দিতে পারে তেল?
সবাই কি আর জানে তেলের খেল?
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশাই
জানেন তেলের গুণ
তেল নিয়ে ভাই হও সিরিয়াস
করো না ধুনফুন।
তেল ব্যবহার করতে পারে যে
এই পৃথিবীর সেরা মানুষ সে।
তেলে খুশি ঘরের মানুষ
বাইরের অবশ্যই
তেল পেলে সব পুরুষ নারী
দিব্যি খুশি হই।
তেলে যেমন প্রদীপ জ্বলে
তরকারি হয় স্বাদু
তেলের আছে হাজারো গুণ
তেলের আছে যাদু।
তেলে তেলে গিন্নি স্নিগ্ধ
প্রণয় বাড়ে জানি
পুত্র কন্যার ভালোবাসা
তেলেই বাড়ে মানি।
তেল দিয়ে তেল বাহির করা ভালো
তেলই ছড়ায় চেহারাতে আলো।
তেল দেবার পাত্র আছে
বুঝে শুনে দাও
তুমি খুশি সেও খুশি
দারুণ রিটার্ণ পাও।
সময় মতো অল্প তেলে
কাজ তো হবে বেশি
অসময়ে পন্ড সবই
যতোই দেখাও পেশি।
বুদ্ধিমানের তেল দেয়াতে
শিল্পগুণও আছে
বেকুবেরা তেল দিয়ে তো
ঘুরে পাছে পাছে।
তেল সত্য জানলে তোমার জয়
তেলের চাইতে বড় কিছুই নয়।
তেলবাজরা তেল দিলেও
স্বীকার করে না যে
তেল ঢালছে সকাল দুপুর
ঢালছে সকল কাজে।
নিয়ম মতো তেল ঢাললেই
ফকফকা পথঘাট
ভাই বন্ধু সকলে নাও
তেল ঢালবার পাঠ।
তেলের গুণ সবার জানতে হবে
তেলবাজদের মাথাই উচু রবে!!!
`রাত ও বিষন্ন কিশোর` চন্দনকৃষ্ণ পালের একটি অপূর্ব কবিতা
সারাটা আকাশে একটাই চাঁদ আর কোন কিছু নেই,
নিঝঝুম রাত চরাচর ঘুমে মৃদু আলো ঝরছেই।
হালকা কুয়াশা হিম ছুড়ে দেয় মাঠ আর প্রান্তরে
সব মানুষেরা ওম শুষে নিয়ে শুয়ে আছে ঘরে ঘরে।
অনিন্দ্য এই রূপ পৃথিবীর কজন মানুষ জানে?
গভীর রাতে ঘোর লাগা চোখে তাকায় আকাশ পানে।
বয়ে চলে নদী রূপোলী জলের ঢেউ ভেঙে ভেঙে পড়ে
জমানো শিশির গাছ হতে নীচে কালচে ঘাসেতে ঝরে।
শিউলী ছড়ায় রাতের বাতাসে মোহময় প্রিয় ঘ্রাণ
একটি কিশোর জানালায় বসে, ঘ্রাণে ভরে তার প্রাণ।
ঘুম নেই এই কিশোরের চোখে মন ছুটে যায় দূরে
জানেনা কোথায় নিজেকে হারায় কোন সে অচিনপুরে।
বিষন্নতা বুকের ভেতর ডালপালা মেলে শুধু
চাঁদের আলোয় গাছ-নদী-মাঠ হয় মরুভূমি ধু ধূ।
রাত কেটে যায় জানে না সে হায়, কিশোর বসেই থাকে
অজানা রঙ আর স্বপ্ন তুলিতে সে শুধুই ছবি আঁকে।
শিশির বিন্দু ঘাসের ডগায় করে যদি টলোমল
কিশোরের দুই দীঘল চোখেতে জমে উঠে লোনা জল।
`আমার কিছুই নেই` চন্দনকৃষ্ণ পালের একটি সমৃদ্ধ কবিতা।
আমার একটা আকাশ ছিলো নীল,
শুভ্র আলো গায়ে মেখে উড়তো শঙ্খচিল।
আজ আকাশে ধূয়োর উড়ে চলা,
বিষাক্ত গ্যাস, ধূলিকণার কতো কথা বলা।
আমার একটা নদী ছিলো সত্যি,
তার প্রবাহে গতি ছিলো থামতো না একরত্তি।
আজ নদীতে বিশাল বিশাল চর,
উজান দেশের দত্যিগুলি ঘর ভেঙ্গেছে ঘর।
আমার ছিলো একটা বিশাল বন,
পাখ-পাখালি দেখে ভালো থাকতো আমার মন।
আজ সেখানে ধূ ধূ প্রান্তর
বন কেটে আজ বানায় সবাই নিজের বাড়ি ঘর।
আমার এখন কিছুই তো নেই দেশে,
দত্যিরা সব কেড়ে নিলো হেসে।
মা মানে তো মা`ই, `মা, তুমিই বলো` কবি চন্দনকৃষ্ণ পালের মা`কে নিয়ে লেখা এক অনুভব সম্পন্ন কবিতা।
মা,
কতোদিন হয় তোমায় দেখি না।
শেষ চৈত্রে সেই যে এলাম কালবোশেখী মাথায় নিয়ে
ছেলে যেনো ভালো থাকে, বিদায় দিলে আশীষ দিয়ে
তোমার হাতের ছোঁয়াটুকু অনুভবে এখনো পাই
সবই আছে আমার কাছে, শুধু আমার মা কাছে নাই।
চুলোর পাশে, পুকুর ঘাটে
সূর্য যখন বসে পাটে
সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়ে মা বসেন প্রার্থনাতে
মনে মনে আমিও থাকি সাথে
মা যেনো এই চিবুক ছুঁয়ে বলেন, ভালো থাকিস
সকাল বেলার পূব আকাশে লাল সূর্য আঁকিস।
আমার-
চোখ করে ছলছল
হয়তো বা আজ অজান্তেই চোখে আসে জল
এই শহরে রঙ নেই মা ধূলোর আস্তরণ
সকাল থেকে রাত অবধি শুধুই মহারণ
বেঁচে থাকার জন্য কী যে যুদ্ধ দিন ও রাতে
আমিও আজ মিশে গেছি জনস্রোতের সাথে
রঙ তুলি আজ অবহেলায় পড়ে থাকে দূরে
বুকের ভেতর সানাই বাজে কী যে করুন সুরে।
মাসের পরে মাস গিয়েছে বসন্ত আজ দ্বারে
বুকের ভেতর ভরে আছে ভীষণ হাহাকারে
মায়ের আঁচল হাতছানি দেয় রোজ
আমার কাছে নেই তো সুখের খোঁজ
সুখ পাখিটার পাইনি দেখা
শহরে নেই পাখি
কথা ছিলো পাখির পায়ে পরিয়ে দেবো রাখি
সেই পাখিকে নিয়ে যাবে মায়ের আঙ্গিনায়
কোথায় সেদিন, বাস্তবে নেই স্বপ্নেই বুঝি হায়।
মা,
খালি হাতে কেমনে আসি তুমিই বলো না?
এক সন্ধ্যা থেকে অন্য সন্ধ্যায়
চন্দনকৃষ্ণ পাল
আমাদের দিন ছিলো স্বর্ণ রঙিন, আজ ভাবি
তামাবিল রোড ছিলো সত্যি মধুময়
মুলিবাঁশ বনে ছিলো ধূয়োর কুন্ডলী
তার মাঝে তুমি ছিলে তীব্র কুয়াশা।
কুয়াশাই বলি আজ, রহস্য তো ছিলো সেই কালে
আমিও বেকুব এক জড়িয়ে নিয়েছি তোমায়
উপভোগ তুমিই করেছো আর আমি শুধু সায় দিয়ে গেছি
আজ তাকালে দেখি অভিনয়ে সত্যি তুমি সেরা।
আমি দর্শকমাত্র সে নাটকে, কুশীলব আরো কেউ কেউ
তারা আড়ালে ছিলো, ঝোঁপ শুধু নড়ে গেছে একা
নিজের আনন্দে মেতেছি আমি আর কারো পাইনি তো দেখা
চাইনিও, বিশ্বাসে মিলিয়ে গেছে সেই সব দিন,
আজ-
বিপন্ন বসতিতে তোমার ছায়াও নেই, সন্ধ্যে নামে
ধীর পায়ে, প্রদীপ জ্বলেনা আজ, তুলসীতলা একা
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শুধু আর বলে এমন হতেই পারে-
তাই বলে খোলা মাঠে বসে বসে সন্ধ্যে দেখবে তুমি.
আমি নিরব থাকি, উত্তর দেবার ইচ্ছে উবে যায় গাঢ় আঁধারে।
`মুগ্ধ থাকো` কী কবি নিজেকেই বলেছেন? চন্দনকৃষ্ণ পাল যে কারণেই কবিকে মুগ্ধ থাকতে বলুন না। আমরা চাই তিনি মুগ্ধ থাকুন নিজের সৃষ্টির মোহনায়।
অপেক্ষাতে দিন গিয়েছে
আকাশ দেখে নদী দেখে
শরৎ এবং বসন্তটার
মুগ্ধ করা ছবি এঁকে।
ফুল ফোটেনি ফুল ফোটেনি
অবাক চোখে সবাই তাকায়
কিন্তু শিল্পী ঘোরের ভেতর
ব্যস্ত তিনি ছবি আঁকায়।
কিন্তু হঠাৎ কি হলো আজ
তার চোখে যে মেঘের ময়ূর!
বাজছে কানে ভৈরবী রাগ
মন উতলা করা সে সুর।
কে যেন আজ আসছে দেখো
তোমার কাছে সবুজ পাতায়
মুগ্ধ থাকো প্রিয় কবি
ছন্দে, সুরে আর কবিতায়।
চন্দনকৃষ্ণ পালের লেখা `অবাক খোকন` কিশোর প্রাণের বিষ্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে লেখা। কিশোরের কৌতুহল নিয়ে লেখা এক মনোমুগ্ধকর কিশোর কবিতা।
মেঘ যখনই সূর্যকে দেয় ঢেকে
ধানের ক্ষেতে আলোছায়া এঁকে
সূর্যের আলো ছুটতে থাকে
সবুজ ঢেউয়ে ছায়া আঁকে
অবাক খোকন তাকিয়ে দেখে
আলো ছায়ার খেলা
যায় কেটে তার বেলা।
ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ খেলে যায়
ঢেউয়ের বুকে ঢেউ যে হারায়
পানার ঝোপা নাচতে থাকে
নীল সবুজে ছবি আঁকে
অবাক খোকন তাকিয়ে দেখে
জল আকাশের খেলা
যায় কেটে তার বেলা।
দিগন্তের ঐ শেষ সীমানায়
আকাশ যখন দিশা হারায়
সে সীমানায় পাহাড় একা
আবছায়া নীল গায়ে লেখা
অবাক খোকন তাকিয়ে দেখে
নীল ধূসরের খেলা
যায় কেটে তার বেলা।
আমাদের পথচলা `চন্দনকৃষ্ণ পাল` একটি সমৃদ্ধ কবিতা।
আমাদের পথচলা শেষ হয় না তো!
শততম স্মৃতি স্তম্ভ কবেই পেরনো হলো
তার পর আরো কতো ভিত্তিপ্রস্তর
গাঁথা হলো এই সবুজ সবুজ প্রান্তরে
লাল মাটি প্রাণ খুলে সবুজকে আশীর্বাদ করে
বলে আরো সবুজ হও প্রিয়
ডালপালা উর্ধমুখে নিজেকে ছড়াক আরো
গ্রীষ্মের দাবদাহে শান্তির পরশে করো সব মধুময়।
শিশু আর কিশোরেরা হাত ধরাধরি করে হাঁটে
আপনার সব বই হাতছানি দিয়ে ডাকে এই আমাদের
গতরাত স্বপ্নে কেটেছে, শত প্রচ্ছদ দেখি
সারি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে এই ফুলছড়া তীরে
ঘোলা জল ভাটি যাত্রায় দেখি শুভেচ্ছা জানায়।
কি যে ভালো লাগে এই ক্ষণ,এই শুভযাত্রা
পঞ্চাশের এই স্তম্ভ পচাত্তর, একশ হয়ে এগিয়ে যাক তার পথে
আমরা নিরবছিন্ন ভালোবাসায় মেতে থাকি আপনার সাথে,
আপনার বইগুলো,স্বপ্নগুলো মেখে নেই আমাদের জীবনের সাথে....।
কবি লিখেছেন `আমাদের পথচলা শেষ হয় না তো!`। কী নান্দনিক কথা। আসলেই কবিদের পথচলা শেষ হয়না। অনন্ত কাল ধরে চলতে থাকে কবিতার পথচলা। কবিদের পথচলা। কবি চন্দনকৃষ্ণ পাল কবিতার ভূবনে আরো দীর্ঘকাল দূর্দান্ত প্রতাপের সাথে পথ চলুক সে কামনাই।