
রুশো
জগলুল আসাদের গদ্য ‘রুশো প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা’
প্রকাশিত : নভেম্বর ১৭, ২০২২
রুশো এনলাইটেনমেন্ট ফিলোসফারদের মধ্যে কিছুটা ভিন্ন এবং কিছু ক্ষেত্রে ট্রিকি ও কনফিউজিং ছিলেন। এনলাইটেনমেন্ট দর্শনের মধ্যে থাকা এথিইস্টিক এলিমেন্ট তার কাছে অনুমোদনীয় ছিল না। যুক্তির রক্ষণশীলতা তিনি বুঝতেন। এটাও মানতেন, বিজ্ঞান ও শিল্পের অগ্রগতি মানেই ব্যক্তি ও সমাজের উন্নতি, ব্যাপারটা এমন না। তার ডিস্কোর্স অন আর্ট অ্যান্ড সাইন্সে, যা তার ফার্স্ট ডিস্কোর্স নামে পরিচিত, আলোচনা আছে এ নিয়ে।
এছাড়া যুক্তির চেয়ে হিউম্যানিটি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ও ডিভাইন মর্যাদার ব্যাপার ছিল। পোস্ট-রিলিজিয়াস হিউম্যানিজমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রচারক তিনি, যেখানে আইডিয়াল হিসেবে থাকবে সমতা, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ইত্যাদি। রিলিজিয়াস থেকে সো কল্ড সেকুলারিজমে ট্র্যাঞ্জিশনের ধারণায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছেন রুশো ৷ তিনি রিলিজিয়ন অব ম্যান আর রিলিজিয়ন অব সিটিজেনকে আলাদা করেছেন।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধর্মপালন কেউ করবে, এটাকে ভালোই বলেন তিনি। একটা পর্যায় পর্যন্ত রুশো নিজে ধর্ম পালনও করতেন। পরে সম্ভবত ডিইস্ট হন। তার মতে, ব্যক্তির এই ট্র্যাডিশনাল ধর্ম রাষ্ট্রে ছায়াপাত করা যাবে না। খ্রিস্টানিটি বা অন্য কোনো ঐশী ধর্ম এই সিভিক রিলিজিয়ন হতে পারবে না। কারণ, অন্য অনেকেই এই ধর্মে বিশ্বাসী না। আবার ধর্মের অর্থাৎ তার কাছে খ্রিস্টানিটির, ভেতরে তো অনেক সেক্টও আছে।
তাই ট্র্যাডিশনাল ঐশিধর্ম সিভিক রিলিজিয়ন হবার উপযুক্ত নয়। রিলিজিয়ন অব সিটিজেন আলাদা হবে। রাষ্ট্রের অবলম্বিত ভ্যালুই হবে সিভিক রিলিজিয়ন। নৈতিকতার ক্ষেত্রে তিনি কোনো এবসলিউটে বিশ্বাস রাখেননি। তার কাছে স্বাধীনতার একটা অর্থ ছিল obedience to the law one prescribes to oneself is freedom। নিজের জন্যে নিজের বিবেক দ্বারা প্রণীত নীতির অনুগত থাকা হচ্ছে, নৈতিকতা ও স্বাধীনতা।
এই অর্থেও তিনি এনলাইটেনমেন্ট প্যারাডাইমে পড়েন। তাছাড়া তার কাছে নৈতিকতা হচ্ছে এমন এক প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যক্তি সচেতনভাবে নিজেকে কমিউনিটির সাথে ইনটিগ্রেট করে রাখবে। এইভাবে তার কাছে নৈতিকতার উৎস কখনো ব্যক্তির বিবেক, কখনো যুক্তি বা প্যাশনও, কখনো অবশ্যই সোশাল অর্ডার বা কন্সেন্ট।
রাষ্ট্রের লেজিটিমেসির উৎস হবে জেনারেল উইল বা জনগণের সাধারণ ইচ্ছে। এই সাধারণ ইচ্ছে ধারণাটা কিন্তু বেশ খটমটে। এসিয়া বার্লিনসহ অনেকেই এর নানামাত্রা ও সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন। ব্যক্তি না, বরঞ্চ নাগরিক হিসেবে এই সাধারণ ইচ্ছায় যে কেউ কন্ট্রিবিউট করবে। ব্যক্তির স্বাধীনতা হচ্ছে এই সাধারণ ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পন করাতে। যদি কেউ এই স্বাধীনতা না চায় তবে তাকে স্বাধীন হতে বাধ্য করা হবে, Forced to be free।
অনেকেই মনে করেন, ফরাসি বিপ্লোবোত্তর রেইন অব টেররে রুশোর চিন্তার ভুমিকা ছিল। রবেস্পিয়ার নাকি রুশোর সোশাল কন্ট্রাক্ট বালিশের নিচে নিয়া ঘুমাতেন। সাধারণ ইচ্ছা ও সকলের ইচ্ছার মধ্যে একটা পার্থক্য টেনেছেন রুশো। যে ইচ্ছে সকলের ভালোকে Common Good ট্র্যাক করতে পারে সেটা জেনারেল উইল। কিন্তু উইল অব অল বলতে বোঝেন বিবাদমান Competing সকলের স্বার্থের যোগফল। সকলের ইচ্ছা তার আলোচ্য নয়, বরঞ্চ তার আলোচ্য সাধারণ ইচ্ছা।
আইনপ্রেণতা চিহ্নিত করবে জনগণের এই সাধারণ ইচ্ছাটাকে। লেজিসলেটর কোনো ফিলোসফার কিং হবেন না, যিনি নিজের ভালো ও মহৎ বুঝকে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেবেন চিন্তার গজদন্ত মিনার থেকে। আইন প্রণেতা কোনো আল্লাহ বা খোদাও হবেন না, আইনপ্রণেতা হবেন জনগণেরই একজন, জনগণের বাইরে বা ওপরের কোনো বহিস্থ সত্তা আইন প্রণেতা হবেন না। কারণ রুশোর মতে, একমাত্র সভরেন হচ্ছে পিপল।
লেখক: প্রাবন্ধিক