জাবিদ মাহমুদের কলাম ‘নাজাতপ্রাপ্ত ও অন্যান্য দল’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২০, ২০২১

রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল সর্বদা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাদের দুশমনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের উপর জয়ী হবে। অবশেষে তাদের শেষদলটি কুখ্যাত প্রতারক দাজ্জালের সাথে যুদ্ধ করবে। (সূনান আবু দাউদ ২৪৮৪, ইফাঃ ২৪৭৬)

দুশমনরা কিন্তু শুধুমাত্র বাইরের (অমুসলিম) নয়, বরং ঘরের কিছু শত্রু (বিশ্বাসঘাতক মুনাফিক) থাকে। আর ওই বিজয়ী দল তাদের সাথেও জয়ী হয়ে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করে। অপরদিকে হাদিসে পাকে এও বর্ণিত হয়েছে যে, খারেজিদের মধ্যে থেকেই দাজ্জালের আবির্ভাব হবে বা তাদের সর্বশেষ দলটি দাজ্জালের সাথে মিলিত হবে, যাদের পূর্বপুরুষ প্রকাশ পেয়েছিল রাসূলুল্লাহের ﷺ সময়ে তাঁর শানে বেয়াদবির মাধ্যমে, যাদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ﷺ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।

শরিক ইবনু শিহাব (রহ.) বলেন, আমি তীব্র আকাঙ্ক্ষা পোষণ করছিলাম যে, নবির ﷺ কোনো সাহাবির সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর নিকট খারিজিদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করব। পরিশেষে এক ঈদের দিন আবূ বারযাহ্ এর সাথে তাঁর বন্ধুদের উপস্থিতিতে সাক্ষাৎ করলাম। এরপর তার নিকট জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি রাসূলুল্লাহকে ﷺ খারিজিদের ব্যাপারে আলোচনা করতে শুনেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি আমার দুই কানে রাসূলুল্লাহকে ﷺ বলতে শুনেছি এবং আমি আমার দুই চোখ দিয়ে দেখেছি। একদিন রাসূলুল্লাহর ﷺ নিকট কিছু ধন-সম্পদ আসলে তিনি তা বিলিয়ে দিলেন। যে তাঁর ডানদিকে ছিল তাকে দিলেন এবং তাঁর বামদিকে ছিল তাকেও দিলেন। কিন্তু যে তার পেছনে ছিল তাকে কিছুই দিলেন না।

পরিশেষে তাঁর পেছনে বসা লোকেদের মধ্য থেকে একজন দাঁড়িয়ে বলল, হে মুহাম্মাদ, বণ্টনের ক্ষেত্রে তুমি ইনসাফ কায়েম করোনি। সে ব্যক্তি কালো বর্ণের ও মাথা ছিল মুণ্ডানো (ঘন দাড়িবিশিষ্ট) এবং তার গায়ে ছিল দুটি সাদা চাদর। এরপর নবি ﷺ রাগস্বরে বললেন, আল্লাহর কসম, আমার পরে তোমরা আর কাউকে আমার চেয়ে বেশি ন্যায়বান ও ইনসাফকারি পাবে না। আরো বললেন, শেষ যুগে একটি দল বের হবে, মনে হয় যেন এ ব্যক্তি তাদেরই মধ্য থেকে একজন। (এ ব্যক্তির বংশ থেকে এমন এক জাতির উদ্ভব হবে) তারা কুরআন পড়বে, কিন্তু তা তাদের গলধঃকরণ হবে না। তারা ইসলাম থেকে এরূপে বেরিয়ে যাবে যেভাবে নিক্ষিপ্ত তীর শিকার ভেদ করে বের হয়ে যায়। তাদের পরিচয়-নমুনা হলো, তাদের মাথা মুণ্ডিত থাকবে। তারা সর্বাবস্থায় আবির্ভূত হতে থাকবে। পরিশেষে তাদের সর্বশেষ দলটি বের হবে দাজ্জালের সাথে। (মিশকাত ৩৫৫৩, নাসাঈ ৪১০৩)

এছাড়াও সুনানে ইবনে মাজাহ শরীফে খারেজির আলোচনা নামক পরিচ্ছেদেও ১৭৪ নং হাদিস শরিফেও এসেছে, এই খারেজিদের মধ্যে থেকেই দাজ্জাল আবির্ভূত হবে। এদের বৈশিষ্ঠ্য বর্ণনা করতে গিয়ে ইমাম বুখারী রহ. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, তাদের নামাজের তুলনায় তোমরা নিজেদের নামাজ  ও রোজা নগণ্য বলে মনে করবে। মানে, তাদের আমলের তুলনায় তোমাদের আমলকে তুচ্ছ মনে করবে। এরা কুরআন পাঠ করে, কিন্তু কুরআন তাদের কণ্ঠনালির নিচে নামে না। তারা দ্বীন হতে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমন তীর ধনুক হতে বেরিয়ে যায়। তীরের অগ্রভাগের লোহা দেখা যাবে কিন্তু কোনো চিহ্ন পাওয়া যাবে না। কাঠের অংশ দেখলে তাতেও কিছু পাওয়া যাবে না। মাঝের অংশ দেখলে তাতেও কিছু পাওয়া যাবে না। তার পালক দেখলে তাতেও কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না। অথচ তীরটি শিকারি জন্তুর নাড়িভুঁড়ি ভেদ করে রক্তগোশত পার হয়ে বেরিয়ে গেছে। (সহীহ বুখারী ৩৬১০, ৫০৫৮....)

তাই আমাদের উচিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ কর্তৃক ভবিষ্যদ্বাণীকৃত ওইসব ভণ্ড দলকে চিহ্নিত করে নাজাতপ্রাপ্ত দলকে আঁকড়ে ধরা। এত সুন্দর করে বৈশিষ্ট্যাবলি বর্ণনার পরও যারা ওই ভণ্ডদের চিনতে পারেনি, সঠিক দলের সন্ধান পায়নি, তাদের মতো বড় দুর্ভাগা আর কেই বা হতে পারে! রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, যে ব্যক্তি (নাজাতপ্রাপ্ত) জামা‘আত (দল) হতে এক বিঘত পরিমাণও দূরে সরে গেছে, সে ইসলামের রশি (বন্ধন) তার গলা হতে খুলে ফেলেছে। (মিশকাতুল মাসাবীহ ১৮৫, সূনান আবূ দাঊদ ৪৭৫৮, মুসনাদে আহমাদ ২১০৫১)

আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, নিঃসন্দেহে আমার উম্মতের ওপর এমন একটি সময় আসবে যেমন বনি ইসরাঈলের ওপর এসেছিল। যেমন এক পায়ের জুতা অপর পায়ের জুতার ঠিক সমান হয়। এমনকি বনি ইসরাঈলের মধ্যে যদি কেউ তার মায়ের সাথে প্রকাশ্যে কুকর্ম করে থাকে, তাহলে আমার উম্মতের মধ্যেও এমন লোক হবে যারা অনুরূপ কাজ করবে। আর বনি ইসরাঈল ৭২ ফিরক্বায় (দলে) বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমার উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩ ফিরক্বায়। এদের মধ্যে একটি ছাড়া সব দলই জাহান্নামে যাবে।

সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ﷺ, জান্নাতি দল কারা? উত্তরে তিনি ﷺ বললেন, যার ওপর আমি ও আমার সাহাবিগণ প্রতিষ্ঠিত আছি, যারা তার উপর থাকবে। (সুনান আত তিরমিযী ২৬৪১, মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) ১৭১)

ফলে নব্য সৃষ্ট দলগুলো সম্পর্কে জানবেন, সচেতন থাকবেন। কেননা নাজাতপ্রাপ্ত দল একটামাত্র। কোনো দলের অনুসরণের ক্ষেত্রে অবশ্যই দেখবেন যে, এদের সিলসিলা এবং আদর্শ সাহাবায়ে কেরাম পর্যন্ত পৌঁছেছে কিনা! নাকি ইবনে আব্দুল ওয়াহাব নজদী কিংবা ইবনে তাইমিয়াতেই থাইমা গেছে!

ইবনু উমর (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, হে আল্লাহ, আমাদের শামদেশে বরকত দান করুন। হে আল্লাহ, আমাদের ইয়ামানদেশে বরকত দান করুন। লোকেরা বলল, আমাদের নাজদের জন্যও (দুআ করুন)। তিনি পুনরায় বলেন, হে আল্লাহ, আমাদের সিরিয়ায় বরকত দান করুন, আমাদের ইয়ামানদেশে বরকত দান করুন। এবারও লোকেরা বলল, আমাদের নাজদের জন্যও (দু’আ করুন)। তিনি বললেন, সেখানে তো ভূমিকম্প, বিশৃঙ্খলা বা ফিতনা আর সেখান হতেই শয়তানের শিং আবির্ভাব হবে। (সূনান আত তিরমিজী ৩৯৫৩, সহিহ বুখারী ৭০৯৪)

যেই দেশের জন্য প্রিয় নবি ﷺ দুআ করেছিলেন সেখানে কত সুন্দর করেই না মিলাদুন্নবী ﷺ উদযাপন করা হয় আর যেখানের জন্য দুআ করতে অনুরোধ করা সত্ত্বেও দুআ করেননি এবং বলেছেন সেখানে ভূমিকম্প, বিশৃঙ্খলা বা ফিতনা আর সেখান হতেই শয়তানের শিং আবির্ভাব হবে; আর সেখান থেকেই একজন অন্যতম ফেতনাবাজ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব নজদীর জন্ম হয়েছে; যার অনুসারীরা আজ এটাকে বেদাত শিরিক ফতোয়া মারে। কেউ কেউ তো ওই হাদিসের ব্যাখ্যায় শয়তানের শিং হিসেবে ইবনে আব্দুল ওয়াহাব নজদীর প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন।

হুমায়দ ইবনু ‘আবদুর রহমান (র.) বলেন, আমি মু‘আবিয়াহকে (রা.) খুৎবায় বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমি নবিকে ﷺ বলতে শুনেছি, আল্লাহ্ যার মঙ্গল চান, তাকে দ্বীনের ‘ইলম দান করেন। আল্লাহ্ই দানকারী আর আমি বণ্টনকারী। এ উম্মত সর্বদা তাদের প্রতিপক্ষের উপর বিজয়ী থাকবে, আল্লাহর আদেশ (কিয়ামত) আসা পর্যন্ত আর তারা থাকবে বিজয়ী। (সহীহ বুখারী ৩১১৬)

অন্য বর্ণনায় আরো এসেছে, সর্বদাই এ উম্মত কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর হুকুমের উপর কায়িম থাকবে, বিরোধিতাকারীরা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। (সহীহ বুখারী ৭১)